
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো- আমাদের সমাজে অনেকেই আছে যারা নিজেদের বীরত্বের কথা মানুষের কাছে বলাবলি করে খুব মজা পায়। কিন্তু বাস্তবে তারা তেমন সাহসী নয়। এ ধরনের মানুষ প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর মাঝেমধ্যেই বিপাকে পড়ে যায়। তবে বুদ্ধি-বিবেক হারানোর ফলে এরা একই ধরনের কাজ অর্থাৎ নিজের বীরত্বের কথা বারবার বলে বেড়ায়। এসব মানুষ নিয়ে মাওলানা রুমী তার মসনবী গ্রন্থে একটি মজার গল্প লিখেছেন। আমরা ওই গল্পটি প্রচার করেছি। গল্পটি নিম্নরূপ:
প্রাচীনকালে অজ্ঞ, মুর্খ ও বোকা লোকেরা সমাজে বাহাদুরী দেখানো ও নিজের বীরত্ব প্রকাশের জন্য নিজেদের শরীরের চামড়ার ওপর নানা ধরনের চিত্র আঁকতো। যারা এসব চিত্র এঁকে দিতো ফারসী ভাষায় তাদেরকে ‘দাল্লাক’ বলা হয়। দাল্লাকরা মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশে পশু পাখি, ফুল, সূর্য বা অন্য কিছু অংকন করে দিতো। তাদেরকে শরীরের যেখানে চিত্র আকতে বলা হতো প্রথমে সেখানে তারা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিতো। তারপর সেখানে কালি দিয়ে চিত্র আঁকতো। এরপর সুঁই দিয়ে কালি দিয়ে আঁকা ছবির ওপর ফুটো বা ছিদ্র করা হতো। ছিদ্র করা শেষ হলে বিশেষ ধরনের লতাপাতার রস দিয়ে সেখানে মালিশ করা হতো। এরপর যখন চামড়া বেদনা জলে যেত তখন সুঁই দিয়ে ছিদ্র করা জখমের ওপর এমন এক পাকা কালি লাগানো হতো যা শরীরের ঐ জায়গায় চিরদিনের জন্য লেগে থাকে। মুর্খ লোকেরা এভাবে চিত্র একে সমাজে গর্বে করে বেড়াতো।
তো একবার এক কুস্তিগীর এলো এক চিত্রকরের কাছে তার শরীরের সিংহের ছবি আঁকতে। কুস্তিগীর যুবকটি ছিল অত্যন্ত ভীরু প্রকৃতির। সিংহের ছবি আঁকা নিয়ে তাদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা হয় তা ছিল এ রকম-
কুস্তিগীর : এই যে দাল্লাক চাচা! আমার গায়ে একটা ছবি এঁকে দিতে পারবে?
চিত্রকর : ছবি আঁকতে চাও? বেশ ভাল কথা। তা কিসের চিত্র আঁকতে চাও তুমি?
কুস্তিগীর : তুমি তো জানো আমি একজন কুস্তিগীর পাহলোয়ান। সিংহের মতো শক্তি আমার গায়ে। তাই সিংহের ছবিই এঁকে দাও।
চিত্রকর : সাব্বাস পাহলোয়ান বেটা, সাব্বাস ! তোমার শরীরে সিংহের ছবিই মানাবে ভাল । তা শরীরের কোন জায়গায় সিংহের ছবি আঁকাতে চাও তুমি?
কুস্তিগীর : আমার ডান হাতের পেশীতে আঁকতে চাই।
চিত্রকর : ঠিকাছে, তুমি বাহু খুলে এখানে বস। আমি এক্ষুণি সিংহের ছবি আঁকা শুরু করছি।
কুস্তিগীর যুবকটি জামা খুলে বসার পর চিত্রকর তার কাজ শুরু করলো। প্রথমে পাহলোয়ানের হাত গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নরম করলো এবং সূঁইটি ফুটন্ত পানিতে ডুবিয়ে দিলো। এরপর প্রথমে কলম ও কালি দিয়ে পাহলোয়ানের বাহুতে সিংহের পুরো একটি ছবি সুন্দর করে আঁকলো। এরপর হাত দিলো আসল কাজে। দাল্লাক যেইমাত্র তার সুঁই পাহলোয়ানের বাহুতে প্রথম ফুটোটি করলো তখন সে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো:
কুস্তিগীর : ওরে বাবারে, মরে গেলাম! আমার হাত একেবারে অবশ হয়ে গেল রে!! ওই বেটা দাল্লাক কি করছিস তুই ?
চিত্রকর : রাগ কর ক্যান বাছা ! তোমার কথা মতোই তো কাজ করছি। তুমি কি আমাকে সিংহ আঁকতে বলোনি?
কুস্তিগীর : তাতো বলেছি। এখন বল, কোথা থেকে শুরু করেছো?
চিত্রকর : সিংহের লেজ থেকে শুরু করেছি। লেহের ঠিক শেষ মাথাতে সুঁই বসিয়েছি।
কুস্তিগীর : বেশ হয়েছে। এখন লেজ বাদ দিয়ে মাথা বা শরীরের অন্য কোথাও থেকে শুরু কর। আমার সিংহ লেজ ছাড়াই হবে। লোকজন কিছু বললে বলবো, এটা লেজকাটা সিংহ!
চিত্রকর : ঠিকাছে, আমার কি বাপু । তোমার ইচ্ছে না থাকলে লেজ ছাড়াই আঁকবো।
এবার দাল্লাক সিংহের লেজ ছেড়ে মাথা থেকে শুরু করলো। সে যখনি সিংহের কেশর ও ঘাড় বরাবর সুঁই ঢুকালো অমনি পাহলোয়ানের গলা ফাটা চিৎকারের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।
কুস্তিগীর : বাবাগো, মাগো, ব্যথায় একবোরে মরে গেলাম রে ! ওই বেটা দাল্লাক করছিস কি শুনি?
চিত্রকর : আরে বাপু এমন করছো কেন? সিংহের ছবিই তো আঁকছি। একটু ধৈর্য্য ধরো, কতক্ষণের ব্যাপার!
কুস্তিগীর : আমাকে ধৈর্য্য ধরার কথা না বলে এবার বল্ সিংহের কোন অংশ আঁকছিস?
চিত্রকর : ঘাড়ের ঠিক ওপরে কেশর আঁকছি।
কুস্তিগীর : আরে বাপু! সিংহের গর্দান আর কেশর এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল? আমার সিংহের কেশর আঁকার দরকার নেই। ওসব বাদ দে। শরীরটা এঁকে দিলেই যথেষ্ট।
চিত্রকর : ঠিক আছো, তুমি যখন সহ্য করতে পারছো না, তখন কেশরও না হয় বাদ দিলাম।
এখন দাল্লাক ভাবতে লাগলো কী করা যায়! লেজ থেকেও হলো না, মাথার দিক থেকেও হলো না। তাই সে পা থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল। এরপর সিংহের পায়ের নকশার ওপর সুই খাড়া করে পাহলোয়ানের বাহতে বসিয়ে দিল। আর অমনিই পাহলোয়ান ‘মাগো, মাগো’ বলে চিৎকার শুরু করলো। ব্যথায় তার সারা শরীর যেন কাঁপছে। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে ওঠে জিজ্ঞেস করলো:
কুস্তিগীর : আবার কোন জায়গায় সুই ঢুকিয়েছিস?
চিত্রকর : এটা সিংহের পায়ের থাবা।
কুস্তিগীর : আরে বাবা তুই তো আজব চিত্রকর? এতোসব খুঁটিনাটি বিষয়ে ওস্তাদি দেখাচ্ছিস কেন? সিংহের পায়ের থাবা আর নখ তো কারো চোখেই পড়ে না। আমি কি তোকে আমার শরীরে চীনের চিত্রশালা বানাতে বলেছি? আরে বাপু! শুধু সিংহের একটা সুরত হলেই আমার চলবে। সিংহের থাবা-টাবা দরকার নেই। এমন কিছু কর্ যাতে ব্যথা কম হয় আর আমি তাড়াতাড়ি বিদায় হতে পারি।
এখন চিত্রকর কালি দিয়ে আঁকা সিংহের ছবিটি ভাল করে খেয়াল করলো। তার নজর গেল সিংহের পেটের ওপর। নজর পড়া মাত্রই সে সুঁইয়ের মাথা খাড়া করে পাহলোয়ানের চামড়ায় বসিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে কান ফাটা চিৎকার দিয়ে সে বলে উঠলো:
কুস্তিগীর : আরে বাপু আমাকে মেরে ফেলবি নাকি? করছিস কি? এটা আবার কোন জায়গা?
চিত্রকর : এটাই তো সিংহের আসল জায়গা মানে পেট। এটা ছাড়া সিংহ হবেই না।
কুস্তিগীর : হবে না বললেই হলো? এমন কিছু কর যাতে সিংহও হয় আবার পেটও যেন না থাকে।
এবার চিত্রকর। হতভম্ব হয়ে গেল। মুখে আঙ্গুল দিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর সুইটি ঢিল মেরে ফেলে দিয়ে বললো:
চিত্রকর : জনাব পাহলোয়ান ! আমি এ যাবত কমপক্ষে এক হাজার লোকের গায়ে ছবি এঁকেছি আর একশ’ লোকের শরীরের শুধু সিংহই এঁকেছি। কিন্তু লেজ, ঘাড়, থাবা, কেশর আর পেট ছাড়া কোন সিংহ হতে দেখিনি।
এরপর চিত্রকর পাহলোয়ানের উদ্দেশ্যে একটি ছড়া কাটলো-
“দেখেছে কে কবে লেজ নেই পেট নেই বনরাজ?
খোদা কবে সাজালো এমন করে সিংহ সাজ?”
ছড়া শোনার পরও পাহলোয়ানের মনে ছবি আঁকার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। এ অবস্থায় চিত্রকর বললো:
চিত্রকর : শোন বাছা! সুইয়ের মাথার আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা যখন তোমার নেই তখন তোমার বাহু খালি থাকাই ভাল। এখান থেকে এক্ষুনি তুমি বিদায় হও। আর কক্ষনো পাহলোয়ানগিরির গল্প করতে এসো না। এ কথা বলার পর চিত্রকর আরেকটা ছড়া কাটলো।
“সইতে যদি নাইবা পারো সুঁইয়ের ঘা
গপ্পো মারা বন্ধ করো ‘সিংহ-ছা’।”