চুলওয়ালা পুতুল—(Misk Al Maruf)

ঘটনাটা ২০১২ সালের লক্ষ্মীপুরের আমাদের পুরনো গ্রামবাড়িতে। বাড়ির পেছনে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত, যেখানে রাতে ঝিঁঝিঁ পোকারা একনাগাড়ে ডেকে চলত আর ঠিক ডানদিকে ছিল “কালা-বন” একটা ছোট, ঘন জঙ্গল। গাছপালা এত পুরনো আর জড়ানো ছিল যে দিনের আলোতেও বনটার ভেতরে অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে লাগত।

​এই কালা-বন নিয়ে বহুদিন ধরেই নানা গুজব চলত। গ্রামের বয়স্করা বলতেন, “ওখানে রাতে যাওয়া যায় না। কোনো কিছু ফেলতে গেলেও সাবধানে ফেলতে হয়। যেটা থাকে, সেটা রেগে গেলে ফিরে আসে।”

​সেবার ঢাকা থেকে আমার খালাতো বোন মীম বেড়াতে এসেছিল। মীম তখন সবে কৈশোরে পা দিয়েছে তার চোখে নতুনত্বের ঔজ্জ্বল্য। তার হাতে ছিল একটা সুন্দর বিদেশি পুতুল সাদা ফিনফিনে গায়ের রঙ, নীল পাথরের মতো চোখ আর কাঁধ ছোঁয়া বাদামি চুল। চুলগুলো ছিল অদ্ভুত নরম, যেন সদ্য ধোয়া সিল্ক।

​মীম হাসিমুখে বলল, “এটা খুব সুন্দর না? ঢাকা থেকে আসার সময় কিনেছি। ভাবলাম নানাবাড়ির ড্রয়িংরুমের টেবিলে রেখে দেব এখানে তো এমন সুন্দর কিছু নেই।”

​মা পুতুলটা এনে ড্রয়িংরুমের কাঁচের টেবিলের পাশে সাজিয়ে রাখলেন। পুতুলটার স্থির নীল চোখ যেন আমাদের বাড়ির প্রতিটা কোণ, প্রতিটা মানুষকে আলাদা আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করছে এই অনুভূতিটা আমার শুরু থেকেই হচ্ছিল। একটা ঠান্ডা অস্বস্তিকর দৃষ্টি।

​সেদিন বিকেল গড়াতেই রাতের বাতাস ভারী হয়ে আসছিল। আমি দূর থেকে দেখলাম জানালাগুলো সব বন্ধ থাকা সত্ত্বেও পুতুলটার কাঁধ ছোঁয়া বাদামি চুল খুব অল্প অল্প নড়ছে… যেন কোনো অদৃশ্য হাত আলতো করে টানছে। বাতাসের কোনো গতি নেই তবুও নড়ছে। আমি ভাবলাম হয়তো আমার চোখের ভ্রম। কিন্তু সেই রাতে আমার ঘুম গভীর হয়নি। বারবার মনে হচ্ছিল অন্ধকার ঘরের এক কোণে পুতুলটা নীরবে তার নীল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।

​দুই দিন পর। আমরা সবাই একসঙ্গে সকালের নাস্তা করছি এমন সময় মা ডেকে বললেন, “কিরে, পুতুলটা একটু দেখতো। এর চুল কি এরকম লম্বা ছিল?”

​আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। আমার বুক ধক করে উঠল। পুতুলটার চুল সত্যিই আগের চেয়ে লম্বা! কাঁধ থেকে নেমে এখন প্রায় বক্ষদেশ ছুঁই ছুঁই। একেবারে সামান্য নয় স্পষ্টভাবেই বড়। মনে হলো কেউ যেন এক রাতের মধ্যে পুতুলটির চুলে নতুন করে প্রাণ দিয়েছে আর সেগুলো গজিয়ে উঠেছে।

​আমি কথা হারিয়ে ফেললাম। আমার মায়ের মুখেও অবিশ্বাস আর ভয়ের ছাপ।

​মীম অবশ্য তখনো হাসাহাসি করছিল, “আরে কীসের ভয়! হয়তো আলোতে এমন লাগছে । ছোটখাটো পুতুলের চুল তো এমনই হয়।”

​কিন্তু সেদিন রাতে যখন আবার তাকালাম চুল আরও বড়। আগের দিনের চেয়েও প্রায় তিন-চার ইঞ্চি লম্বা। এখন তা একেবারে বুকের কাছে পৌঁছে গেছে। চুলের রঙটা সামান্য কালচে হয়ে এসেছে মনে হলো যেন তাতে স্যাঁতসেঁতে ভাব আছে। ভয়ের গরম ঠাণ্ডা ঘাম আমার পিঠ বেয়ে নামতে লাগল। এটা আর নিছক ভ্রম নয় নিশ্চিত কোনো অস্বাভাবিকতা।

​কিন্তু এরপর যা হলো তার সাথে এই ভয়ের কোনো তুলনাই চলে না।

​পরের তিন দিন যেন আমাদের বাড়িটাকে কেউ কালো যাদুর অভিশাপ দিল। একটা শ্বাসরুদ্ধকর চাপা আতঙ্ক আমাদের গোটা বাড়িকে গ্রাস করল। আমরা রাতে ফিসফিস করে কথা বলতাম আর দিনের বেলায়ও পুতুলটার দিকে সরাসরি তাকাতে সাহস পেতাম না।

​প্রথম রাতে ​আমরা সবাই পুতুলটার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম। রাতে আমি টর্চ জ্বালিয়ে লুকিয়ে দেখলাম। চুল কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে! চুলের দৈর্ঘ্য এমন দ্রুত বাড়ছে যে মনে হচ্ছিল, আমরা বুঝি কোনো দ্রুতগতির ভিডিও দেখছি। আমার মনে হলো এটা আর পুতুল নেই, এটা এখন কোনো জীবের অংশ।

​দ্বিতীয় রাতে ​মা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি খুবই ধার্মিক মানুষ। তিনি পুতুলটা ধরলেন না, একটা পুরনো কাপড় দিয়ে জড়িয়ে আলমারিতে রেখে দিলেন। এরপর আলমারির কাঠের পাল্লা শক্ত করে বন্ধ করলেন, আর তালা লাগিয়ে দিলেন। মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “যা খারাপ থাকুক, আর ঘরে ফিরতে পারবে না।”

​সকালে বাবা বাইরে থেকে ফিরেই চিৎকার করে উঠলেন। আমরা দৌড়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমাদের সকলের রক্ত হিম হয়ে গেল। আলমারির দরজা হালকা খোলা। তালাটা নিচে পড়ে আছে। আর পুতুলটা আবারও ড্রয়িংরুমের টেবিলে আগের জায়গায়, ঠিক যেন আমাদের অপেক্ষায়, বসে আছে!

​তার বাদামি চুল এখন হাঁটু পর্যন্ত লম্বা, ঘন আর তৈলাক্ত লাগছিল।

​কারা রেখেছে? আলমারির তালা ভাঙা ছিল না শুধু খোলা ছিল।

​বাবার কণ্ঠ শুকিয়ে গেল, “তোমরা কেউ বের করোনি?”মীম তো কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি তো ওর কাছে যাইওনি! ওটা তালাবন্দী ছিল!”

​আমি পুতুলটার নীল চোখে তাকানোর সাহস পেলাম না। তবে আমার মনে হচ্ছিল ওটা শান্তভাবে বসে মিটিমিটি হাসছে। যেন বলছে, ‘তোমরা আমাকে বন্ধ করতে পারবে না।’ সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত হলো এটা রাখব না। এটা অভিশাপ এটা আমাদের ঘরে অশান্তি আনছে।

​রাতের খাবারের পর সিদ্ধান্ত হলো এটা রাখব না। বাড়ির পেছনের সেই কুখ্যাত কালা-বনেই ফেলে আসব। গ্রামের মানুষের অনেকেই বলত যেটা “খারাপ” হয়, ওখানে রেখে দিলে আর ঘরে ফিরে আসে না। বনটা নাকি সেই খারাপ জিনিসটাকে আটকে রাখে।

​বাবা, আমি আর চাচা পুতুলটা একটা পুরনো খবরের কাগজে মুড়িয়ে জঙ্গলের মুখে গেলাম। রাতটা ছিল চাঁদহীন। আকাশে একটাও তারা নেই কেবল জমাট কালো অন্ধকার। হাওয়া একেবারেই নেই, চারদিক নিস্তব্ধ।

​কিন্তু পুতুলটার চুল নিজের মতো দুলছিল অদৃশ্য হাওয়ার বিপরীত দিকে। যেন ভেতর থেকে কোনো শক্তি সেগুলোকে নাচাচ্ছে।

​চাচা ফিসফিস করে বললেন, “তাড়াতাড়ি ফেলে দে। দেরি করিস না। আমার শরীর খারাপ লাগছে।”

​ভয়ে আমার হাত কাঁপছিল। আমরা ওটা ঝোপের ভেতরে ছুঁড়ে দিলাম। এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম যে এটি যেন সহজে খুঁজে না পাওয়া যায়। বাবা নিষেধ করলেন, “পেছনে তাকাতে নেই। সোজা বাড়ির দিকে চল।”

​তবে আমি শেষ মুহূর্তে খুব হালকা একটা শব্দ শুনলাম,

শব্দটা মাটিতে কোনো শক্ত কিছু পড়ার মতো নয়, বরং যেন কেউ খুব ধীরে আঙুল দিয়ে মাটিতে টোকা দিচ্ছে অথবা কোনো ছোট নুড়ি সরিয়ে সরিয়ে এগিয়ে আসছে। আমরা আর দাঁড়ালাম না, প্রায় ছুটে বাড়ির দিকে ফিরে এলাম।

​রাত তখন ২টা ৪৩। এই সময়টা আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মিনিট ধরে মনে রাখব। বাইরের আবহাওয়া অদ্ভুত নীরব। যেন প্রকৃতিও শ্বাস চেপে রেখেছে।

​হঠাৎ ​কেউ আমাদের মূল দরজায় ধারালো কিছু দিয়েআঁচড় কাটছে। প্রথমে মৃদু এরপর বেশ জোরের সঙ্গে। শব্দটা শুনে মনে হচ্ছিল, কাঠ যেন আতঙ্কে চিৎকার করছে।

​মা চিৎকার করে উঠলেন, “ওরে বাবা গো!”

বাবা দরজার দিকে দৌড়ালেন, “কে ওখানে? কে?”

​কিন্তু বাইরে থেকে কোনো জবাব এল না। শব্দ থামল।

​আমি দূর থেকে দেখলাম দরজার কাঠের ওপর তিনটা লম্বা গভীর খোঁচা। মানুষের নখের চেয়ে অন্তত তিনগুণ দীর্ঘ, কোনো বন্য পশুর নখের মতো।

​বাইরে থেকে আবার শব্দ

টক… টক… টক…

খালি পায়ের হাঁটার মতো কিন্তু অস্বাভাবিক ধীর, ভারী আর ভয়ংকর। এ যেন হিসেব করে ফেলা প্রতিটি পদক্ষেপ।

​মীম আমার হাত আঁকড়ে ধরল ভয়ে তার শরীর কাঁপছে, “দাদাভাই, এটা… এটা ফিরে এসেছে! চুলওয়ালা পুতুলটা…”

​দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকছিল। বরফের মতো ঠাণ্ডা, যা ঘরের উষ্ণতাকে এক মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিল। আমি স্পষ্ট দেখলাম ফাঁকের নিচে কিছু নড়ছে… একটা বাদামি ঘন গোছা। যেন লম্বা চুলের একটি স্রোত দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে আসার চেষ্টা করছে। এটা আর নিছক পুতুল নয়, এটা একটা অশুভ শক্তি।

​ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে মা তাঁর ঘরের দিকে গেলেন এবং একটা কোরআন শরীফ হাতে নিলেন। চাচা, যিনি আমাদের সাথে ছিলেন, তিনি কাঁপতে কাঁপতে নিজেকে সামলে নিয়ে উঁচু গলায় আজান দিতে শুরু করলেন।

​আল্লাহু আকবার…​আজানের প্রথম শব্দ বের হতেই,

​সেই সমস্ত শব্দ…সেই আঁচড়… সেই ধীর, ভারী হাঁটা…

​সব চুপ। একেবারে নিস্তব্ধ। যেন কেউ মাঝপথে স্তব্ধ হয়ে গেল।

​আজানের পবিত্র ধ্বনি যখন ঘর ভরাতে ভরাতে উঁচু হতে লাগল, তখন মনে হচ্ছিল, যে-ই আসছিল তা যেন ধীরে ধীরে পেছনের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। দরজার নিচের ফাঁক থেকে সেই চুলের গোছা দ্রুত গুটিয়ে গেল। এখন শুধু নিস্তব্ধতা, আর আমাদের কম্পিত হৃদয়ের শব্দ।

​সূর্য ওঠার পর যখন দরজা খুলে বাইরে তাকালাম, তখন আমাদের বুক কেঁপে উঠল।

​মাটিতে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতা আর ধুলো। আর দরজার গায়ে গতকাল রাতের তিনটি ভয়ংকর লম্বা আঁচড়। ​তার নিচে ​এক গোছা বাদামি চুল। মানুষের মতো নয় কিন্তু পুতুলটার চুলের মতো, লম্বা ঘন স্যাঁতসেঁতে। যেন তা মাটি থেকে রস টেনে বেড়ে উঠেছে।

​মা কাপড় দিয়ে তুলে সেই চুলগুলো দূরে মাটিচাপা দিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন আর কখনো ওটার কথা তুলবেন না।

​পুতুলটা আর কখনো পাওয়া যায়নি। কেউ দেখেনি। কেউ শুনেনি। কালা-বনে ওটা কোথায় হারিয়ে গেল, তা আমরা আর জানতে চাইনি। কিন্তু সেই রাতের পর আমাদের বাড়িতে আর কোনো অস্বাভাবিক ঘটেনি।

​মীম আজ পর্যন্ত কোনো পুতুল কেনেনি।

​আর আমি,

​আজও যখন রাতের নীরবতায় বাতাস দুলতে দেখি, তখন মনে হয় কোথাও… কালা-বনের কোনো ঘন ঝোপের ভেতর… ​ওটা এখনো বসে আছে।

তার লম্বা চুলে হাওয়া খেলছে,

আর অপেক্ষা করছে,

কেউ আবার তাকে বাড়ি নিয়ে যাক।

তুমি কি এমন পুতুল কখনো দেখেছ?

কমেন্টে লিখো, আর শেয়ার করে রাখো,

কারণ এমন ঘটনা যে কারও বাড়িতে ঘটতে পারে…

*(ঘটনাটি ২০১২ সালের দিকে কিছু স্থানীয় পত্রিকায় বা দুর্বল সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। সত্যিকার প্রমাণ নেই, তবে অনেকেই বিশ্বাস করে এটি কল্পনা নয়, সম্ভবত ঘটেছিল।)*

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!