চারা বন্ধু—- মোহাম্মদ নাদিম

বড় চাচা বাগানের সব ক’টি গাছ কেটে ফেলবেন বলে আলীর খুব কষ্ট হচ্ছে। হবেই না কেন? ছোটবেলা থেকেই তো এ গাছগুলোর সাথে বেড়ে উঠেছে ও। যখন খুব মন খারাপ হয় তখন ও একাকী বাগানে ঢুকে পড়ে। গাছের সাথে কথা বলে। নিজের কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। আর উপভোগ করে তরুপল্লবের এমন সৌন্দর্য। ফলে নিমিষেই ওর মন ভালো হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে বাগানের গাছগুলোর সাথে ওর গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুতব। কিন্তু ওর এমন বন্ধু গাছ গুলোকেই নাকি বড় চাচা কেটে ফেলতে চাইছেন। ভেবেই আলীর অন্তরটা ঢুঁকরে ঢুঁকরে কেঁদে উঠলো। আলীর বাবা-চাচা দুই ভাই। ওর বাবা ছোট। বড় চাচা অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়ে আলীর বাবাকে মানুষ করেছেন। বড় চাচার কথা এ পরিবারের সবাইকে মানতে হয়। বলা চলে তিনিই এই বাড়ির হর্তাকর্তা। তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো নেই। এজন্য বড় চাচাকে সবাই ভয় পায়। এইজন্য বড় চাচা যখন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে বাড়ির বাগানের গাছগুরো কেটে ফেলতে চাইলেন তখন কেউ তাকে বাধা দেয়নি। অথচ আলী ওর মাকে বলেছিলো- ‘আম্মা তুমি বড় চাচাকে বলো না গাছগুলো যেন না কাটেন।’

মা বলেছিলেন, ‘নারে আলী। তোর বড় চাচা যা সিদ্ধান্ত নেন তা আমাদের সবার মঙ্গলের জন্যই নেন।’ আলী মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মা আমাদের স্কুলের বইয়ে পড়েছি গাছ আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। গাছ আমাদের নানারকম ফল-মূল দেয়। তা খেয়ে আমরা তৃপ্তি পাই। পুষ্টি পাই। গাছ অক্সিজেন দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। গাছ না থাকলে আমাদের জীবন বিপন্ন হতে বাধ্য…। ‘ঠিক পড়েছো।’ মা সম্মতি দেন। ‘তাহলে তুমি বাবাকে বলো, বড় চাচাকে গাছ কাটতে বারন করতে।’

‘পাগল হয়েছিস! তুই জানিস না তোর বাবা তোর বড় চাচার মতের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করেন না। তুই এ নিয়ে পন্ডিতি করিস নাতো। যা আমাকে কাজ করতে দে।’ বলে মা রান্নার কাজে মনোযোগী হন।

অনেক দরকষাকষির পর একজন বায়োজ্যেষ্ঠ কাঠের বেপারীর কাছে গাছগুলো বিক্রি করতে রাজি হয়েছেন বড় চাচা। তাই একদিন সে বেপারী জনাতিনেক গাছকাটার কামলা সাথে করে বাগানের গাছগুলো মাপ-জোপ করতে এলেন। কামলারা গজ ফিতা দিয়ে গাছগুলোর কান্ডের ব্যাস মেপে খাতায় লিস্ট করলো। লিস্ট করা শেষ হলে বেপারী বড়চাচাকে বললেন- ‘তাহলে এ কথাই রইলো, আজ সব গাছ মেপে নিয়ে গেলাম। আগামি সপ্তায় গাছকাটা শুরু করবো।’

বড় চাচা বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি যেমন চান তেমনি হবে। তবে বলছিলাম যে কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিলে উপকার হতো।’

বেপারী পাঁচশ টাকা নোটের পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল বড় চাচার হাতে দিলেন। বড় চাচা টাকাগুলো গুনে বললেন, ‘তাহলে আসছে শুক্রবার থেকেই গাছকাটা শুরু করতে পারেন।’ আচ্ছা শুক্রবারই। এবার আসি, আস্সালামু আলাইকুম।

বেপারী ও কামলারা চলে গেলো। তারপর যেদিন শুক্রবার এলো গাছকাটার সব রকম প্রস্ত্ততি নিয়ে বেপারী ও কামলারা আলীদের বাসায় হাজির হলেন। এরপর তারা বড় চাচার উপস্থিতিতে টানা পাঁচ দিন পরিশ্রম করে বাগানের সব গাছ গেটে রেডি করলো। আর বড় বড় তিনটি ট্রাক ভর্তি করে গাছগুলোর কান্ড, ডাল, পাতা সব নিয়ে গেলো। যাবার আগে বেপারী বড় চাচাকে গাছের টাকা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। তাই বড় চাচা সে টাকা দিয়ে ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দেনামুক্ত হলেন।

গাছগুলো কাটার পর আলী আর আগের মতো কারো সাথে কথা বলে না। সব সময় মন খারাপ করে গাছশূন্য বাগানে গিয়ে বসে থাকে। একদিন বড় চাচার চোখে ব্যাপারটি ধরা পড়লো। তিনি আলীকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আলী, বাপ আমার, তোমার কী হয়েছে? কয়েকদিন দিন হলো দেখছি তুমি প্রায়ই এ বাগানে এসে মন খারাপ করে বসে থাকো। কী হয়েছে আমাকে খুলে বলো।’

আলী হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বড় চাচাকে বললো- ‘চাচাজান, তুমি গাছগুলো কাটলে কেন? তুমি জানো না গাছগুলো আমার কত প্রিয় ছিলো। ওরা আমার ভালো বন্ধু ছিলো। তুমি ওদের কেটে ফেলেছো।’ বলতে বলতে আলী আরো জোরে কাঁদতে থাকলো। তার কান্না শুনে চাচীমা, আম্মা, বাবা সবাই বাগানে ছুটে এলেন। তারা আলীকে সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামাতে চেষ্টা করলেন। বড় চাচা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন- ‘আর কেঁদো না আববু। আমরা আজই হাট থেকে গাছের চারা এনে বাগানে বুনে দেবো। দেখবে তোমার শূন্য বাগান আবার গাছে গাছে পূর্ণ হয়ে যাবে। তুমি আবার তোমার নতুন বৃক্ষ বন্ধুদের খুঁজে পাবে। খুঁজে পাবে ওদের মাঝে হাসি, আনন্দ, ভালোবাসা।’ বড় চাচার কথাগুলো শুনে আলী কান্না থামালো। মুখে এক ঝলক হাসি ফুটিয়ে বললো- ‘সত্যি বলছো চাচাজান!’

‘হ্যাঁ, সত্যি সত্যি সত্যি। চলো আমরা এখনি হাটে যাবো। তোমার পছন্দ মতো গাছের চারা কিনে আনবো। বলে আলীকে নিয়ে বড় চাচা হাটে গেলেন, হাট থেকে আলীর পছন্দের নানা রকম ফুল-ফল, ওষুধি গাছ দুই ভ্যান বোঝাই করে বাড়ি নিয়ে এলেন। আর আলীর সাথে বাড়ির সবাই চারাগুলো সারা বাগানজুড়ে বুনে দিলেন।

এভাবে আবার চারাগুলোর সাথে আলীর নতুন করে বন্ধুতব গড়ে উঠলো। আলী আর বাড়ির লোকদের পরিচর্যায় চারাগাছগুলো তর তর করে বড় হতে থাকলো।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!