চাঁদে যাওয়ার ইতিহাস— নাহিদ করিম অংকুর

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নভোচারীরা যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাকাশে পাড়ি জমান, তখন হয়তো পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তের একা কোনো কিশোর বা কিশোরীকে পৃথিবীর বাইরে অজানা মহাশূন্য হাতছানি দেয় ঘরের গণ্ডি পার হয়ে অজানায় অভিযানের। পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে এ অভিযানে জীবনের ঝুঁকিটা যে কত বড় সেটা বলার মঅপেক্ষা রাখে না। তবে তার মানে এই নয় মহাকাশ অভিযানের পুরোটা জুড়েই থাকে টানটান উত্তেজনা, জীবনের ঝুঁকি এড়াতে সদা তৎপর মহাকাশচারীরা। সংশ্লিষ্ট অনেক ঘটনাই জোগায় নিখাদ হাসির খোরাক। কিছু ঘটনা শুনলে হাসির পাশাপাশি সহানুভূতি যাগে মহাকাশবিজ্ঞানী আর নভোচারীদেরপ্রতি। আবার কিছু  ঘটনা শুনলে মনে হবে এটা কোনো সত্যি
ঘটনা নয়, মঞ্চে একজন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানের লোক হাসানো গল্পমাত্র। চন্দ্রজয় থেকে শুরু করে মঙ্গল অভিযান পর্যন্ত এমন মজার কয়েকটি ঘটনা জানিয়েছ লিস্টভার্স ডটকম।

চাঁদের অসুখ : যদি ভেবে থাকেন নিল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন চাঁদ থেকে ফিরে পৃথিবীতে পা দেয়া মাত্র তাদের নিয়ে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল তবে ভুল করবেন। চাঁদে প্রথম মানব সন্তান হিসেবে পা দিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন এই দুই নভোচারী। কিন্তু পৃথিবীতে অবতরণ করা মাত্র এই দুজনকে টানা ২১ দিন একরকম বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটা ট্রেইলারে। পাছে যদি এ দুজনের গায়ে ভর করে চাঁদ থেকে উড়ে আসা কোনো
জীবাণু বারোটা বাজিয়ে দেয় মানব সভ্যতার! শুধু নিল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন নন, এরপরের তিনটি মিশনে চাঁদের বুকে পা দেয়া নভোচারীদেরও যেতে হয়েছে একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। অ্যাপলো ১৪ মিশনের পর চাঁদেকোনো প্রাণের
নিশ্চিত হন বিজ্ঞানীরা। মাঝের মিশনগুলোরনভোচারীদের পোহাতে  হয়েছে এ ভোগান্তি। ২১ দিন আটকে রেখে রীতিমতো গবেষণা
চালানো হয় নিল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিনের ওপর। তারা চাঁদ থেকে কোনোজীবাণু বয়ে আনেননি  সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরই মুক্তি মেলে এই
দুই নভোচারীর। এরপর ২৫টি দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা, অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন উৎসবমুখর প্যারেডে। এমনকি স্বাক্ষাৎ পেয়েছেন
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথেরও।
মহাশূন্যে ডায়রিয়া :
অ্যাপলো ৮ মিশনকে বলা চলে অ্যাপলো ১১ মিশনের পূর্বসূরি। মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যান। পাইলট হিসেবে ছিলেন জেমস লভেল আর উইলিয়াম অ্যান্ডার্স। মিশনের মাঝপথে পেট খারাপ করে বসে বোরম্যানের। অ্যাপলো ৮-এর ভেতরে ঘুমাচ্ছিলেন তখর বোরম্যান। হঠাৎ ঘুম
থেকে জেগে উঠেই বমি করে দেন বেচারা, সঙ্গে পেটের চাপ তো ছিলই। শেষ পর্যন্ত অ্যাপলো ৮-এর মধ্যাকর্ষণবিহীন অবস্থাতেই বোরম্যানের ভাসমান বর্জ্য পরিষ্কার করতে হয়েছিল লভেল আর অ্যান্ডার্সকে। শুরুতে লোকলজ্জার ভয়ে নাসার কমান্ড সেন্টারে ব্যাপারটা জানাতেই চাননি বোরম্যান, কিন্তু হার মানতে হয়েছিল দুই পাইলটের চাপাচাপিতে। অটোগ্রাফ লাইফ ইন্স্যুরেন্স : বিশ্বাস করতে হয়তো কষ্ট হবে, অ্যাপলো ১১ মিশনের ৩ যাত্রী নিল
আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন আর মাইকেল কলিনসের জীবন বীমা করাতে ব্যর্থ হয়েছিল মার্কিন সরকার। কোনো প্রতিষ্ঠানই রাজি হয়নি এই তিন নভোচারীর জীবন বীমা করাতে। শেষ পর্যন্ত পরিবারের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে অভিযানের আগে অটোগ্রাফ সাইন করে যান তারা।
মহাকাশ থেকে জীবিত ফেরা না হলে ওই অটোগ্রাফগুলো বিক্রি করে কিছুটা হলেও পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে, চিন্তাটা ছিল এমনই।
মহাকাশের গন্ধ :
মহাকাশের গন্ধ কেমন- এ প্রশ্ন করলে সিংহভাগ মানুষই হয়তো বলবেন মহাকাশে আবার গন্ধ কিসের! কেউ হয়তো ভেবে চিন্তে বলবেন গন্ধ থাকলেও সেটা হবে ঘণীভূত অক্সিজেনের। কিন্তু নভোচারীরা বলেন ভিন্ন কথা। মহাকাশে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে এমন অনেক মহাকাশচারীই জানিয়েছেন ধাতব একটা গন্ধ পাওয়ার কথা। আবার কেউ কেউ বলেন রাসবেরি আর রামের মিশেলে একটা গন্ধও নাকি পাওয়া যায়
মহাকাশে।ওয়েল্ডিংয়ের ধোঁয়ার মতো গন্ধ পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন মহাকাশচারীরা। মহাকাশের ওই গন্ধগুলো পৃথিবীতে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টির
চেষ্টা অনেকবারই করেছে নাসা। ফলাফল ছিল শুধুই ব্যর্থতা।

টয়লেট নিয়েও দ্বন্দ্বঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। তাই বলে টয়লেট নিয়ে! তাও পৃথিবীতে নয়, মাটি থেকে ৩৩০ কিলোমিটারেরও বেশি উচ্চতার কক্ষপথে থাকা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে (আইএসএসে)। শুরুতে আইএসএসে বেশ ভালো ভাব জমে গিয়েছিল মার্কিন আর রাশিয়ার নভোচারীদের। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলে নভোচারীরা সাধারণত সবচেয়ে কাছের টয়লেটটাই
বেছে নেন। কিন্তু ঝামেলা পাকায় রাশিয়ান নভোচারীদের খাদ্যাভাস। মহাকাশে মাছ-মাংসের জেলি খেয়ে অভ্যস্ত রাশিয়ান নভোচারীরা। আর এতে সমস্যা হল, এ খাবার খেয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেলে প্রায়ই আটকে যেত কমোড। আর মহাকাশে এ সমস্যার সমাধান করা যে কি জটিল বিষয় সেটা বিস্তারিত আলোচনা না হয় নাই হল। শেষ পর্যন্ত ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে আমেরিকান নভোচারীদের টয়লেট যেন রাশিয়ার নভোচারীরা ব্যবহার
করতে না পারেন, সে জন্য জারি করা হয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা।

দুশ্চিন্তা যখন আয়কর নিয়ে :
অ্যাপলো ১৩ মিশনে কমান্ড মডিউল পাইলট ছিলেন জ্যাক সুইগার্ট। মিশনের শুরুতেই বেচারার মাথায় বাজ! মিশনের প্রস্তুতির ব্যস্ততায় আয়কর
দেয়ার কথাই ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। মনে পড়তে না পড়তেই মিশন কন্ট্রোলে জানালেন নিজের দুশ্চিন্তার কথা। নাসার মিশন কন্ট্রোলের সবাই তো
সুইগার্টের কথা হেসে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করে দিয়েছিলেন। সঙ্গী নভোচারী জিম লভেল তো রসিকতা করে বলেই বসেছিলেন যে, স্পেস
শাটলের ফিউয়েলের খরচ মেটানো হবে সুইগার্টের আয়কর দিয়ে। তবে পুরো ব্যাপারটা হালকাভাবে নিতে একেবারেই নারাজ ছিলেন সুইগার্ট।
সুইগার্টের চাপের মুখে নাসার সহযোগিতায় সময় বাড়ানো হয় তার আয়কর পরিশোধের। ওই ঘটনার ৩৩ বছর পর আইএসএসের বর্তমান প্রধান রাশিয়ান নভোচারী পাভেল ভিনোগ্রাদভ মহাকাশ থেকেই আয়কর পরিশোধ করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান।

নিক্সনের আগাম শোকবার্তা :

মহাকাশ অভিযান কখনোই ঝুঁকিবিহীন ছিল না। প্রমাণ স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার ও কলাম্বিয়া। স্পেস শাটল দুটি বিদ্ধস্ত হওয়ার ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ নভোচারী। মহাকাশে আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনার আশংকা এখন যেমন আছে, ঠিক তেমনি ছিল ১৯৬৯ সালেও। অ্যাপলে ১১ মিশনে নভোচারীরা চাঁদে পা দেয়ার পর কী ঘটবে, সেটা নিয়ে শংকাটা ছিল আরও বেশি। চাঁদে কোনো ভিনগ্রহবাসীর মুখোমুখি হলে তিন নভোচারীর ভাগ্যে কী ঘটবে, এ
বিষয়টি নিয়ে আশংক এতটাই বেশি ছিল যে আগেভাগেই এক শোকবার্তা লিখিয়ে নিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। নিল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন চাঁদের বুক থেকে জীবিত না ফিরলে জাতিকে সেই শোকবার্তা পৌঁছে দিতে, উইলিয়াম স্যাফায়ারকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়া সেই শোকবার্তার শুরুটা
ছিল-‘Fate has ordained that the men who went to the moon to explore in peace willstay on the moon to  rest in peace. These brave men, Neil Armstrong and Edwin Aldrin, know that there is no hope for their recovery. But they also
know that there is hope for mankind in their sacrifice. These two men are laying down their lives in mankind¯s
most noble goal: the search for truth and understanding.’

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!