প্রায় গোটা বিশ্বেই দুর্বল দেশ ও মানুষদের ওপর শক্তিশালী দেশগুলো অত্যাচার চালাচ্ছে। নির্যাতিত দুর্বল মানুষেরা যতোই চিৎকার আর কান্নাকাটি করুক না কেন, অত্যাচারি শাসক কিংবা দেশগুলো তাদের অত্যাচার থামাচ্ছে না। তারা দুর্বল দেশগুলোর সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, যারা প্রতিবাদ করছে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে এখন দুর্বল,মজলুম মানুষেরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে এবং জালিমদের ওপর দুর্বল, মজলুমেরা কখনও কখনও বিজয়ীও হচ্ছে। এই অবস্থা কেবল মানুষের মধ্যেই নয়, পশু-পাখির মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। রংধনু আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প প্রচার করেছি। গল্পটির নাম ‘চড়ুই পাখি ও হাতি’।
এক বনে বাস করতো এক ঝাঁক চড়ুই পাখি। তারা ঝুপড়িতে ডিম পাড়তো এবং বাচ্চা ফোটাতো। ওই বনেই বাস করতো একটি হাতি। একদিন ঝুপড়ির পাশ দিয়ে নদীতে পানি খেতে আসার সময় হাতির পায়ের নিচে পড়ে কয়েকটি চড়ুই পাখির বাচ্চা মারা গেলো। চড়ুইরা এ খবর পেয়ে খুবই কষ্ট পেল। তাদের একজন এ ঘটনাকে ‘ভাগ্যের লিখন’ বলে এড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু কাকলী নামের এক চড়ুই প্রতিবাদ করে বলে উঠলো :
কাকলী : আমি এসব মানি না। হাতি বড় প্রাণী বলে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে তা হয় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। নইলে এই বনে আমরা কেউ বাস করতে পারবো না।
কাকলীর যুক্তি ও বলিষ্ঠ বক্তব্য অন্য পাখিরা সমর্থন করলেও তারা কেউই হাতির কাজের প্রতিবাদ করার আগ্রহ দেখালো না। এর পরিবর্তে তারা ওই বন ছেড়ে অন্য স্থানে চলে যাওয়ার পক্ষে মত দিলো। কিন্তু কাকলী কিছুতেই তা মেনে নিতে রাজি হলো না। সে বললো :
কাকলী : এ বন হচ্ছে আমাদের জন্মভূমি। শত্রুর ভয়ে আমরা যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে আমরা আমাদের জন্মভূমির মর্যাদা রক্ষা করবো কী করে? তাছাড়া অপরাধ করেছে হাতি, চলে যেতে হলে তারই যাওয়া উচিত এখান থেকে।
অন্য চড়ুই : ঠিক বলেছো তুমি। কিন্তু অধিকার আদায় করতে গেলে তো লড়াই করতে হবে। আমরা কি হাতির সাথে লড়াই করতে পারবো?
কাকলী : কেন পারবো না? আমরা সবাই যদি বুদ্ধি খাটিয়ে, নিজেদের সামর্থকে কাজে লাগাই তাহলে নিশ্চয়ই হাতিকে পরাস্ত করতে পারবো। তবে লড়াইয়ে নামার আগে আমি হাতিকে শেষবারের মত সাবধান করতে চাই যাতে সে আর আমাদের ঝোপঝাড়ের কাছে না আসে।
অন্য চড়ুই : বেশ ভাল কথা। কিন্তু হাতি যদি না মানে তখন কী করবে?
কাকলী : হাতি যদি না শোনে তাহলে তাকে এমন শিক্ষা দেবো যা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
এসব আলাপ আলোচনার পর কাকলী গেল হাতির কাছে। হাতিকে পেয়ে সে বললো :
কাকলী : এই হাতি ! তুমি আজ ঝোপের পাশ দিয়ে পানি খেতে যাওয়ার সময় আমাদের ক’টি বাচ্চাকে পায়ের তলায় পিষে মেরেছো। আমি জানতে এসেছি, তুমি কি ইচ্ছে করে এমনটি করেছো নাকি ভুল করে করেছো?
হাতি : আমি ইচ্ছে করে করি আর ভুল করে করি তাতে হয়েছেটা কী? না হয় ক’টা চড়ুইর বাচ্চা মারাই গেলো, তাতে দুনিয়া উল্টে গেছে নাকি?
কাকলী : না, দুনিয়া উল্টে যায়নি। কিন্তু সবাই যদি আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে একে অপরের অনিষ্ট করে চলে তাহলে নিশ্চয়ই একদিন দুনিয়া উল্টে যাবে।
হাতি : ওসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে এখান থেকে চলে যাও। নইলে তোমাদের সবাইকে আমার পায়ের নিচে পিষে মারবো। জেনে রেখো, তোমার মত হাজারটা চড়ুই’র দাম আমার এক পায়ের সমানও না।
কাকলী : তুমি অনেক বড় প্রাণী-এটা আমি মানি। তবে তুমি শুধু নিজের দেহটার দিকে তাকিও না। আমরা ছোট হলেও আমাদের প্রাণেরও দাম আছে। আর তাছাড়া আমরা যদি ইচ্ছে করি তাহলে তোমার অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারি।
হাতি : আমার প্রতিশোধ নিবি তোরা ? ঠিকাছে তোরা যা করতে পারিস করগে। আর কথা না বাড়িয়ে এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যায়।
কাকলী : ঠিকাছে, যাচ্ছি। তবে তুমি তোমার অহংকার ও পাপের শাস্তি শিগগিরই পাবে।
এই বলে কাকলী নিজের আস্তানায় ফিরে এসে চড়ুইদের কাছে হাতির দুর্ব্যবহারের কথা জানালো। সব শুনে পাখিরা ভীষণ ক্ষেপে গেলো এবং হাতিকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায় তা জানতে চাইলো। কাকলী বলল :
কাকলী : আমরা শক্তিতে হাতির সাথে পারবো না ঠিকই, তবে হাতি যেহেতু উড়তে পারে না সেহেতু সে আমাদের আকাশে পিষে মারতে পারবে না। বরং আমরাই উপর থেকে নখ ও ঠোঁট দিয়ে হাতির ওপর হামলা করবো। আমরা যদি হাতির চোখ ফুটো করে দিতে পারি তাহলে তার পরাজয় নিশ্চিত।
যুদ্ধের কৌশল নিয়ে আলোচনার পর সবাই মিলে একযোগে হামলা শুরু করলো হাতির উপর। তারা হাতির চারপাশ ঘিরে ধরল। হাতি প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই পাখিরা তার চোখ ফুটো করে দিল। কিছু দেখতে না পেয়ে হাতি পাগলের মতো ছুটাছুটি করতে লাগলো। এ সময় কাকলী ব্যাঙদের ডাকলো এবং হাতির অত্যাচারের কাহিনী শোনালো। তারাও হাতির অত্যাচারের শিকার। হাতিকে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য তারাও শপথ নিল।
এদিকে পাখিদের হামলায় চোখ হারিয়ে ছুটাছুটি করতে গিয়ে হাতির ভীষণ পিপাসা পেল। এ সময় কাকলীর নির্দেশে সব ব্যাঙ হাতির কাছে গিয়ে ‘মেঘ হো’, ‘মেঘ হো’ বলে ডাকাডাকি শুরু করল। ব্যাঙের ডাক শুনে হাতি ভাবলো, ব্যাঙ যেহেতু ডাকছে সেহেতু খুব আশপাশে নিশ্চয়ই পানি পাওয়া যাবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। পানি পাবার আশায় ব্যাঙদের শব্দ শুনে শুনে হাতি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এ সময় কাকলীর নির্দেশে ব্যাঙরা পৌঁছে গেল মস্তবড় এক গর্তের পাশে। সেখানে গিয়ে ব্যাঙরা ‘মেঘ হো’, ‘মেঘ হো’ বলে চিৎকার দিতে দিতে গর্তে লাফিয়ে পড়ল। ব্যাঙের ডাক অনুসরণ করতে গিয়ে হাতিও হুড়মুড় করে পড়ে গেল গর্তে। চোখে না দেখায় শত চেষ্টা করেও আর গর্ত থেকে বের হতে পারলো না। এভাবে হাতিকে উচিত শিক্ষা দিতে পেরে চড়ুই আর ব্যাঙরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
এ গল্পটি নেয়া হয়েছে তেরশ শতকের বিশিষ্ট ইরানী লেখক আহমদ বিন মুহাম্মদ শিরবানীর ‘তোফহাতুল ইয়ামিন’ গ্রন্থ থেকে। #
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।