গিভিং ট্রি–রুপকথার গল্প

গিভিং ট্রি

অনেকদিন আগে একটা গাছ ছিল। একটা ছোট ছেলে প্রতিদিন সেই গাছের কাছে আসত। আর গাছতলায় পরে থাকা পাতা কুড়িয়ে সে নানান ধরনের খেলনা বানাত। কখনো বানাত চশমা, কখনো ঘড়ি, কখনো মুকুট। ছেলেটা সেই পাতার মুকুট মাথায় দিয়ে রাজা সাজত। যেন সে মাঠের রাজা, আর গাছটা তার রাজপ্রাসাদ। কখনো কখনো ছেলেটা গাছ বেয়ে উপরে উঠত, খেলত, আবার কখনো গাছের ডাল ধরে দোল খেত। আর ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে গাছের ছায়ায় ঘুমাত।

গাছটা ছেলেটাকে অনেক পছন্দ করত।

ছেলেটাও গাছটাকে ভালবাসত।

দিন চলে যায়। ছোট ছেলেটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে। তার অনেক সঙ্গী-সাথি জোটে। সে তাদের নিয়ে শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। আর এদিকে গাছটা খুব একা হয়ে পড়ে।

অনেকদিন পরে ছেলেটা আবার গাছের কাছে এল। তাকে দেখে গাছটা খুশি হয়, বলে, এসো খোকা, আমার ডালে দোল খাও, আমার ছায়ায় খেলা কর! পাতার মুকুট বানাবে? দেখ, আমার ডালে কত আম ধরেছে এইবার! ইচ্ছে হলে কিছু আম পেড়ে খাও, আমি তোমাকে প্রাণ ভরে দেখি।

ছেলেটা বলল, আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। এখন আর গাছে চড়তে ভাল লাগেনা আমার। একা একা খেলতেও ভাল লাগেনা। আমাকে কিছু টাকা দিতে পার? টাকা দিয়ে কেনাকাটা করব, বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করব। দেবে কিছু টাকা?

গাছ বলল, আমার কাছে যে টাকা নেই খোকা! আমার আছে পাতা, আর কিছু আম। ইচ্ছে হলে, আমার আমগুলো পেড়ে নিয়ে বাজারে বিক্রি কর। ওই টাকা দিয়ে তুমি হয়ত অনেক কেনাকাটা করতে পারবে, বন্ধুদের জন্য খরচও করতে পারবে। আমি বলি কী, আমগুলো পেড়ে নাও খোকা। এবারের ফলগুলো তোমাকেই দিলাম। তুমি সুখী হলে আমারও খুব ভাল লাগবে খোকা।

ছেলেটা গাছ থেকে সব আম পেড়ে নিয়ে গেল। ছেলেটাকে কিছু দিতে পেরে গাছটা খুব খুশি হল।

এরপর দিনের পর দিন চলে যায়। ছেলেটা আর গাছের কাছে আসেনা। গাছটা ছেলেটার কথা ভাবে, আর মন খারাপ করে।

এভাবে কয়েক বছর কেটে গেলে- ছেলেটা আবার গাছের কাছে একদিন ফিরে আসে। সেই পুচকে ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গেছে এখন।

ছেলেটাকে দেখে গাছটা খুব খুশি হল, বলল, এসো খোকা, আমার ছায়ায় একটু জিরিয়ে নাও।
গাছের কথা শুনে ছেলেটা বলল, বিশ্রামের সময় নেই আমার। আমি খুব ব্যস্ত। শোন গাছ, আমি বিয়ে করেছি, আমার এখন একটা ঘর দরকার। তুমি আমাকে একটা ঘর দাও।
গাছ বলল, আমার যে কোনো ঘর নেই সোনা! এই বনই আমার ঘর। এই খোলা মাঠই আমার সংসার।

ছেলেটা মন খারাপ করতে পারে, এই ভেবে গাছটা আবার বলল, খোকা, এক কাজ কর, আমার ডালগুলো কেটে একটা ঘর বানাও। তোমার নতুন সংসারে আমার শুভেচ্ছা থাকবে সব সময়।

ছেলেটা গাছের সব ডালপালা কেটে নিয়ে গেল।

মাঠের মাঝখানে ডালপালাহীন গাছটাকে খুব অদ্ভূত লাগল দেখতে।

আবার দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; ছেলেটা গাছের কাছে আর আসেনা। সেই অদ্ভূত গাছটা মন খারাপ করে থাকে। এখন তার কোনো সঙ্গী নেই। ডাল নেই বলে পাখিরাও তার কাছে আসেনা।

অনেক অনেকদিন পর ছেলেটা আবার গাছের কাছে ফিরে এলো। এখন ছেলেটার আরো বয়স বেড়েছে। চুলে পাক ধরেছে, একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেও হয়তো। শেষবার গাছটা যখন ছেলেটাকে দেখেছিল, তখন সে ছিল তরুন আর ছটফটে। আর এবার- বয়স যেন ছেলেটার কাঁধে চেপে বসেছে।

ছেলেটাকে দেখে গাছটা ফিসফিস করে বলল, কেমন আছো খোকা? মন খারাপ কেন?
ছেলেটা বলল, আমার কিছু ভাল লাগেনা।
গাছ বলল, তাহলে আমার পাশে এসে একটু বসে থাক, হয়তো তোমার ভাল লাগবে।
ছেলেটা বলল, বললাম তো, এখন আমার কিছুই ভাল লাগেনা। আমি তোমাদের সবার কাছ থেকে দূরে যেতে চাই, অনেক অনেক দূরে। তুমি আমাকে একটা নৌকা দিতে পার?

ছেলেটার কথা শুনে গাছটা মন খারাপ করল। তারপর বলল, আমাকে কেটে একটা নৌকা বানাও। তারপর যেখানে মন চায় চলে যাও। সোনা আমার, তুমি সুখী হলে আমার ভাল লাগবে।

তারপর ছেলেটা গাছটাকে কেটে ফেলল। সে নৌকা বানিয়ে অনেক দূরে যেতে যায়, যেখানে শান্তি আছে, আনন্দ আছে।

গাছটা কেটে ফেলার পর, একটা গুড়ি শুধু পড়ে রইল মাঠের মাঝখানে। ডালপালাহীন গাছটাকে এক সময় খুব অদ্ভূত লাগত, এইবার গাছহীন মাঠটাকে কেমন কিম্ভূত লাগল।

অনেক দিন পরে ছেলেটা আবার ফিরে এল গাছের কাছে।
গাছটা বলল, সোনা আমার, তোমাকে যে দেবার মতো আর কিছু নেই আমার! আমার কাছে আজ সামান্য কোনো ফলও নেই।
ছেলেটা বলল, আমি আর ফল খেতে পারিনা। আমার দাঁতগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে।
গাছটা বলল, আমার ডালপালাও নেই যে, তুমি তাতে দোল খাবে।
ছেলেটা বলল, আমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছি। ঠিক মতো হাঁটতেই পারিনা, আর গাছে চড়ব!
গাছটা বলল, আমার কোনো পাতাও নেই যে, তুমি তা নিয়ে ছোটবেলার মতো খেলবে।
ছেলেটা বলল, আর খেলতে ইচ্ছা করেনা আমার।
গাছটা বলল, ইস, আমার যে এখন আর কিছুই দেবার নেই তোমাকে! আমি পোকায় খাওয়া গাছের গুড়ি ছাড়া আজ আর কিছুই নই।
ছেলেটা বলল, এখন আর তেমন কিছুর দরকারও নেই আমার। শুধু ইচ্ছা করে, আমি যদি নির্জন কোথাও বসে একটু বিশ্রাম নিতে পারতাম আজ! আমি খুব ক্লান্ত।
গাছটা বলল, এসো খোকা, আমার গুড়িতে এসে বস। একটু জিরিয়ে নাও।

ছেলেটা গাছের গুড়িতে এসে বসল। আর গাছটা অনেক অনেকদিন পরে খুব খুশী হল।

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!