মঞ্জুর হাত তুলে মেয়েকে বলল, ওই যে দেখ মা। কী সুন্দর।
তাহিয়া লাল মাটির ওপর রোদের চিকড়ি-মিকড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ। অনেক সুন্দর বাবা।
বর্ণা আজ কালো রঙের জামদানী পড়েছে। বার্থ ডে গিফট। মঞ্জুর আগেই কিনে রেখেছিল। শাড়িটা বর্ণার গায়ের ফরসা রঙের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছে। আশেপাশের মেয়েরা ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল।
তাহিয়া বেশ টইটই করেই হাঁটছিল।বর্ণা খানিকটা অবাক। তবে আজ সকালে টেবিলের ওপর গোলাপ পায়নি বলে খানিকটা নিশ্চিন্ত।মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও সেরে গেছে ওর।তাহিয়া হাত তুলে বলল,ওটা কি বাবা?
কোনটা মা?
ওই যে,অনেক উঁচু,আর লাল রঙের।
ওহ্।ওটা?বুঝেছি।ওটা হল উইপোকার ঢিবি।বলে মঞ্জুর ওর প্যানাসনিকটা দিয়ে উইপোকার ঢিবির একটা স্ন্যাপ নেয় ।তারপর হঠাৎই অফিসের এক কলিগের কথা মনে পড়তেই বলল,জানো তাহিয়া বৃষ্টি পড়লেও না ওই উইপোকার ঢিবি নষ্ট হয় না।
সত্যি?
হ্যাঁ।সত্যি।
আলতাদিঘীর সবচে কাছের গ্রামটির নামও আলতাদিঘী। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িই মাটির ।অনেক বাড়িই আবার দোতলা। ছবির মতন পরিষ্কার নিকানো উঠান।শীত পড়তে শুরু করেছে। আকাশ ধূসর।দূরের দিগন্তরেখায় এই সকালেও কুয়াশার ঘের।
মঞ্জুরের অফিসের স্টাফ নাসিরের আত্মীয়র বাড়িটিও দোতলা। অবস্থা বেশ স্বচ্ছল বলেই মনে হল।নাসিরের এক খালাতো ভাইয়ের নাম সাঈদ।নওগাঁ কলেজে পড়ে।যত্ন করে বসিয়ে গুড়ের সন্দেশ আর পেঁপের শরবত খেতে দিল সে।সাঈদই ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সব দেখাল।গ্রামের পরই শালবন ঘেরা আলতাদীঘি।টলটলে কালো জলের বিশাল দীঘি।দেখে অনেক প্রাচীন বলে মনে হয়।দীঘির জলে পদ্মফুল চোখে পড়ে ।একটি দুটি হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে।তাহিয়া হাত তুলে দেখিয়ে বলল, বাবা দেখ। কী সুন্দর পাখি।
সাঈদ হেসে বলল,ওগুলি হল অতিথি পাথি।শীত পড়তে শুরু করেছে বলে আসতে শুরু করেছে।
আলতাদীঘির টলটলে কালো জলের বিস্তার দেখে বর্ণার শরীর শিরশির করতে থাকে।যে জলসম্ভারকে ও ভয় পায়, ঘৃনা করে-কখনও ভাবেনি সেই জলের সম্ভারের পাশে একদিন এসে ও দাঁড়াবে।
আলতাদীঘির দৈর্ঘ্য কত হবে জান সাঈদ? মঞ্জুর জিজ্ঞেস করে।
সাঈদ বলল এক কিলোমিটারের মতন হবে স্যার। ওই যে, ওই দিকে ইন্ডিয়ার বর্ডার।
ওয়াও।
দীঘিতে নৌকা আছে। দাঁড়টানা নৌকা। মঞ্জুর ওদের নিয়ে নৌকায় উঠতে চাইল। বর্ণা কিছুতেই নৌকায়উঠবে না।
মঞ্জুর বলল, থাক, তাহলে।
ও লক্ষ করেছে আলতাদীঘির পাড়ে আসার পর থেকেই বর্ণা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।
দুপুরের সাঈদদের বাড়িতে কালোজিরার ভর্তা, নিরামিষ, লেবু-নারকেল দিয়ে হাঁসের তরকারী, আমের টক আচার আর দই খেয়ে সন্ধ্যের আগেই ধামইরহাট শহরে ফিরে এল ওরা ।
রাতে শোওয়ার ঘরে গোলাপ ফুলের হালকা ঘ্রান পেল বর্ণা। নিমিষে মনটা অস্বস্তিতে ছেয়ে যায়। ঘরে আবছা অন্ধকার। তাহিয়া বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে। মঞ্জুর বারান্দায়। সিগারেট খাচ্ছে।
গোলাপ ফুলের ঘ্রান এই মুহূর্তে ঘন হয়ে উঠেছে। বর্ণা চোখ বন্ধ করে। বিশাল প্রাচীন আলতাদীঘির টলটলে কালে জলের বিস্তার ভেসে ওঠে। ও কেঁপে ওঠে। দীঘির জলের পদ্মবনের নীচে একটি বালকের লাশ।ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
ঠিক তখনই মঞ্জুর ফিরে আসে। বর্ণার পাশে শোয় বিছানায়। বর্ণাতামাকের গন্ধ পায়। ও ফিসফিস করে বলে, মঞ্জুর?
বল।
আজ আমি আলতাদীঘি যেতে চাইনি কেন জান?
কেন?
অলক নামে আমার এক ভাই ছিল। ও যখন স্কুলে পড়ত … ক্লাস সেভেনে। আমিসে বছর এসএসসি দেব। আলতাদীঘি পিকনিকে এসেছিল অলক।
তারপর?
বর্ণা চুপ করে থাকে।অন্ধকারে গোলাপ ফুলের ঘ্র্রান পায়।
তারপর কি হল? মঞ্জুরের কন্ঠস্বরকেমন অসহিষ্ণু শোনায়।
বর্ণা জিগ্যেস করে, তুমি … তুমি ঘরে গোলাপ ফুলের গন্ধ পাচ্ছ মঞ্জুর?
হ্যাঁ।
অলক ভোরবেলা আমায় গোলাপ ফুল এনে দিত । আমাদের নীলফামারীর বাড়িটাছিল অনেক পুরনো । পিছনে কালীবাড়ির মাঠ, তারপর প্রতিমা বিদ্যানিকেতন। আমি অবশ্য ওই স্কুলে পড়িনি। বাবা ছিলেন নীলফামারী জাদুঘরের কিউরেটর … অলক গোলাপ ফুল ভালোবাসত। ও ভোরবলা
কালীবাড়ির মাঠ পেরিয়ে কই যেন চলে যেত। ভালো করে রোদ ওঠার আগেইগোলাপ ফুল নিয়ে ফিরে আসত। … ও কোথায় গোলাপফুল পেত তা কখনও বলেনি, জিজ্ঞেস করলে হাসত কেবল…ও ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে আলতাদীঘিতে পিকনিকে গেল। বাবা ওকে ছাড়তের না। অলক পড়ত দীনবন্ধু হাই স্কুলে। ওই স্কুলের বাংলার শিক্ষক অজিত স্যার ছিলেন বাবার বন্ধু ।
তারপর?
তারপর অলক … অলক আলতাদীঘি ডুবে মারা যায়। ও … ও নৌকা থেকে পড়ে গিয়েছিল। ওর … ওর লাশ পাওয়া যায়নি।
ওহ্ ।
বর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, অলকের মৃত্যুর পর আমিমানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সেই প্রথম মাইগ্রেনের ব্যাথা টের পেলাম। কোনওমতে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। বাবাও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতেন না। ভাগ্যিস সেসব দুঃসহ দিনে অজিত স্যার আমার পাশে ছিলেন । তারপর … তারপর অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটতে লাগল।
কী!
আমি আর বাবা ঘরে গোলাপ ফুলের গন্ধ পেতাম।আর আর মনে হত ঘরের মধ্যে কে যেন অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। একে অলক -এর শোক, তার ওপর অশরীরীর উৎপাত।আমাদের দিনগুলি রাতগুলি অসহ্য হয়ে উঠছিল … যা তোমাকে বোঝাতে পারব না। অজিত স্যার এক তান্ত্রিক ডেকে এনেছিলেন। লাভ হয়নি। বরং অশরীরীর উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। বাবা অতিষ্ঠ হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তারপর আমরা বগুড়ায় চলে এলাম।
তারপর?
তারপর আর গোলাপ ফুলের গন্ধ পাইনি, অশরীরীর উৎপাতও হয়নি। গতকালই অনেক দিন পর তাহিয়ার হাতে গোলাপ ফুল দেখে চমকে উঠলাম।তাহিয়ার হাতে!মানে?
হ্যাঁ। কাল দুপুরে।
তুমি তখন অফিসে।আমি ওকে বললাম ফুল পেলি কই?ও বলল, টেবিলের ওপর পেয়েছি।অলকও আমার ঘরের টেবিলের পর গোলাপ ফুল রেখে যেত যখন যখন ও বেঁচে ছিল।ও যখন মরে গেল তখনও টেবিলের ওপর গোলাপ ফুল দেখতাম ।
আমার মনে হল পর্দার ওপাশে বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে …
মঞ্জুর মাথা তুলে বারান্দার দরজার দিকে তাকালো।
বর্ণা চাপাস্বরে বলে, তোমার…তোমার কি মনে হচ্ছে পর্দার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে?
হ্যাঁ।
বর্ণা ফিসফিস করে বলল, আমাদের এখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে মন্জুর ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।