ঝুমার বাংলাদেশ ভালো লাগে না । ওর এই বারো বছর বয়সে ওই দেশটাকে জ্ঞানতঃ দেখেই নি কখনও । তবুও ঘোরতর অপছন্দ বাংলাদেশকে । আসলে বাংলাদেশের নাম শুনলেই ও দেখতে পায়, একটা ফর্সা ধবধবে নাদুসনুদুস পিঠ আর সেই পিঠে আড়াআড়ি দুটো লাল দাগ । চাবুকের দাগ । যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ওই পিঠ আর একটা কোমল হাত সেঁক দিচ্ছে ওই পিঠে । চোখে জল এসে যায় ঝুমার, চিত্কার করে ছুটে পালায় বাংলাদেশ নামটা থেকে । ও কোনদিন বাংলাদেশ যাবে না । মায়ের মুখে গল্প শুনেছিল , যখন ওর এক বছর বয়স , তখন বাবা মার সাথে দাদুর কাছে গেছিল একবার বাংলাদেশে । তখন বোধহয় পাসপোর্টের এত হাঙ্গামা ছিল না । বর্ডার পেরিয়ে , তারপর কিভাবে কিভাবে স্টীমারে পদ্মা পার হয়ে , আরও একটি নদী পার হওয়ার জন্য উঠে বসেছিল নৌকোয় । এখনও মনে মনে ঝুমা পদ্মা নদীকে দেখতে পায় । এপার ওপার দেখা যায় না তার , বিরাট বড় বড় ঢেউ , যেন সমুদ্র ! আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করে এলে পদ্মার মাতন দেখে কে ! “পদ্মা নদীর মাঝি “ সিনেমাটি যখন ও দেখেছিল , নিজের কল্পনার পদ্মার সাথে মেলাচ্ছিল বারবার । ওর কল্পনার সঙ্গে বাস্তব চিত্রের খুব একটা ফারাক ছিল না । যদিও বাস্তব চিত্র না বলে , সিনেম্যাটিক চিত্র বলাই ভালো । অন্য নদীতে নৌকোয় উঠে ও যথারীতি ছিল বাবার কোলে । এমন সময়ে ডাকাত পড়ল নৌকোয় । হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল । কান্নাকাটি , চিত্কার চেঁচামেচিতে কান পাতা দায় । যার যা আছে
কেড়েকুড়ে নিল ওরা । মহিলাদের গায়ের গয়না ছিনিয়ে নিল । মায়েরও সব কেড়ে নিল ওরা । হাতে রামদা আর চাবুক নিয়ে ঘুরছিল ডাকাতরা । যারা বাধা দিচ্ছিল তাদের ওপর চাবুক নেমে আসছিল নির্বিচারে । পায়ের তলায় চাপা পড়ছিল কেউ কেউ । এরকমই এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে বাবা ওকে বুকে চেপে শুয়ে পড়েছিল উপুড় হয়ে । শুধু যেন ঝুমার গায়ে আঁচড়টি না পড়ে । সেই সময়েই নেমে এসেছিল চাবুক বাবার পিঠে । একবার নয় , দু দুবার ।
অত চেঁচামেচির মধ্যে চাবুক মারার “সপাং” শব্দটা শোনা যায় নি । কিন্তু ঝুমার কানে এখনও সব শব্দ ছাপিয়ে চিত্কার করে “সপাং” শব্দটা । দু কানে হাত চেপে রাখে ও । এখনও ঝুমা সেই লাল দাগ দুটো দেখতে পায় চোখ বুজলেই । ফর্সা ফর্সা নরম নরম পিঠে দুটো আড়াআড়ি লাল দাগ । ভয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বুজে ফেলে ও । বাংলাদেশকে ভালবাসতে পারল না কখনও ঝুমা এই জন্যই । ওই দেশে সে যেতেও চায় না তাই । বাংলাদেশের মানুষরা এই অবুঝ ঝুমাকে মাপ করবেন নিশ্চই ।