গোঁসাই বাগানের ভুত — শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বুরুন সব বিষয়ে ভাল কিন্তু অঙ্কে সে গোল্লা। এবার পরীক্ষাতে সে অঙ্কে ১৩ পেয়েছে। এতে বাড়ির সবাই তার উপর অভিমান। তার বাবাতো রেগেমেগে আগুন। এমনটি তার বোনও তার সাথে কথা বলে না, খেলতে যাওয়া নিষেধ। বুরুনের নিজের কাপড় নিজেকেই ধুতে হয়। ঘর পরিস্কার করতে হয়, ভাত বেড়ে খেতে হয় আরও কত কি! এতো অবহেলা সহ্য করা যায় না। মনের দুঃখে বুরুন গেল গোঁসাইবাগানে। সাধারনত মন ভাল থাকলে বুরুন সেখানে যেত না। আজ তার মৃত্যুর ভয় নেই। সাপে কাটলেই কি আর বিছাতে কাটলেই কি। ঘনজঙ্গলের অনেক ডালপালা পেরিযে বনের অনেক গভীরে একটা পুকুর পাড়ে গিয়ে সে পৌছেছে। পুকুরের পাড়েই একটা কুল গাছ থেকে বুনো কুল পেরে খাচ্ছে। মনটা তার ভাল নেই। হঠাৎ সে দেখে পুকুরের ওপারে একটা মানুষ দাড়িয়ে আছে। বুরুন ভাবল, এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে মানুষ কোথা থেকে এল রে বাবা। কিন্তু বুরুনের তাতে কোন ভ্রক্ষেপ নেই। মানুষ থাকলেই বা তাতে তার কি এসে যায়!
কিছুক্ষন পর মানুষটা পুকুরের জলের উপরে পা ফেলে বুরুনের দিকে আসতে লাগল। লোকটি জলের উপর দিয়ে হাঁটছে কিন্তু পা জলে ভিজছে না। বুরুন অবাক হলো, সে বিজ্ঞান ক্লাসে জেনেছে গ্রাভিটির কারনে জলের উপর দিযে হাঁটা অসম্ভব। কিন্তু লোকটি দিব্যি হাঁটতে। যাই হোক, বিজ্ঞানের যে আরও কত কিছু জানার বাকি আছে, কেই বা জানে। সে ঘটনাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে আবার কুল গাছ থেকে কুল পেরে খেতে লাগল।
লোকটি বুরুনের সামনে এসে ইয়া বড় বড় দাঁত বের করে এক গাল হেঁসে বলল, “কি খোকা, ভয় পেয়েছ?”
বুরুন একটু অবাক হয়ে বলে, “ভয়? না, ভয় পাব কেন?
“পাওনি?” এবার লোকটাই অবাক।
“না, ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি শুধু সায়েন্সের কথা ভাবছিলাম, মনে হয় সায়েন্স এখনো অনেক কিছু জানে না।?
“তা বটে।” বলে লোক একটু হেসে লোকে যেমন টুপি খোলে, ঠিক সেভাবে নিজের মাথাটা ঘাড় থেকে তুলে এনে হাতে নিয়ে একটু ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করল চাঁদির জায়গাটা, তারপর মুন্ডুটা আবার যথাস্থানে লাগিয়ে বলল, “মাথায় খুব উকুন হয়েছে কিনা, তাই চুলকাচ্ছে।”
“ও।” বুরুন বলে।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলে, “কী ব্যাপার তোমার বল তো! এবারও যে বড় ভয় পেলে না?”
বুরুন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আপনার মাথায় উকুন হয়েছে আর চুলকোচ্ছে বলে আমার ভয় পাওয়ার কী আছে?”
লোকটা রেগে গিয়ে বলল, “তুমি ভাবছ আমি তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছি?”
“হতে পারে”
লোকটা হঠাৎ ডান হাতটা ওপর দিকে তুলল। বুরুন দেখল, হাতটা লম্বা হয়ে একটা চালতা গাছেল মগডালে চলে গেছে। পরমুহূর্তে একটা পাকা চালতা পেড়ে এনে লোকটা বুরুনের সামনে ফেলে দিয়ে বলল, “দেখলে?”
বুরুন বিরক্ত হয়ে বলে, “না দেখার কী? চোখের সামনেই তো পাড়লেন।”
লোকটা ধমকে উঠে বলে, “তবে ভয় পাচ্ছ না যে!”
“ভয় না পেলে কী করব?” এই বলে বুরুন থোকা থেকে কয়েকটা কুল ছিঁড়ে মুখে ফেলল।
লোকটি ভারি আঁশটে মুখ করে বলল, “লজ্জা করছে না কুল খেতে? চোখের সামনে জলজ্যান্ত আমাকে দেখতে পেয়েও নিশ্চিন্ত মনে কুল খাওয়া হচ্ছে? আরো দেখবে? অ্যাঁ!”
বলে লোকটা হঠাৎ ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতটা খুলে চারদিকে তলোয়ারের মতো ঘোরাতে লাগল; তারপর বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত খুলে নিল। দুটো পা দু’হাতে খুলে নিয়ে দেখাল। তারপর একবার অদৃশ্য হয়ে ফের হাজির হল। তেরো-চোদ্দ ফুট লম্বা হয়ে গেল আবার হোমিওপ্যাথির শিশির মতো ছোট্ট হয়ে গেল। এসব করে হাঁফাতে হাঁফাতে আবার আগের মতো হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দেখলে?’
“হুঁ!”
“হুঁ মানে? এ-সব দেখাও পরও মূর্ছা যাচ্ছ না যে! দৌড়ে পালাচ্ছ না যে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুল খেয়ে যাচ্ছ যে বড়! আমি কে জান?”
“কে?”
“আমি গোসাঁই ডাকাতের বড় স্যাঙাৎ নিধিরাম। দুশো বছর ধরে এখানে আছি, বুঝলে? দুশো বছর।”
‘বুঝলাম।”
“কী বুঝলে?”
বুরুন বিরক্ত হয়ে বলে, “এসব তো সোজা কথা। বোঝাবুঝির কী আছে! আপনি দুশো বছর ধরে এখানে আছেন।”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “তুমি বাপু তলিয়ে বুঝছ না। দুশো বছর কি কোন মানুষ বেঁচে থাকে বলো!”
“তা থাকে না।”
“তবে আমি আছি কী করে?”
“থাকলে আমি কী করব?”
লোকটা রেগে উঠে বলল, “তবু তুমি তলিয়ে বুঝছ না কিন্তু। আমি আসলে বেঁচে নেই।”
বুরুন আর একটা কুল মুখে নিয়ে বলে, “তাতে আমার কী?”
“ওঃ, খুবই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছ যে! ভূতকে ভয় পাওনা, কেমনতরো বেয়াদব ছেলে হে তুমি!”
বুরুন বলল, “ভয় লাগছে না যে।”
এই কথা শুনে লোকটার চেহারা ভারি করুণ হয়ে গেল। অসহায়ভাবে ছলছলে চোখে চেয়ে রইল বুরুনের দিকে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!