ঘুঘু দেখেছ,ফাঁদ দেখনি

বাপ মরিয়া গিয়াছে। ঘুঘু আর ফাঁদ দুই ভাই। কি একটা কাজে দুই ভাইয়ের লাগিল মারামারি। ফাঁদ রাগিয়া বলিল,“তুই ঘুঘু দেখিয়াছিস কিন্তু ফাঁদ দেখিস নাই।”

ঘুঘু গোসা করিয়া বাড়ি হইতে পালিয়া গেল।বিদেশে যাইয়া সে এ বাড়ি সে বাড়ি,কত বাড়ি ঘুরিল।আমি ধান নিড়াইতে পারি- পাট কাটিতে পারি-গরুর হেফাজত করিতে পারি কিন্তু কার চাকর কে রাখে! দেশে বড় আকাল।

অবশেষে ঘুঘু যাইয়া উপস্থিত হইল কিরিপন মোল্লার বাড়ি। কিরিপন মোল্লা বাড়ি চাকর রাখিয়া খাইতে দেয় না।
খাইতে দিলেও তার বেতন দেয় না।তাই কেহই তার বাড়িতে চাকর থাকে না। ঘুঘুকে দেখিয়া কিরপন মোল্লা বলিল,“আমার বাড়িতে যদি থাকিতে চাও প্রতিদিন তিন পাখি করিয়া জমি চাষ করিতে হইবে।
বেগুন ক্ষেত সাফ করিতে হইবে।আর যখন যে কাজ করিতে বলিল তাই করিতে হইবে।তেঁতুল পাতায় যতটা ভাত ধরে তাহাই খাইতে দেব।উহার বেশি চাহিলে দিব না।মাসে আট আনা করিয়া বেতন দিব। উহাতে রাজি হইলে আমার বাড়িতে থাকিতে পার।”

আর কোথাও কাজ যখন জোটে না, ঘুঘু তাঁহাই রাজি হইল।

কিরিপন মোল্লা বিলিল,“আমার আরও একটি শর্ত আছে।
আমার কাজ ছাড়িয়া জাইতে পারিবেনা। কাজ ছাড়িয়ে গেলে তোমার নাক কাটিয়া লইব।”

ঘুঘু বলিল,“আমি এই শর্তেও রাজি আছি।”
কিরিপন মোল্লা পাকা লোক। সে গ্রামের লোকজন ডাকিয়া সমস্ত শর্ত একটি কলা পাতায় লিখিয়া লইল।

তিন পাখি জমি চাষ করিতে ঘুঘুর প্রায় দুপুর গড়াইয়া গেল।
তার পর গোছল করিয়া খাইতে আসিল।
কিরপন মোল্লার বউ বলিল,“তেতুল পাতা লইয়া আস।”
ঘুঘু একটি তেঁতুল পাতা নিয়া সামনে বিছাইয়া খাইতে বসিল।
তেঁতুল পাতায় আর কয়টি ভাত ধরে?একে তো সারাকদিন হাড়ভাজ্ঞা পরিশ্রম!এমন ক্ষুধা পাইয়াছে যে সমস্ত দুনিয়া গিলিয়া খাইলেও পেট ভরিবে না।সেই তেঁতুল পাতায় বাড়া চারটি ভাত মুখে দিয়ে ঘুঘু কিরিপন মোল্লার বৌকে কাকুতি মিনতি করিল,
“আর কয়টি ভাত দিন।”কিরপন মোল্লা অমনি তার কলাপাতায় লেখা সর্তগুলি পড়িয়া শুনাইয়া দিল।বেচারা ঘুঘু আস্তে আস্তে উঠিয়া বেগুন ক্ষেত সাফ করিতে গেল।
রাত্তে আবার সেই তেঁতুল পাতায় বাড়া ভাত।তার উপরে আবার হাড়-ভাজ্ঞা খাটুনি। তিন চারদিন থাকিয়া ঘুঘু একেবারে আধমরা হইয়া পড়িল।তখন চাকুরি না ছাড়িলে জীবন যায়;কিন্তু যেই কিরপন মোল্লার কাছে চাকুরি ছাড়ার কথা বলিয়াছে এমনি সে তার নাক টা কাটিয়া ফেলিল।নেকড়া দিয়া কোনরকমে নাক বাঁধিয়া ঘুঘু দেশে ফিরল।

তার ভাই ফাঁদ জিজ্ঞাসা করিল,!তোর নাক টা কাটা কেন?
ঘুঘু কাঁদিয়া সমস্ত ঘটনা খুলিয়া বলিল।শুনিয়া ফাঁদ বলিল,“ভাই!তুই বাড়ি থাক। আমি যাব কিরিপন মোল্লার বাড়িতে চাকুরি করতে।”ঘুঘু কত বারন করল। ফাঁদ তাহা কানেও নিল না।সে বলিল,“কিরিপন মোল্লা ঘুঘু দেখেছে কিন্তু ফাঁদ দেখে নাই।আমি তাহাকে ফাঁদ দেখাইয়া আসিতেছি।”ফাঁদ যাইয়া কিরপন মোল্লার বাড়ি যাইয়া উপস্থিত।“আপনারা কোন চাকর রাখিবেন?”
কিরপণ মোল্লা বলিল,“আমার এক জন চাকর ছিল সে অল্প কয় দিন হয় চলিয়া গিয়াছে।তা তুমি যদি থাকিতে চাও আমার কয়টি শর্ত আছে। তাহা যদি মানিয়া লও তবে তোমাকে রাখিতে পারি।”ফাঁদ জিজ্ঞাসা করিল কি কি শর্ত?”কিরপন মোল্লা কলার পাতায় লেখা আগের চাকরের শর্তগুলি তাহাকে পড়াইয়া শুনাইল।

প্রতিদিন তিন পাখি করিয়া জমি চষীতে হইবে। বেগুন ক্ষেত সাফ করিতে হইবে। আর যখন যে কাজ বলিল তাহা করিবে।তেঁতুল পাতায় করিয়া ভাত দিব।মাসে আট আনা করিয়া বেতন।চাকুরী ছাড়িয়া গেলে নাক কাটিয়া রাখিব।”

ফাঁদ সমস্ত শর্ত মানিয়া লইয়া বলিল,আমারও একটি শর্ত আছে।আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করিতে পারিবে না।বরখাস্ত করিলে আমি তোমার নাক কাটিয়া লইব।”

কিরপণ মোল্লা বলিল,“বেশ,তাহাতেই আমি রাজি।সে পাড়ার আরও দশজনকে ডাকিয়া সাক্ষী মানিয়া আর একখানা কলাপাতায় সমস্ত শর্ত লিখিয়া লইল।
সকালে ফাঁদ চলিল ক্ষেতে নাঙল চষীতে, সে তিন পাখি জমির এদিকে হইতে ওদিকে দিল এক রেখ,আর ওদিক হইতে এদিক দিল এক রেখ।এই ভাবে সমস্ত জমিতে তিন চার টি রেখ দিয়া গরুর বাছুর লইয়া,বেলা দশ টা না বাজিতেই বাড়ি ফিরিয়া আসিল।আসিয়া বলিল,ক্ষেতে নাঙল দেওয়া শেষ হইয়াছে!এখন আমাকে খাইতে দাও।

”কিপণ মোল্লার বউ বলিল “আগে তেঁতুল পাতা লইয়া আস।” ফাঁদ বলিল,“একটি ধামা দাও আর একখানা কুড়াল আমাকে দাও।
”ধামা কুড়াল লইয়া ফাঁদ কিরপন মোল্লার উঠানের তেঁতুল গাছটির বড় ডালটি কুপাইয়া কাটিয়া ফেলিল।

কিরপন মোল্লার বউ চেঁচাইতে লাগিল,“কর কি?

কর কি?সমস্ত গাছ টা কাটিয়া ফেলিলে?”কার কথা কে শোনে।সেই কাটা দাল হইতে মুঠি মুঠি তেঁতুল পাতা আনিয়া অর্ধেক উঠানে বিছাইয়া দিয়া বলিল,“এবার আমাকে ভাত দাও।”
কিরপণ মোল্লার বউ সামান্য কয়টি ভাত তেঁতুল পাতার উপর দিয়া জাইতেছিল। ফাঁদ বলিল,“আমার সঙ্গে চালাকি করিলে চলিবে না,।শর্তে লেখা আছে তেঁতুল পাতায় করিয়া ভাত দিতে হইবে।

কয়টা তেঁতুল পাতায় করিয়া ভাত দিতে হইবে তাহা লেখা নাই।

সুতারাং তোমাদের উঠানে যতগুলি তেঁতুল পাতা বিছাইয়াছি তাহার সবগুলি ভরিয়া ভাত দিতে হইবে।

”কিরপণ মোল্লা তার ভাজ্ঞা চশমা জোড়া লাগাইয়া সেই কলার পাতার লেখা শর্ত গুলি বহুক্ষণ পরীক্ষা করিল।ফাঁদ যাহা বলিয়াছে তাহা সত্য সে তখন বউ কে বলিল,“দাও,হাঁড়িতে যত ভাত আছে তেঁতুল পাতার উপর বাড়িয়ে দাও।

”একবার ভাত দেওয়া হইলে ফাঁদ বলিল, “আরও ভাত আনিয়া দাও।সমস্ত তেঁতুল পাতা ঢাকে নাই।”কিরপণ মোল্লার বউ কি আর করে? হাঁড়িতে যত ভাত ছিল সব ভাত আনিয়া সেই তেঁতুল পাতায় ঢালিয়া দিল।

ফাঁদ বলিল ইহাতে আমার পেট ভরিবে না।আরও ভাত আনিয়া দাও।“আর ভাত হাঁড়িতে নাই!কিরপণ মোল্লা বলিল,“কাল তোমার জন্য আরও বেশি ভাত রাধিব।আজ ইহাই খাও।”
ফাঁদ কতক খাইল-কতক ছিটাইয়া ফেলিল।তারপর ঢেকুর তুলিতে তুলিতে হাত মুখ ধুইতে লাগিল।

বিকালে কিরপণ মোল্লা ফাঁদকে বলিল,বেগুন ক্ষেত সাফ করিতে।ফাঁদ যাইয়া সমস্ত বেগুন গাছ কাটিয়া ফেলিল।

কিরপণ মোল্লা হায় হায় করিয়া মাথায় হাত দিয়া বেগুন ক্ষেতের পাশে বসিয়া পড়িল। ফাঁদকে বলিল,“ও ফাদ!তুই তো আমার সর্বনাশ করিয়াছিস।”

ফাঁদ বলিল, তুমি আমাকে বেগুন ক্ষেত সাফ করিতে বলিয়াছ।সমস্ত বেগুন গাছ না কাটিলে ক্ষেত সাফ হইবে কেমন করিয়া?”

তার পর দিন কিরপন মোল্লা ফাঁদকে পাঠাইল ধান নিড়াইতে।

ফাঁদ ক্ষেতের সমস্ত ধান গাছ কাটিয়া ঘাস গুলি রাখিয়া আসিল।

সে দিন তাকে নদিতে পাঠাইল জাল ফেলিতে।

জাল ফেলিতে মানে নদিতে যাইয়া জাল দিয়া মাছ ধরতে।ফাঁদ সেই কথার উল্টা ব্যাখা করিল।নদীতে যাইয়া সে কিরপন মোল্লার এত হাউসের খেপলা জাল খানি ফেলিয়া দিয়া আসিল।
কিরপন মোল্লা নদিতে যাইয়া এত খোঁজাখুজি করিল।এত বড় নদী কোথায় জাল তলিয়ে গিয়াছে!খুজিয়া বাহির করিতে পারিল না।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা তার ছেলেটি ধুলো
কাঁদা গায়ে মাখিয়া নংটা হইয়াছিল।কিরপন মোল্লা বলিল,“ফাঁদ,যাও তো ছেলেটি সাফ করিয়া আন।”

ফাঁদ তার ছেলেটিকে পুকুরের কাছে লইয়া গিয়া পানিতে ডুবাইয়া ধোপার পাটে দিল তিন চার আছাড়।ছেলের হাত পা ভাজ্ঞিয়া গেল।
সে চিৎকার দিয়া কাঁদিয়া উঠিল। কিরপন মোল্লা তাড়াতাড়ি ফাঁদের হাত হইতে ছেলেকে ছাড়াইয়া লইয়া তাহাকে বকিতে লাগিল।

ফাঁদ বলিল,“আমাকে বকিলে কি হইবে?আপনি ছেলেকে সাফ করিয়া আনিতে বলিয়াছেন।ধোপার পাটে না আছড়াইলে উহাকে সাফ করিব কেমন করিয়া?”
রাত্তে কিরপন মোল্লা আর তার বউ মনে মনে ফন্দি আটে, কি করিয়া এই দুর্মুখা চাকর কে বিদায় করা যায়।কিন্তু কোন উপায় নাই। তাহাকে বরখাস্ত করিলেই কলা পাতায় লেখা অনুসারে সে কিরপন মোল্লার নাক কাটিয়া লইবে।পরদিন সকালে কিরপন মোল্লা ফাঁদ কে একটি বড় গাছ ফাঁড়িয়া চেলা বানাইতে হুকুম করিল।
ফাঁদ গাছ টি কাটিয়া চেলা বানাইল।তারপর চেলার বোঝা মাথায় করিয়া বাড়ি আসিল।কিরপন মোল্লার মা বারান্দাই বসিয়া পান চিবাইতেছিল।ফাঁদ তাহাকে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিল,খড়ির বোঝ কোথায় নামাইব?”

সারা উঠান খালি পড়িয়া আছে।যেখানে সেখানে নামান যায়।তবুও ফাঁদ এই সামান্য ব্যাপারটি জন্য বুড়ির জিজ্ঞাসা করায় বুড়ি ভীষণ রাগিয়া গেল।সে বলিল,“বুঝিতে পারে না কোথায় নামাইতে হইবে?আমার ঘাড়ে নামাও।”

যেই বলা এমনি ফাঁদ খড়ির বোঝা বুড়ির ঘাড়ের উপর ফেলিয়া দিল।বুড়ি দাঁত কেলাইয়া মরিয়া গেল।

কিরপন মোল্লা ফাঁদকে কিছু বলিতেও পারে না।কারণ সে বুড়ির আদেশ মতোই কাজ করিয়াছে।ফাঁদকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিতে গেলেও সে তার নাক কাটিয়া লইবে।ফাঁদ কে নিয়া কি করা যায়? কোন বুদ্ধি না পেয়ে কিরপন মোল্লা ফাঁদের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের পরিকল্পনা করল । প্রস্তাব শুনে ফাঁদ বলল-এই প্রস্তাবে আমি রাজি কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে।কিরিপন মোল্লা জিঙ্গেস করল শর্তটি কি আমাকে বল—আমি যে কোন শর্তে রাজি আছি। তখন ফাঁদ বলল আমাকে আপনার সম্পত্তির অর্ধেক দিতে হবে আর আপনার মেয়ে কখনও তার বাপের বাড়ি আসতে পারবে না, আর আপনারাও কখনও আপনার মেয়েকে দেখতে তার শশুর বাড়ি যেতে পারবেন না।আর কোন উপায় না পেয়ে কিরিপন মোল্লা ফাঁদের সমস্ত শর্ত মেনে নিল আর নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হল ।আর ফাঁদ মহা সুখে দিন কাটাতে লাগল ।

দুঃখিত!