চাঁদা –বিশু মুখোপাধ্যায়

এর পর আর কোন দিন চাঁদা দেবে না ঠিক করে ফেললেন দীনদয়াল।এ পাড়ায় নতুন বারী করে অতিষ্ট হয়ে গেল চাঁদা দিতে দিতে!দুই,টাকা,এক টাকা করে দশটাকা বার আনা চাঁদা দিতে হয়েছে তাকে একবারের সরস্বতী পুজোয়।একই পারাড় মুধ্যে বড়দের ছোটদের,তস্য ছোটদের করে শেষ আট আনা,চার আনা এমন কি দুই আনা পর্যন্ত দিয়ে রেহায় পেয়েছেন।ক,দিন চাদার জ্বালায় ভোরের দিকে উঠেই বেরিয়ে পড়তেন দিনদয়াল।এখানে-ওখানে বেড়িয়ে চড়া রোধ মাথায় বাড়ি ফিরতেন।কিন্তু তাতে কি রেহায় ছিল,ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে হিংস্র বাঘের মত তারা ওত পেতে থাকত।ওকে দেখলেই চাদার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত।

উনি চার আনা দিতে চাইলে চারগুন আদায় করে ছাড়ত।রিটাইয়ার্ড মানুষ দিনদয়াল।চাকুরী জিবনে যা জমিয়ে ছিলেন তা থেকেই মাথা গোজবার একটা ঠাই করেছেন।বাকি সামান্য যা পেনসন পান তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে।খুব টেনে টুনে হিসাব করে চলতে হয় তাকে।একটু এদিক ওদিক হলেই টানাটানি।বিচক্ষন দিনদয়াল জাতে করে সংসারে সেই টানাটানি না ঘটে সে জন্য পয়সার ব্যাপারে সচেতন থাকতেন।কিন্তু হলে কি হবে,বারো মাসে বত্রিশ পার্বণ, হিন্দুর এই পূজা আচ্চাই সেরেছে তাকে!আজ কালি,কাল,সরস্বতী,এক পাড়ায় বারোটা দলের তেরটা পূজো।কেন রে বাবা,সকলে মিলে একটা সার্বজনীন করলে তো চুকে যায়!— তা নয়,চাঁদা!দাও প্রত্যেকের,না দিলেই ঝনঝাত।ছাপোষা গেরস্ত লোক পারবে কেন এতো!— বাইরের ঘরে ইজিচেয়ারে বসে ভাবছিলেন দিনদয়াল।এমন সময় হঠাৎ বাইরে করা নড়ে উঠলো।কে?প্রশ্ন করল দিনদয়াল।আমরা উত্তর এল বাইরি থেকে।তোমারা কারা?আবার প্রশ্ন করলেন দিনদয়াল।আজ্ঞে আমরা এই পাড়ারই দরজা খুলুন না একবার।ছেলেদের চেনা গলায় কে যেন বললে।এই ছেলেদের গলাকেই ভয় দিনদয়ালের সব চেয়েবেশি।বিরক্তের সঙ্গে দরজাটা খুলে দিলেন দিন দয়াল।খুলেই দেখলেন,এক সঙ্গে চার পাঁচটি ছেলে দাড়িয়ে।দু এক টি তাদের মধ্যে মুখচেনা।এই দিন তারা সরস্বতী পূজোর চাঁদা আদায় করে নিয়ে গেছে। তাদের দেখেই দিনদয়াল বলে উঠলে আবার কি খবর তোমাদের-চাঁদা-চাঁদা নয় তো?

না স্যার,ও সম্পূর্ন অন্য ব্যাপার-পূজো-তূজো নয়।আমাদের এই পাড়াতেই এক জন বাস্তত্যাগী গরিব লোক থাকতেন ছোট্ট ছোট্ট অনেক গুলি ছেলে মেয়ে নিয়ে।কাল ভোর রাতে হঠাৎ তিনি মারা গিয়াছেন,অর্থের ওহাবে এখনও তার দাহ হয়নি;তাছাড়া তাদের এমন এক জন নেই যে তাদের সৎকারের ব্যবস্থা করবে।তাই আমরা পাড়ার বিশেষ কিছু লোকদের কাছ থেকে কিছু কিছু নিয়ে তার সৎকারের ব্যবস্থা করছি।তাদের কথা শেষ না হতেই দিনদয়াল প্রায় ক্ষেপে উঠে বললেন,সেই তো চাদার কথাই বাপু,তা তোমাদের এত মাথা ব্যথা কেন-এর জন্য তো সমিতি রয়েছে।তাদের খবর দিলেই তো মিটেযায়!-বলেন কি স্যার পাড়ায় আমাদের বুয়েজ ওন ক্লাব থাকতে!ওদের সঙ্গের আর একটি ছেলে বললে,আমরা পাড়ায় আপনাদের মত চার-পাঁচ জন মাহাপ্রান ব্যক্তির কাছ থেকে পাঁচ-সাত টাকা করে কাজ সারব।এটা আমাদের পাড়ারই গৌরব।ওঃতা এত লোক থাকতে আমাকে বুঝি আর ঐ চার-পাঁচজনের ভেতর থেকে বাদ দিতে পারলে না-আমি এক টাকাও দেব না।দিনদয়াল এক কথায় এই গুরুত্ব পুর্ন ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দিলেন।–এ সময় ও কথা বলবেন না স্যার-আপনার নাম দিন দয়াল।আপনি আর মাত্র পাঁচ টাকা দিলেই আমাদের কাজ হয়ে যাবে।আপনার পাশের বাড়ির ননীবাবুও কাকা পাঁচ টাকা দিয়েছেন।আর একটি ছেলে বিজ্ঞের মত দিনদয়ালের মত ফেরাবার জন্য চেষ্টা করল। ননীবাবুর ছেলে বিকাশ ছিল ওদের মধ্যে।তার দিকে তাকিয়ে দিনদয়াল বললেন,তোমার বাবা বড় লোক, তিনি পারেন,কিন্তু আমাদের মত লোকের পক্ষে প্রত্যেক ব্যাপারে চাঁদা দেওয়া সম্ভব নয়!— শেষ পর্যন্ত প্রায় আধঘণ্টা ধরে অনেক রগডারগড়ির পর,কে কত দিয়েছে খবরাখবর নিয়ে,হিসাব পত্র দেখে,দিনদয়াল তিন টাকা দিতে রাজি হলেন এই মহৎ কাজের জন্য।টাকা নিয়ে ছেলেরা চলে গেল বটে,কিন্তু ঐ তিন টাকার শোকে দিনদয়াল বাবুর দুপুরের ঘুমটা একেবারে মাটি হয়ে গেল।কোন রকমে কিছুক্ষন এপাশ-ওপাশ করে,সন্ধ্যার পরে এক কাপ চা ক্ষেতে বের হন তিনি।পাশেই ননীবাবুদের বাড়ি,,গিয়ে ডাকলেন তাকে।

ননীবাবু বাড়িতে ছিলেন,বাইরে বেরিয়ে এলেন।তাকে দেখেই বিরক্ত সুরে দিনদয়াল বললেন,আরে মশাই পারি না তো আপনাদের পাড়ায় চাঁদা দিতে দিতে,……পূজো-আচ্ছা নেই,এখন আবার চাঁদা কিসের?প্রশ্ন করলেন ননীবাবু।কেন আপনি চাঁদা দেননি?ঐ যে পাড়ায় কার দাহ হচ্ছে না বলে ছেলেরা আজ দুপুরে চাঁদা নিয়ে গেল!উত্তরে বললেন দিনদয়াল।কই আমি তো কিছু জানি না।অবাক হয়ে গেলেন ননীবাবুর কথায়,দিনদয়াল যা সন্দেহ করেছিলেন,ব্যাপার টা যে তারি অনুকূলে ঘটেছে,তাতে আর সন্দেহ রইল না তাঁর।আর অন্য কথা না তুলে তিনি শুধু ননীবাবুকে প্রশ্ন করলেন,আপনার পুত্র বিকাশ কোথায়?সে বোধায় ওদের ক্লাবে গেছে-কেন সে কি ওই দলের সঙ্গে ছিল নাকি?প্রশ্ন করলেন ননীবাবু।কিন্তু সে কোথায় উত্তর দিলেন না দিনদয়াল।হন হন করে বাড়ির থেকে বেরিয়ে গেলেন রাস্তায়।ওদের ক্লাবের ঘর টা তাঁর জানা ছিল।বাকা চোরা গলির ভিতর দিয়ে সোজা হাজির হলেন সেখানে।জতই কাছাকাছি হতে লাগলেন ততই মাংস রান্নার গন্ধ হাওয়ায় ভেসে আসতে লাগল তাঁর নাকে।নিঃসাড়ে পা টিপে টিপে দাঁড়ালেন ক্লাব ঘরের বাইরের দিকে একটা জানালার ধারে একটা বড় গাছের ছায়ায়।সে দিকটা কিছু অন্ধকারই বলা যায়।দুরগত বিজলির আলো সেখানে পৌছাতে পারিনি।জানালার ভিতর দিয়ে সবকিছু স্পষ্ট তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল।একটি ছোট খাট যজ্ঞি বসেছে সেখানে।একটা বড় হাড়িতে মাংস বসিয়েছে।বড় একটা বাক্সের উপর এক তাল ময়দা মাখা।সেই ময়দা থেকে ছিড়ে ছিড়ে নেচি করছে তিনজনে।একটা চাঙারিতে পটল ছাড়ান,একটা ঝুড়িতে দুমো দুমো করে আলু কাটা,বড় বটির উপর বসে বিকাশ দু,ফলা করে বেগুন কুটছে,দারুন মহারু চারিদিকে-তাদের ঘারমটকে,মিথ্যে সৎকারের কথা বলে ছড়িয়ে টাকা নিয়েছ এই ফিস্টি!দিনদয়ালের সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়র উঠল।কিন্তু তা অল্পক্ষের জন্যেই।তৎক্ষনে কি ভেবে মাথা ঠাণ্ডা করে ফেললেন তিনি।তাঁর পর জানালার ধার থেক সন্ত্রর্পনে একেবারে এসে হাজির হলেন ল্কাব-রুমের মধ্যে।হঠাৎ ভুত দেখলে যেমন হয়,তেমনি ছেলেদের সকলের হাত পা তো একেবারে পেটের মধ্যে ঢুকেজাবার অবস্থা।কারো মুখ দিয়ে আর কথা বের হয় না।কি কথা বলবে তারা?এত একে বারে হাতে নাতে ধরা পড়া।কিন্তু দিনদয়ালের মুখ প্রসন্ন মুখেই ছেলেদের ভয় ভেঙ্গে দিয়ে বললেন,ঘাটের কাজ সব সেরে এসে বুঝি আজ এখানেই তোমরা রাতের খাওয়া দাওয়াটা সারছ-তা বেশ বেশ,কিছু বেচেছিল বুঝি?

 

তাঁর কোথায় সকলে বুঝি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে।বিকাশ তাড়াতাড়ি কপাল ঠুকে বললে,এই তো কিছুক্ষন ঘাট থেকে ফেরলাম আমরা!কিন্তু সে দিনকার কোথায় আর কান দিলেন না!তিনি আবার তাঁর মুখে প্রসান্নভাব ফিরিয়ে এনে বললেন,বেশ ভালই হয়েছে,অনেক দিন থেকে মাংস খাব ভাবছিলুম-তা আজ তোমাদের সঙ্গে দল ভুক্ত করে নাও তোমাদের সঙ্গে আজ আমি খাব,কি বলো? সকলে সমসরে উৎসাহ প্রকাশ করলেঃনিশ্চয় নিশ্চয়….এত আমাদের সৌভাগ্য!সকলেই ভাবল বুড় আর কিছু গণ্ডগোল না করে বুড় যে খাবার কথা তুলেছে এই জথেষ্ট।কিন্তু খাবার সময় যে কাণ্ড ঘটল তা আর কহতব্য নয়!বাষট্টি বছরের দিনদয়াল প্রায় যেন মরিয়া হয়ে একাই খেলেন তিন চার জনের খাবার!

সবার আগেই খাইয়ে দেওয়া হল তাকে।খাওয়া দাওয়া শেষ হবার মুখে বিকাশ কাকে জেন বলে,দেখলি তো মাইরি বুড়ো যা দিয়েছল তাঁর দ্বিগুণ খাবার উসুল করে নিয়ে গেল।বিকাশের সে কথা দিনদয়ালের কানে গিয়েছিল কি জানা যায়নি।কিন্তু জাবার মুখে সকলের উদ্দেশ্যেই বললেন,আমার পয়সা পেটে উসুল করে নিয়ে গেলাম বটে,তবে তোমাদের পিঠে উত্তমমধ্যম কিছু পড়লে,খাওয়ার চেয়ে বেশি খুশি হতাম।

আরো পড়তে পারেন...

জীবনের অঙ্ক ও কোকাকোলার গাড়ি

“মানুষের জীবন অঙ্কনির্ভর। জীবনের অঙ্ক ভুল হওয়া মানেই কর্মক্ষেত্রে বিপর্যটা ঘটা। যার জীবনের অঙ্ক যতো…

শিয়াল পণ্ডিত–উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

কুমির দেখলে, সে শিয়ালের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। তখন ভাবলে, ‘ ও ঢের লেখাপড়া…

তিন কিশোরের কাণ্ড —স্বপন বুড়ো

তিনটি কিশোর এক সাথে পরীক্ষা দিতে বসেছিল।কিন্তু পরীক্ষার আগে ওরা পাকাপোক্ত ব্যাবস্থা করে গিয়েছিল।সুতো ঝুলিয়ে…