গোলাপ ফুলের ঘ্রান [১ম অংশ]

তাহিয়ার হাতে গোলাপ ফুল দেখে বর্ণা চমকে উঠল।ও অস্ফুট স্বরে বলে,ফুল পেলি কই তুই?তাহিয়া রিনরিনে গলায় বলল,টেবিলের ওপর পেয়েছি।আম্মু তুমিফুলটা নেবে বলে ফুলটা বর্ণার দিকে বাড়িয়ে দেয়।বর্ণা এক পা পিছিয়ে আসে।ভীষণ কাঁপছিল ও।আশ্চর্য! তাহিয়া গোলাপ ফুল পেল কই?এ বাড়ির নীচতলার বাগানে তো গোলাপের ঝাড় নেই।ছাদে কি বারান্দায় গোলাপের টবও নেই। তাহলে?ফুলটা টেবিলের ওপর পেয়েছে বলল।টেবিলের ওপর কে গোলাপ ফুল রাখল? আশ্চর্য! তাছাড়া …না, বর্ণা ওই ব্যাপারটা ভাবতে চায় না..এত বছর পর
কথাটা কি মঞ্জুর কে বলব? না থাক।মঞ্জুর এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত।মাসখানেক হল নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলা সদরে বদলী হয়ে এসেছে।নতুন অফিস সেটআপ করার দায়িত্ব ওর ওপরই।সেই সাত সকালে বেড়িয়ে যায়।ফেরে অনেক রাতে।বর্ণার অবশ্য নিরিবিলি এই মফস্বল শহরটা ভালোই লাগছে। মঞ্জুরের ব্যস্ততা সত্ত্বেও ওরা এরই মধ্যে বেশ কিছু জায়গা ঘুরেও দেখেছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, পতিসর রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি, কুশুম্বা মসজিদ। বলিহার রাজবাড়ি, আলতাদীঘি, হলুদবিহার, আর দুবলহাটি জমিদারবাড়িও দেখার কথা আছে।নতুন জায়গায় সময় বেশ কেটে যাচ্ছে।তাহিয়া এবার ক্লাস থ্রিতে উঠল।ওর স্কুলটা কাছেই। গলির মুখে বড় রাস্তার ওপর। বর্ণাই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসে।নিয়েও আসে। অভিভাবকদের সঙ্গে গল্প-টল্প করে সময়টা ভালোই কেটে যায়।খালি বাড়িতে থাকলে শরীর কেমন শিরশির করে।সকালবেলায় অবশ্য একজন মাঝবয়েসি মহিলা আসে।ঘরদোর পরিস্কার করে দেয়,রান্নাবান্নাও করে।তার সঙ্গে কথা বলে কিছু সময় কাটে। অন্য সময়টুকু পার করে তাহিয়াকে পড়িয়েকিংবা গল্প করে।কিন্তু তাহিয়া গোলাপ ফুল পাওয়ার পর থেকেই সারাক্ষণ গা কেমন ছমছম করছে বর্ণার।
টেবিলের ওপর কে গোলাপ ফুল রাখল?
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।দোতলাএই বাড়িটা বেশ পুরনো।ঘরগুলি বেশ বড় আর অন্ধকার।এক এক করে ঘরের আলো জ্বালালো।তাহিয়া ড্রইংরুমে টিভি দেখছিল।এখন সোফার ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে।আজান শুনতে পেল বর্ণা। মাথায় কাপড় দিয়ে টিভির সাউন্ড কমিয়ে দিল।ঠিক তখনই কলিংবেল বাজল।দরজা খুলে দেখল মঞ্জুর।ওকে দেখেই মঞ্জুর বলল,হ্যাপি বার্থ ডে।
বর্ণা হাসল হাসল।পরক্ষণেই হাসিমুছে গেল।মঞ্জুরের হাতে গোলাপ।মুহূর্তেই বর্ণার মন অস্বস্তিতে ছেয়ে যায়। বলে,আশ্চর্য!ফুল পেলে কই?
টুটপাড়ার মোড়ে একটা ছেলে বিক্রিকরছিল ।ভাবলাম তোমাকে উইশ করব।এই নাও ধরো।
ফুল নিতে নিতে বর্ণা বলল,আরে,আমার জন্মদিন তো কাল।
জানি।বলে মঞ্জুর ঘরে ঢুকল। ব্রিফকেস রেখে চেয়ারে বসল। জিগ্যেস করল,তাহিয়া কখন ঘুমিয়েছে?
এই তো ঘন্টাখানে হল।থাক ঘুমাক।বলে রান্নাঘরে এল বর্ণা। গোলাপ ফুলের দিকে তাকালো। জন্মদিনের প্রথম উপহার।বর্ণা কে কেমন অন্যমনস্ক দেখায়।জন্মদিন এলেই বাবাকে মনে পড়ে যায় ওর ।মেয়ের জন্মদিন নিয়ে বাবার যে কী উৎসাহ ছিল।বাবা নিজেই মেয়ের জন্মদিনের সকালে খেজুরের গুড়ের পায়েস রান্না করতেন।কী চমৎকার রান্নার হাত ছিল বাবার।বর্ণার বান্ধবীরা সব আসত।কী অদ্ভূতসুন্দর ছিল নীলফামারীর সেই মেয়েবেলা। বাবা ছিলেন নীলফামারী জাদুঘরের কিউরেটর। ছেলে আর মেয়েকে কী ভালোই না বাসতেন ।বর্ণা আর অলককে নিয়ে কতজায়গায় যে ঘুরে বেড়াতেন।ধর্মপালের রাজবাড়ি, ময়নামতি দুর্গ,সৈয়দপুরের চিনি মসজিদ,কুন্দুপুকুর মাজার, দুন্দিবাড়ী স্লুইসগেট..মা যে নেই তা মা মরা দুই অনাথ শিশুকে মোটেও বুঝতে দিতেন না।একটা কাঁচের গ্লাসে পানি ভরে তাতে গোলাপ ফুল ভিজিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর এনে গ্লাসটা রাখল বর্ণা।মঞ্জুর জুতা খুলতে খুলতে বলল,কাল ছুটি নিয়েছি,বুঝলে। সকাল-সকাল সোজা আলতাদীঘি ন্যাশনাল পার্ক চলে যাব।সারাদিন ঘুরে বেড়াব।উত্তর না-দিয়ে মঞ্জুরের দিকে অদ্ভূত চোখে তাকালো বর্ণা।সারাশরীর কাঁপছে ওর ফরসা মুখটা আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে।বর্ণা টের পাচ্ছে ওর মাইগ্রেনের ব্যাথাটা ফিরে আসছে
রাত এগারোটার মত বাজে।তাহিয়া বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে। মঞ্জুর বারান্দায়;দিনের শেষ সিগারেট খাচ্ছে।ও ঘরে সিগারেট খায় না।বর্ণা বিছানায় শুয়ে আছে।কপালের দু’পাশের শিরা টিপটিপ করছে।সন্ধ্যার পর থেকে মাথা ধরে আছে ওর।এখনও ছাড়ছে না।দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছে।কাজ হয়নি।সিগারেট শেষ করে মঞ্জুর শোওয়ার ঘরে আসে। বর্ণার পাশে শোয় বিছানায়। বর্ণাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।বর্ণা বলে,কাল আলতাদীঘি না গেলে হয় না মঞ্জুর?
কেন?
এমনি।বরং চলো,কাল আমরা দুবলহাটি জমিদারবাড়ি যাই।ওখানে তো এখনও যাওয়া হয়নি।বাবার মুখে শুনেছি দুবলহাটি জমিদারবাড়ির দালানগুলি নাকি অসাধারণ।
মঞ্জুর বলে,আহা বুঝলাম তো। কিন্তু,দুবলহাটি জমিদারবাড়ি পরে গেলেও তো চলবে।আমার তো এখনই ধামইরহাট থেকে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে না।বর্ণা বলল,সে না হয় বুঝলাম।কিন্তু,শুনেছি,আলতাদীঘি যেতেনাকি কাঁচা রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়।তাহিয়া অত হাঁটতে পারবে না।মঞ্জুর বলল,আহা, তাহিয়া হাঁটতে না পরলে ওকে কোলে নেওয়া যাবে।এতদিন হল ধামইরহাট এসেছি,এখনও আলতাদীঘি ন্যাশনাল পার্ক যাওয়া হল না শুনে অফিসের কলিগরা আমাকে এক হাত নিল।আলতাদীঘির কাছেই এক গ্রামে আমাদের অফিসের একজন স্টাফ এর এক আত্মীয়র বাড়ি।ছেলেটির নাম নাসির।নাসির তাদের টেলিফোন করে জানিয়ে দেবে ওখানেই কাল দুপুরে আমরা খাব।
ওহ।তাহলে সব ঠিক করেই এসেছে বর্ণা খানিকটা ফুঁসে ওঠে বলল।
সাইপ্রাইস!সাইপ্রাইস!মাই ডিয়ার। বলে বর্ণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মঞ্জুর।কানের লতিতে আলতো করে চুমু খায়।বর্ণা চুপ করে থাকে।শরীর শিরশির করছিল। তবে বুকের ভিতর ভীষণ আলোরণও টের পাচ্ছিল।একটু পর মঞ্জুর ঘুমিয়ে পড়ে।বর্ণা জেগে থাকে।অন্ধকার ঘরে গোলাপ ফুলের হালকা গন্ধ।আশ্চর্য!মুখ ফিরিয়ে দেখল-বারান্দার পর্দা বাতাসে নড়ছে।বর্ণার মনে হল পর্দার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়ে…..
আলতাদীঘি ন্যাশনাল পার্কটা ধামইরহাট উপজেলা সদরের ৫ কিলোমিটার উত্তর দিকে।একটা ব্রিজের পর কাঁচা রাস্তা।রাস্তার দু’পাশে বাঁশঝাড় আর গাছপালা।লালমাটির উচুঁ-নীচু রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটার পর দু’পাশে ঘন শালবন চোখে পড়ে।তবে শালবনে রোদ সরাসরি পড়েনি।লতাপাতায় জড়িয়ে মাটিতে পড়েছে।দেখে মনে হয় যেন লাল মাটিতে জ্যোত্‍স্না বিছানো।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!