চাঁদের হাসি

নানাবাড়ির পশ্চিমপাশের খড়ের চালের জীর্ণ দু’খানা ঘর। ভাগ্য বিড়ম্বিত এক পরিবার তাতে বাস করে। বড় পরিবারের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে রায়হান সবার ছোট। জীবনের বহুমুখী জটিলতার উনুন তখনো তাকে স্পর্শ করেনি। বোঝা শেখেনি প্রকৃতির রূঢ়তা। নিয়তির নির্মম পরিহাসে এমন অসময়ে বাবার আকস্মিক মৃত্যু। কর্মক্ষম বড় দুই ভাই সংসারের হাল ধরলেও বৃহৎ পরিবারের নিত্য চাহিদা মেটাতে তাদের নাভিঃশ্বাস উঠে যেত। কোনো কোনোদিন হয়তো একবেলা খেয়ে অপরবেলা উপোস থাকতে হতো। মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সদা সংগ্রামে অতিষ্ট ওদের কাছে অন্য স্বাদ-আহ্লাদ নিতামত্ম ‘বাহুল্য’ মনে হতো।
এক ঈদের ঘটনা। মূল উৎসবের দিনের তখনো তিন-চার দিন বাকি। দল বেঁধে আমরা নানাবাড়িতে হাজির। এলাকায় এ বাড়িটি ‘মাস্টার বাড়ি’ (নানাজান দীর্ঘদিন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, সেই সূত্রে এই নামকরণ) নামে পরিচিত, সমাদৃত। তো তখন থেকেই নানার বাড়িতে আমাদের সরব উপস্থিতি আর হৈ-হুল্লোড়ে যেন ঈদ উৎসবের আমেজ চলে এসেছে।
মাদুর বিছিয়ে প্রকান্ড ওঠোনে আমরা খোশগল্পে মেতেছি। ঈদে কে কী পেলাম, কার কাছ থেকে কত সালামি আদায় করবো, কোন দিন কীভাবে উদ্যাপন করবো, কোথায় কোথায় বেড়াতে যাব- এসবের হিসাব মেলাতে সবাই ব্যসত্ম। কোন ফাঁকে রায়হান আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা কেউ খেয়াল করেনি। ওর মলিন মুখ আর ছিন্ন পোশাক আমাদের চোখ এড়ালেও নানাজানের চোখ এড়ায়নি। শৈববের ঈদ-আনন্দ থেকে কেউ বঞ্চিত হবে এটা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই বিলম্ব না করে পরের দিনই আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে গিয়ে রায়হানের জন্য শার্ট-প্যান্ট কিনে আনলেন। ঈদে নতুন কাপড় পাওয়ার পর ওর কচি মুখে বিস্ময় আর খুশির যে ঝলকানি দেখেছিলাম, বাসত্মবিকই তা আমাদের ঈদের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
রায়হান এখন অনেক বড়। পড়ালেখাতেও ঈর্ষণীয় ফলাফল করেছে। ওদের পরিবারও দুরবস্থার অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। যে কোনো কৃতিত্বের পরই নিয়ম করে রায়হান এ বাড়িতে এসে হাজির হয়। গুরুজনের পা ছুঁয়ে সালাম করে। ওর চোখে-মুখে আনন্দের যতি ঠিকরে পড়ে। কী অদ্ভূত মিল! ওকে দেখে আমি মুহূর্তেই চলে যাই পুরানো সে দিনের ঈদ-আনন্দে। তবে সেবার ঈদের সেই সামান্য উপহার ওর শিশুমনকে যেভাবে আন্দোলিত করেছিল, এত বড় বড় প্রাপ্তির আনন্দও যেন সেটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনা। অপ্রত্যাশিত কোনো ক্ষুদ্র প্রাপ্তি মহার্ঘে অনেক বড় অর্জনকে অনায়াসে ডিঙিয়ে যায়। না পাওয়ার হাহাকার ভুলিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও জীবনের সাদা পাতায় একপ্রস্ত বর্ণিল অাঁচড় বুলিয়ে দেয়। হাতে গোনা দু-একজন নয়, আরো অসংখ্য রায়হান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের চারপাশে।
ঈদ যাদের কাছে বাড়তি কোনো আবেদন নিয়ে আসে না। আর দশটা সাধারণ দিনের মতো দিনযাপনের গ্লানিতে হারিয়ে যায় ঈদের উদ্দীপনা-উচ্ছ্বাস। অথচ আমাদের একটু সহানুভূতি এবং উদারতাই পারে ওই মলিন মুখগুলোতে নিষ্পাপ হাসি ফোটাতে। বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে ঈদের মহিমা। কেননা একেকটা শিশুর হাসিমাখা মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকে একেকটা খুশির সতেজ পাঁপড়ি, ঈদের জ্বলজ্বলে প্রশসত্ম চাঁদও কি নয়?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!