
চিন্টুটার সব সময়ে সব কিছুতে ওস্তাদি। অসহ্য লাগে একেক সময়ে। কিছু একটা বলতে যাও অমনি বলবে, “ওঃ এই ব্যাপার। এতো জানা কথা। এতো এই জন্যে হয়েছে। তোরা এটাও জানিস না!” এমনভাবে বলবে যেন সে একেবারে সবজান্তা। টিটো, ঋষি, পাবলো এ জন্যে মহা খাপ্পা। কিন্তু চিন্টুটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারে না। কি করে যেন চিন্টুটার ওস্তাদিই কাজে লেগে যায় আর বড়োরা চিন্টুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, “দেখ তো কত কিছু পারে, চোখ কাল কত খোলা,” ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাল্লাগে খালি এসব শুনতে? এই ক’দিন আগে কি হল। বিকেলে টিটোরা মাঠে খেলছিল।
এমন সময় সেখানে তিনজন বিদেশী তরুণ তরুণী এলেন। টিটোদের শহরে এক বিখ্যাত ইনস্টিটিউট আছে, সেখানে বাইরের দেশ থেকেও অনেকে আসেন কাজ করতে, কিছুদিন থাকেন, আবার চলেও যান। নিজেদের শহরে তাই ভিনদেশী লোক দেখতে যে টিটোরা একেবারে অনভ্যস্ত তা মোটেই নয়। যাই হোক তাঁরা হেঁটে যাচ্ছিলেন, রাস্তা গণ্ডগোল করে ফেলেছেন। টিটোদের খেলতে দেখে একজন এসে একটা দোকানের নাম করে রাস্তাটা জানতে চাইলেন। ইংলিশেই। দোকানটা টিটোরা খুব ভালোই চেনে, ইংলিশে যে ওরা কথা বলতে পারে না তাও নয়। ঋষি তো বলতেই যাচ্ছিল কিন্তু চিন্টু ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে দিল। ঋষি একটু গুডি গুডি বয়, বেচারা চুপই করে গেল, চিন্টুর ওপর দিয়ে কিছুই বলতে পারল না। আর চিন্টু বললও যা কায়দা করে! বাপ রে! শুধু কি তাই? ওনাদের “থ্যাংক ইউ” এর উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে এমন করে “মাই প্লেজার” বলল যে সোনালি চুলের দিদিটা ওর গালই টিপে দিলেন। এতেও ক্ষান্ত নন শ্রীমান! ওনারা চলে গেলে বন্ধুদের বোঝাতে বসল কিভাবে কথা বলা উচিত। “এমনভাবে বলতে হয় যাতে ওদের মনেই না হয় যে ওরা অন্য দেশে রয়েছে। কথাবার্তায় সেরকম একটা ওয়ার্মথ ফোটান উচিত।
বুঝলি? এতে ওরা অ্যাট ইজ ফিল করে। আর কক্ষণো চোখ গোল গোল করে দেখবি না, ভেরি ব্যাড।” যদিও কেউই চোখ গোল গোল করে দেখছিল না। কিন্তু চিন্টুর স্বভাবই ওই, হয় ওস্তাদি করবে নয় জ্ঞান দেবে। জিনির গল্পও কি টিটো বন্ধুদের করতে পারল? টিটোদের পাশের বাড়িতে একটা তাগড়াই অ্যালসেশিয়ান আছে, জিনি। জিনির রকমসকম বেশ অদ্ভুত। টিটোর খুব মজা লাগে। জিনি যে কাকে দেখে চেঁচাবে আর কাকে দেখে টুঁ আওয়াজটা করবে না, ঠ্যাং ছড়িয়ে শুধু বসে বসে দেখবে বলা মুশকিল। রোজ সকালে ভ্যান নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে আবর্জনা নিতে যে আসে তাকে দেখে পরিত্রাহি চিৎকার করে জিনি। রোজ তাকে দেখছে, অথচ রোজই করে। শুধু যে জিনিদের বাড়ি থেকে চলে গেলেই জিনি চুপ করে তা কিন্তু নয়, যতক্ষণ না টিটোদের বাড়ি থেকেও যাচ্ছে ততক্ষণ জিনি চেঁচিয়ে যাবে পাগলের মতো। আর যাকে জিনি একদম সহ্য করতে পারে না সে হল গরু। গরু দেখলে জিনি এমন চেঁচায় মনে হয় কি না কি হয়েছে। টিটোর সঙ্গে অবশ্য জিনির বেশ ভাব আছে। সেদিন টিটো ওদের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, দেখে কতগুলো রাস্তার কুকুর বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। “এই রে, কুকুরগুলো এবার সামনেটা নোংরা করবে,” টিটো ভাবল। কিন্তু দোতলা থেকে হ্যাট হ্যাট করলে কি আর যায়! জিনি কাছাকাছিই ছিল। পাঁচিলের ওপর থেকে একবার মুখ তুলে দেখল টিটোকে, তারপর গেটের কাছে গিয়ে বীর বিক্রমে তারস্বরে ডাকতে শুরু করল। কুকুরগুলো লেজ গুটিয়ে পালাল। টিটো মুগ্ধ।
জিনি আবার মুখ তুলে টিটোর দিকে তাকাল, ভাবখানা যেন, “কি তাড়িয়ে দিলাম তো!” এই গল্পটাই টিটো সেদিন বন্ধুদের করছিল, চিন্টু থামিয়ে দিল, “কুকুররা কত কিছু বোঝে তা কি তুই জানিস না টিটো? জিনি দেখেছে যে তুই ওই রাস্তার কুকুরগুলোকে তাড়াতে চেষ্টা করছিস, ও বুঝে গেছে ওকে কি করতে হবে। ইটস সিম্পল। ভালো কুকুরমাত্রই এরকম হয়, জিনি কোনো স্পেশাল কেস নয় বুঝলি?” জিনির আরো অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার টিটো জানে, বলতও কিন্তু চিন্টুর কথাতে এত বিরক্ত হল যে চুপ করে গেল, আর কিছুই বলল না। এদিকে সরস্বতী পুজো এসে যাচ্ছে। এবার টিটোদের ওপর অনেক দায়িত্ব। মুশকিল হয়েছে চিন্টুকে নিয়ে। চিন্টু ধারেকাছেও থাকলে অভিরূপ আলপনা দেবে না পরিষ্কার বলে দিয়েছে। অভিরূপ টিটোদের এক ক্লাস নীচে পড়ে, দারুণ আঁকে। অনেক প্রাইজ পেয়েছে অঙ্কন প্রতিযোগিতায়। গতবার চিন্টুর ওস্তাদির জন্যেই অভিরূপের গোঁসা। গত বছর পুজোর আগের দিনের ঘটনা। স্কুলের সবাই ব্যস্ত পুজোর ব্যবস্থাপনায়।
ঠাকুর এসে গেছে, অভিরূপ আলপনা দিচ্ছে। চিন্টু তার কাছেই বসে একটা মাটির সরার ওপর চিত্রাঙ্কনে ব্যস্ত। কাজ যত না করছে “এখানটা একটু ব্যাঁকা হয়েছে,” “ওখানটা একটু ঠিক কর,” এসব বলে অভিরূপের ওপর ওস্তাদি করছে। টিটো কাছেই ছিল, কাগজের শেকলগুলো লম্বা করে রাখছিল। হঠাৎ এই শেকল ঝোলান নিয়ে ক্লাস নাইনের দুজন দাদার মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেল। একজন বলে এখান থেকে ওখান অবধি ঝোলাতে হবে তো আরেকজন তাতে রাজী হয় না, অন্যভাবে ঝোলাতে বলে। সবাই কাজ থামিয়ে তাই দেখছে। কোনটাতে শোভাবর্ধন বেশী হবে এই জোর তক্কাতক্কি চলছে এমন সময় চিন্টু চেঁচিয়ে উঠল, “এই রে রঙ পড়ে গেছে, রঙ গড়িয়ে যাচ্ছে!” ঝগড়া থেমে গেল, সবাই মেঝের দিকে তাকাল, একটা ভাঁড়ে লাল রঙ গোলা ছিল, সেটা পড়ে গেছে। আঁকার স্যারও ছুটে এলেন চেঁচামিচি শুনে। এদিকে টিটো দেখেছে ভাঁড়টা কি করে পড়ল। চিন্টু ওস্তাদেরই কীর্তি ওটি। অন্য দিকে তাকিয়ে তুলি রাখতে গয়ে হাতের ধাক্কায় ফেলেছে। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। টিটো বলতে গেল, “ওটা তো তুইই ফেলেছিস,” কিন্তু বলতে পারলে তো, চিন্টু ওকে বলতে দিলে তো! চিন্টু ওকে কথা শেষই করতে দিল না, মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “কে ফেলেছে সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে সব ঠিকঠাক ম্যানেজ করা। সময় বেশী নেই, ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝ।” “খালি ঝগড়া তোমাদের। আর এ এই করেছে আর ও ওই করেছে! মিলেমিশে কাজ করতে পারো না?” স্যারও ধমকে উঠলেন। চিন্টু গম্ভীর মুখে আলপনা নিরীক্ষণ করছে। স্যার শেকল ঝোলানোর সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত। অভিরূপ কি একটা যেন বলল আস্তে আস্তে। ঠিক তারপরেই চিন্টু স্যারের কাছে এসে বলল, “স্যার একটা জিনিস মাথায় এল। দেখুন তো কেমন হবে ব্যাপারটা। এই আলপনাটার চারদিকে একটা লাল বর্ডার দিয়ে দেওয়া যাক, তার পাশে ছোটো ছোটো ফুল বা ওই জাতীয় কিছু। কি রে অভিরূপ পারবি না?” অভিরূপ তো হাঁ! বুদ্ধিটা তো ওরই! স্যার শুনে বললেন, “বাঃ দারুণ আইডিয়া! অভিরূপ চটপট করে ফেলো।” চিন্টু বিজয়গর্বে সবার দিকে তাকায়। অভিরূপ বেচারা মন খারাপ করে পরে বলেছিল, “বললাম আমি আর সবাই জানল ওটা চিন্টুদার আইডিয়া।” আর চিন্টু? সবাইকে বলে বেড়াল, “শুধু আঁকতে জানলেই হল? ঠিক সময়ে একটা প্রপার গাইডেন্স দরকার, ঠিক সমইয়ে মাইণ্ড অ্যাপ্লাই করতে হয়।
আমি ঠিক সেটাই করেছি, নাহলে একটা ম্যাসাকার হত।” অতএব চিন্টুর জয়জয়কার। এবার তাই টিটোদের চিন্টুকেও সামলাতে হবে, অভিরূপকেও রাজী করাতে হবে। এদিকে চিন্টু ওস্তাদি করতে ছাড়বে না। স্যারদের বলে রেখেছে যে ও সবদিকে খেয়াল রাখবে। বড়োরাও যে কেন এত চিন্টুকে পছন্দ করেন তা তাঁরাই জানেন! সবচেয়ে ঝামেলার কাজ ফুল জোগাড় করা। সরস্বতী পুজোর আগের রাত ফুল চুরির জন্যে কুখ্যাত। দলে দলে ছেলেপিলে বেরোয় সে রাতে সব বাড়ির বাগান থেকে ফুল তুলতে। গত বছর এ নিয়ে কয়েকটা পাড়ায় খুব ঝামেলা হয়েছে। থানা পুলিশ অবধি গড়িয়েছিল ব্যাপার। কাজেই এবার কোনো ছেলেই রাতে বেরোবে না ফুল তুলতে। এত ফুলের জোগাড় হবে কি করে? “এই চুরি চুরি করেই বাজে ব্যাপার হয়েছে,” বলল চিন্টু, “এসব না করে অ্যাপ্রোচটাই পালটাতে হবে।” “তোর মতলবটা কি?” পাবলো জিজ্ঞেস করল। “চিন্তা করিস না, সব ম্যানেজ করে নেব। ফুলের দায়িত্ব আমার।” “তোর? তুই পুরো দায়িত্ব নিচ্ছিস তো?” ঋষি বলে। “না নিয়ে আর উপায় কি বল?” চিন্টু যেন কত নিরুপায়, “পুজোটা তো ঠিকঠাক ওঠাতে হবে আর স্কুলেরও একটা প্রেস্টিজ আছে। কত দিক যে আমাকে সামলাতে হবে!” “সত্যি তোর ওপর বড্ড চাপ হয়ে যাচ্ছে চিন্টু। তুই এক কাজ কর। ফুলটা তুই সামলা, ডেকরেশনটা আমরা দেখে নেব। ওটা নিয়ে তোকে আর ভাবতে হবে না,” বলল টিটো। এই সুযোগ, যে করে হোক চিন্টুকে দূরে রাখতে হবে, নাহলে অভিরূপ আঁকবেই না। এমনকি এও বলে রেখেছে যে শরীর খারাপের ছুতোয় স্কুলেই আসবে না, স্যারেররাও তাহলে কিছু করতে পারবেন না। আর অভিরূপ না আঁকলে আলপনাটা প্রত্যেক বছরের মতো ফাটাফাটি হবে না, তাতেই বরং স্কুলের প্রেস্টিজ ডাউন হওয়ার প্রবল সম্ভবনা। কিন্তু চিন্টু সেটা বুঝলে তো! যাক গে, না বুঝুক, যখন অভিরূপ আলপনা দেবে তখন ও ওখানে না থাকলেই হল। টিটোর ইঙ্গিত ঋষি ঠিক ধরতে পারল, “টিটো ঠিক বলেছে রে চিন্টু। তুই ফুলের ব্যাপারটা দেখ। সঙ্গে খেতে বসার অ্যারেঞ্জমেন্টাও দেখ। মনে নেই গতবার তুই ডেকরেশনে ব্যস্ত ছিলিস, ওদিকে যাস নি, কি যেন গোলমাল হয়েছিল। টেবিলগুলো নাকি সব সোজা করে রাখা হয় নি। আমরা ততক্ষণ এদিকটা দেখি, হয়ে গেলে ফাইনালি তো তুই দেখবিই।” চিন্টুও সন্তুষ্ট। সত্যি শেষ অবধি ও না দেখলে চলে না, ওর বন্ধুরাও বোঝে সেটা। “কিন্তু চিন্টু তুই কি অ্যাপ্রোচে ফুল জোগাড় করবি বললি নাতো?” পাবলো জিজ্ঞেস করল। “শোন আমাদের পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আমরা রিকোয়েস্ট করব কিছু ফুল আমাদের দিতে। আমরা তো আর চুরি করছি না, রিকোয়েস্ট করছি, দেখবি সবাই দেবে,” বলল চিন্টু। “রিকোয়েস্ট করলেই বড়ো বড়ো গাঁদাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে আমাদের দিয়ে দেবে?” পাবলোর বিশ্বাস হয় না। “সেটা তোর বলার ভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে,” চিন্টু বিজ্ঞের মতো বলে, “তুই ভালোভাবে বলে কনভিন্স করাতে পারলে হবে, নাহলে হয়। ওই জন্যেই তো বলছি আমার ওপর ছেড়ে দে, তোদের দ্বারা এসব হবে না। তোরা শুধু আমার সঙ্গে যাবি।” না গিয়ে কি আর উপায় আছে! সবাই বেরোল চিন্টুর সঙ্গে। তবে চিন্টুর বাতলান উপায়ে ফল খুব খারাপ হল না কিন্তু। অনেকেই রাজী হল ফুল দিতে। বাড়ির ভেতর ঢুকে কেউ নির্বিচারে ফুল ছিঁড়বে না, গাছ নষ্ট করবে না, এর জন্যেই বোধহয় রাজী হল। তাছাড়া এটাও বোঝা গেল সবাই মোটামুটি সে রাতটা জাগবে, পাহারা দেবে। কাউকে ফুল চুরি করতে দেবে না। কথা হল ভোর রাতে চিন্টুরা ফুল সংগ্রহে বেরোবে। যাঁরা ফুল দেবেন বলেছেন তাঁরা আগেই ফুল তুলে রাখবেন, চিন্টুরা গেলে দিয়ে দেবেন। শীতকাল, ওটুকুতে ফুল শুকোবে না। আর ভোরবেলাতেই তো সব ফুল স্কুলে দিয়েও দিয়ে হবে। টিটোর পাশের বাড়ি ঘোষজেঠুদের বাড়িও যাওয়া হল। জিনি লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এল। চিন্টু জিনির গায়ে মাথায় হাতটাত বুলিয়ে দুমিনিটের মধ্যে তাকে বেশ কব্জা করে ফেলল। জিনিও বেশ লেজ নেড়ে নেড়ে চিন্টুর পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগল। টিটোর গা পিত্তি জ্বলে গেল, “জিনি তুইও!” “আমরা রাত টাত জাগিনা, অত ভোরে উঠতেও পারব না। জিনিই পাহারা দেয়। তোমরা ফুল নেবে কখন?” ঘোষজেঠু জানতে চাইলেন। “আপনি ফুল তুলে একটা পলিব্যাগে ভরে বাইরে রেখে দেবেন, আমি এসে নিয়ে যাব,” এবারও চিন্টু বুদ্ধি বাতলাল। “বাইরে?” টিটো আঁতকে উঠল, “না না বাইরে রাখলে কেউ নিয়ে নেবে। সরস্বতী পুজোর আগের রাতে প্যাকেট ভর্তি গাঁদা ফুল পেলে কেউ ছাড়ে নাকি!” তা সত্যি! তবে উপায়? আবার চিন্টুই বলল, “প্যাকেট গেটেই ঝুলিয়ে রাখবেন, ভেতরের দিকে। জিনি তো গেটের সামনেই থাকে। কেউ নিতে পারবে না।” “কিন্তু তুই নিবি কি করে?” ঋষি জিজ্ঞেস করল। “আরে জিনি আমাকে কিচ্ছু বলবে না। দেখছিস না কেমন ভাব হয়ে গেছে আমার সঙ্গে, তাই না জিনি?” চিন্টু জিনির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিয়ে টিটোর দিকে তাকায়। টিটো যেন কিছু বুঝেও বোঝে না। সব ঠিকঠাক করে যে যার মতো বাড়ি চলে গেল। সবার এলাকাও ভাগ করা হয়ে গেছে। টিটোর পাড়া চিন্টুর ভাগে। টিটোরও বেড়োনোর কথা ছিল কিন্তু বিকেল থেকেই টিটো বেশ কাশছে। “দেখছিস তো আমার অবস্থা। ভোর রাতে বেরোতে চাইলে মা আর স্কুলেও যেতে দেবে না। তোরা এটা ম্যানেজ করে নে, আমি তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌঁছে যাব।” সবাই অ্যালার্ম দিয়ে শুয়েছিল। ভোর রাতে উঠে সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার, টুপি, মোজা – এসবে নিজেদের মুড়ে চিন্টু আর তার বন্ধুরা বেরোল ফুল সংগ্রহে যে যার এলাকায়। কোনো ঝামেলাও হচ্ছে না, অনেকেই দিচ্ছে, যার যেমন ইচ্ছে। তা জড়ো করা ফুলের পরিমাণ মন্দ না। চিন্টুর এই বুদ্ধিটা অন্তত খারাপ ছিল না, মানতেই হবে। চিন্টুও ঘুরতে ঘুরতে এসেছে জিনিদের বাড়ি। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। চিন্টুর গায়ে জব্বর একটা জ্যাকেট, মাথায় কালো মাঙ্কি ক্যাপ। মাঙ্কি ক্যাপে এমনিতে চিন্টুর প্রবল অনীহা কিন্তু আজকে আর না পরে উপায় ছিল না। ওই তো গাঁদা ফুল ভর্তি প্যাকেট ঝুলছে। চিন্টু মনের আনন্দে শিস দিতে দিতে প্যাকেট নেবার জন্যে গেটের মধ্যে যেই হাত ঢুকিয়েছে, কোথায় ছিল জিনি ঘাপটি মেরে কে জানে, চিন্টুর হাতের দুপাশে দুথাবা রেখে হাতটা দিল আটকে। সেই সঙ্গে প্রবল চিৎকার। আশেপাশের বাড়িতে কেউ কেউ জেগে ছিল, তারা কে কে করে চেঁচিয়ে উঠল।
চারদিকের অন্ধকার, কে কে চিৎকার, জিনির ডাক সব মিলিয়ে চিন্টুর অবস্থা তখন কাহিল। হাতটা সরিয়েও আনতে পারছে না, যদি কামড়ে দেয়! একেবারে যাকে বলে নট নড়নচড়ন! সব সাহস, সব ওস্তাদি কোথায় উড়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় কোনো রকম “বাঁচাও বাঁচাও” বলে যাচ্ছে, তাও বেশী জোরে নয়। যাই হোক ঘোষজেঠুরাও বেরিয়ে এসেছেন, জিনিও সরে গেল। সরে যেতেই চিন্টু ধপ করে গেটের বাইরেই বসে পড়ল। এই শীতেও দরদর করে ঘামছে। টিটো দোতলায় ওর ঘরের জানলাটা আস্তে করে বন্ধ করে নেমে এল। বাইরেও এল। “ঈশ চিন্টু, খুব ভয় পেয়েছিস দেখছি। আহা রে কি ঘেমে গেছিস,” নরম গলায় বলে টিটো, তারপর কি দেখে যেন খুব অবাক হয়ে বলে, “এ বাবা তুই এই মাঙ্কি ক্যাপটা পরে জিনির সামনে এসেছিলিস নাকি?” একে এই অবস্থা, তার ওপর টিটোর এই কথা, চিন্টু খিঁচিয়ে ওঠে, “এই ঠাণ্ডায় টুপি পরে বেরোব না তো কি পরে বেরোব?” “আরে টুপি পরা কাউকে দেখলেই জিনি খেপে যায়। জিনি একদম টুপি পছন্দ করে না।” “কি?” এবার চিন্টু অবাক। “হ্যাঁ টিটো ঠিকই বলেছে। চেনা লোককেও টুপি পরতে দেখলে রেগে যায়। এমন কি আমাদেরও,” বললেন ঘোষজেঠু। “এ কি আজব ব্যাপার রে বাবা! এরকম কুকুর আবার হয় নাকি? কুকুরদের তো ঘ্রাণ শক্তি প্রবল, ওরা তো তার ওপরেই নির্ভর। টুপির সঙ্গে কি সম্পর্ক রে বাবা! কিন্তু টিটো তো এটা বলে নি। ও তো জানত দেখছি। আর কাশছে টাশছেও তো না দেখছি,” চিন্টু ভাবে। টিটোও বোধহয় সেটা বুঝতে পারে, তাই বলে, “জিনির সঙ্গে তোর তো বেশ ভাব হয়ে গেছিল। আমি ভেবেছি জিনি তোকে নিশ্চয়ই কিছু করবে না। তাছাড়া তুই কত কিছু জানিস। আমার আর এটার কথা মাথাতেই ছিল না।”
চিন্টু কটমট করে তাকায়। “যাক গে এখন ওসব ছাড়। এমন কিছুই হয় নি। তুই যা বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম কর। সেই কখন থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। দে, ফুলের প্যাকেটগুলো দে, আমি স্কুলে নিয়ে যাব, যা তুই বাড়ি যা,” টিটো প্যাকেটগুলো নিয়ে নেয়। চিন্টুই বা আর কি করে। বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়। এই ক’মিনিটের ভয়ই যা কাবু করল! বেশ বুঝতে পারছে আজ স্কুলে এটা নিয়ে কিরকম হাসাহাসি হবে। পেছন না ফিরলেও টিটোর হাসি হাসি মুখটা দিব্যি দেখতে পেল চিন্টু।