গাজা দিবস

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভাল ও সুস্থ আছো। তোমরা ভাল থাকলেও আজ আমরা পৃথিবীর এমন এক জনপদের কথা বলবো-যেখানকার শিশুরা ভাল নেই। তারা তোমাদের মত সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ তো পাচ্ছেই না বরং প্রতিনিয়ত ভয় ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। তাদের কেউ কেউ বড় হবার সুযোগই পাচ্ছে না। তার আগেই হায়েনার গুলি তাদের মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। মুক্ত আকাশের স্বাদ উপভোগ করার আগেই ইহুদীবাদীদের বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছে এসব শিশুর বুক। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো যে, আমরা কাদের কথা বলছি? হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই ধরেছে আমরা ফিলিস্তিনী শিশু-কিশোরদের কথা বলছি। বর্তমান দুনিয়ায় তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই।

ফিলিস্তিনের কথা আসলেই সবার আগে চলে আছে অবরুদ্ধ গাজার কথা। ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এ জনপদে প্রায় পনের লক্ষ মানুষ বাস করে। ইহুদিবাদী ইসরাইলের লক্ষ্য হচ্ছে গাজা থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দিয়ে ইহুদিদের সেখানে পুনর্বাসন করা। ২০০৫ সালে একবার তারা সে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গাজাবাসীদের প্রতিরোধের কারণে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর ২০০৮ সালের ২৭শে ডিসেম্বর গাজা উপত্যকায় নৃশংস হামলা শুরু করে ইসরাইল। ওই হামলায় নারী শিশুসহ প্রায় দেড় হাজার মানুষ শহীদ এবং সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আহত হন। ইসরাইলী বর্বর সেনারা আড়াই হাজারের মতো ঘরবাড়ি ধ্বংস করে; গুঁড়িয়ে দেয় জীবনধারণের সব অবকাঠামো। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এত কিছু করেও ইসরাইলী বাহিনী তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধের মুখে ইসরাইল তার সেনা বাহিনীকে গুটিয়ে নেয় এবং একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। দিনটি ছিল ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি। সেদিন থেকেই ১৮ই জানুয়ারি হচ্ছে ফিলিস্তিনীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধের গুরুত্বকে বিবেচনা করে মুসলিম দেশগুলোর আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন ১৮ জানুয়ারিকে ‘গাজা দিবস’ ঘোষণা করেছে। ২০১০ সালে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়নের বৈঠকে ১৮ জানুয়ারিকে ‘গাজা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য প্রস্তাব করেন ইরানের পার্লামেন্ট স্পিকার আলী লারিজানি। মুসলিম দেশগুলো তা গ্রহণ করার পর থেকে প্রতিবছরের ১৮ই জানুয়ারি ‘গাজা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তো, গাজা দিবস উপলক্ষে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি।

গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসনে শহীদ ফিলিস্তিনীদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে শিশু ও নারী। শিশু ও নারী মৃত্যুর এ উচ্চহার প্রমাণ করে যে, বর্বর ইসরাইলী বাহিনী বেসামরিক লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে হামলা শুরু করেছিল। জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে ইসরাইলী সেনাদের বোমাবর্ষণ এ নির্মম বাস্তবতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। গাজায় ইসরাইলের সর্বাত্মক হামলার পর ওই স্কুল ভবনে প্রায় ১৬০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। ইসরাইলকে আগেই জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলো সম্পর্কে তথ্য জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তারা ইচ্ছে করেই সেখানে বোমা হামলা চালায়।

শুধু তাই নয়, ইহুদীবাদী সেনারা গাজার অধিবাসীদের ওপর হোয়াইট ফসফরাসসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করে। এসব হামলার খবর টেলিভিশনের পর্দায় প্রচার হলেও মানবাধিকারের রক্ষক বলে পরিচিত আন্তর্জাতিক সমাজ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে নীরব ছিল ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর শাসকরা। তবে এদের মধ্যে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসনি মুবারক, সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ ও জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ ভূমিকা ছিল সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। হুসনি মুবারক গাজার সাথে একমাত্র আরব দেশ মিশরের রাফা ক্রসিং বন্ধ করে দিয়ে সেখানকার ফিলিস্তিনীদের জন্য জরুরী খাদ্য ও ত্রাণ সরবরাহের পথ রুদ্ধ করে দেন।

ফিলিস্তিন ও মিশরের জনগণসহ গোটা আরব বিশ্বের জনগণ এবং মুসলিম উম্মাহ গাজার ওপর ভয়াবহ ইসরাইলী আগ্রাসনের সময় রাফা ক্রসিং খুলে দেয়ার আহবান জানান।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট হুসনি মুবারক অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে ঘোষণা করেন, একমাত্র ইসরাইল অনুমতি দিলেই তিনি রাফা ক্রসিং খুলে দেবেন।
মুবারকের পর সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ এবং জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ’র নাম সামনে চলে আসে যারা গাজায় ইহুদীবাদীদের ভয়াবহ তান্ডবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ নীরবতা পালন করেছিলেন।
কেবল নীরব থেকেই ক্ষান্ত হননি, ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা করার আহ্বান জানানো হলে সৌদি আরব ও জর্দান তা বানচাল করার চেষ্টা করে।
এর মাধ্যমে তাদের বিশ্বাসঘাতক চেহারা আরব ও মুসলিম বিশ্বের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
আরব শাসকদের ভূমিকা মুসলমানদের হতাশ করলেও আশার কথা হচ্ছে, সকল ষড়যন্ত্র, অসহযোগিতা ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং জয় ছিনিয়ে এনেছে।
ফিলিস্তিনীদের এ জয়ের পেছনে সেখানকার শিশু-কিশোরদের আত্মত্যাগ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আসরের এ পর্যায়ে আমরা দুঃসাহসী দুই ফিলিস্তিনী শিশুর কাহিনী শোনাবো।
প্রথম শিশুটির নাম ফারিস উদেহ। ১৩ বছর বয়সী ওই শিশু ২০০০ সালের ২৯ অক্টোবর গাজার কারনি ক্রসিং-এর কাছে ইসরাইলী একটি ট্যাঙ্কের সামনে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে যায়।
ট্যাংক লক্ষ্য করে পাথরটা ছুঁড়ে ওই কিশোর ইসরাইলীদের জানিয়ে দেয়, ‘তোমাদের অস্ত্রের চেয়ে আমাদের সাহস অনেক শক্তিশালী।’
এ দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করেন বার্তা সংস্থা এপির ফটোগ্রাফার লরেন্ট রেবুর্স। অসীম সাহসী ঐ শিশুর ছবিটি সে সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
কিন্তু ইসরাইলী সেনারা ঐ ঘটনার ১০ দিন পর ফারিস উদেহকে খুঁজে বের করে এবং গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এ পর্যায়ে আমরা এমন এক শিশুর শাহাদাতের কাহিনী শোনাবো-যার মৃত্যুর কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।
২০০০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর দুপুর বেলায় জামাল আদ্‌ দোরা নামের ১০ বছর বয়সী এক শিশু যখন তার পিতার সাথে বাড়ি ফিরছিলেন তখন ইসরাইলী সেনাদের সাথে ফিলিস্তিনী যোদ্ধাদের সংঘর্ষ চলছিল।
তারা যখন গাজা উপত্যকার নেটজারিম জংশন এলাকায় পৌছে তখন ইসরাইলী সেনাদের সামনে পড়ে যায়। আদ দোরাকে বাঁচানোর জন্য তার পিতা একটি দেয়ালের পাশে অবস্থান নেয় ।
ইসরাইলী সেনাদের ভয়ে আদ দোরা তার পিতার পেছনে লুকায়। কিন্তু তারপরও পাষন্ড ইসরাইলী সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে পিতাও গুলিবিদ্ধ হন।
পিতার সামনেই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় ১০ বছর বয়সী পুত্রকে। সেদিন তাদের চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও ইসরাইলী সেনাদের মনে এতটুকু দয়ার উদ্রেক হয়নি।
গাজা দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আমরা বলতে চাই, ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-কষ্টে শরীক হওয়া এবং ইহুদিবাদীদের কবল থেকে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড উদ্ধারের ব্যাপারে সবাই এগিয়ে এলেই এ দিবসের আয়োজন তা সার্থক হবে।

শেয়াল ও মুরগি

ভালুক ও কাঠবিড়ালী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *