গল্পঃ ফোঁড়া

মিরাজের ছোট্ট রোজকার জীবনে ছোট্ট একটা পরিবর্তন এসেছে! বাসার কেউ খেয়াল করেনি, করার মত ফুসরত মা হারা সাত ভাই-বোনের এই টানাটানির সংসারে নেই্, সংসারের চাকাটা সচল রাখতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন বাবা। তাই পঞ্চম শ্রেণীর একটি বালক বিকেল বেলা মাঠে না গিয়ে বই-খাতা নিয়ে পিছনের বিল্ডিংয়ের হাবিবদের বাসায় যাওয়াটা নীরবেই চলতে থাকে। হাবিবের মা হাবিবকে কলোনীর দুষ্ট ছেলেদের সাথে মিশতে দিবেন না, কিন্ত্তু মিরাজের ব্যাপারটা আলাদা। ক্লাসে মিরাজ ১ম,হাবিব ৩য় আর আবদুল হাই ২য়। ক্লাসে, টিফিনে, স্কুলে আসা-যাওয়া, তিন জন একসাথে। মিরাজ বাসা থেকে বেরিয়ে তিন নম্বর বিল্ডিংয়ে গিয়ে হাবিবকে ডাকে, দোতলা থেকে নেমে ওরা দুজন চার নম্বর বিল্ডিং পেরিয়ে কলাবাগান ১ম লেনে এসে হাইকে নিয়ে কলাবাগান ২য় লেনে যায়;১২টা-৪টা স্কুল শেষে তিন জন আবার এক সাথে ফেরে। তার পর মিরাজ নাকে-মুখে কিছু গুঁজে দুই নম্বরের মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলায় মাততো আর হাই ওর ১ম লেনের বন্ধুদের সাথে। বেচারা হাবিব জানলার গ্রিল ধরে তিন নম্বরের মাঠের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকত। মার নিষেধ-দুষ্ট ছেলেদের সাথে মিশো না। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে হাবিব জোর করেই ওদের বাসায় নিয়ে গেল। ওর মা খুব যত্ন করে ওদের বিস্কুট খেতে দিল।এই লিটন, টেবিলে আয়, বলে হাবিবের সিক্সে পড়ুয়া ভাইকে ডাকল।এত সুস্বাদু বিস্কুট মিরাজ আগে কখনো খায়নি, নিজের অজান্তেই বেশ কয়েকটা খেয়ে ফেলল।হাবিবের মা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে টিন থেকে আরো বিস্কুট প্লেটে দিয়ে বললেন:
–লজ্জা করো না বাবারা, নিজের বাসা মনে করে খাও।
খেতে খেতে উনি হাইদের পরিবার সম্বন্ধে জানলেন, মিরাজরা একই কলোনীর, মিরাজদেরটা আগে থেকেই জানেন।হাইয়ের বাবা একটা সংবাদ পত্রের মুদ্রণ বিভাগে চাকরি করেন, ওরা দুই ভাই-বোন, ও বড়।এবার হাবিবের মা আসল কথায় আসলেন-
–তোমরা তিন জনই ভাল ছাত্র, বৃত্তি পেতে হলে তোমাদের আরো পড়তে হবে।আর এক সাথে পড়লে পড়াটা ভাল হয়।কি বল তোমরা?
-মিরাজ হ্যা সূচক মাথা নাড়ল(বিস্কুটের স্বাদটা এখনো ওর মুখে লেগে আছে), হাই চুপ।
খালাম্মা মিরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–বেশ,বেশ, তা হলে কাল থেকে শুরু কর।
বৃত্তির পড়া, বিকালের নাস্তা – বেশ ভালই চলছে মিরাজের। তবে হাই আসে না, তাই ওর মনটা একটু খারাপ।হাইটার যেন কি হয়েছে, মাঝে মাঝে স্কুলেও আসছে না। এর মধ্যে একদিন বিকেলে হাবিবের প্রাইভেট টিউটর হাজির। উনি রাতে পড়ান, রাতে একটা দাওয়াত থাকায় বিকেলে এসেছেন।ওদের দু’জনকে অংক, বাংলা পড়ালেন-তারপর অংক ও বাংলা শব্দার্থ করতে দিলেন।
মিরাজের হাতের লেখার প্রশংসা করলেন।
খালাম্মাও মিরাজের পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিলেন।
খালাম্মা স্যারকে বললেনঃ
–মিরাজ আমার ছেলের মতই, এবার থেকে আপনি দু’জনকেই পড়াবেন।
স্যারঃ
–ঠিক আছে।
মিরাজ জানে, প্রাইভেট পড়ানোর মত টাকা তার বাবার নেই।তাই মিরাজ রাজী হয়না।
আস্তে আস্তে মিরাজের বাসা জানতে পারলো বৃত্তির জন্য ও হাবিবদের বাসার পড়তে যায়। তবে তারা জানতে পারলো না মিরাজের মনোজগতের পরিবর্তন।মার মুখটা মিরাজ আঁকতে পারে না। পাঁচ বছর বয়সী এক বালক, ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির জালে মাকে ও আটকাতে পারেনি; তাই খালাম্মার মাতৃরূপ মিরাজের ছোট্ট মনে পুরোটা জুড়ে বসে। সদা চঞ্চল, খেলা পাগল ছেলেটা নিজেকে কখন যেন পরিবারের সবার থেকে আলাদা করে নেয়। ওর আলাদা হওয়ার ব্যাপারটাও বেশ অদ্ভুত। দু’পা জানালার শিকের গরাদ দিয়ে বের করে মাঝের সমতল লোহার পাতে বসে দু’হাত দিয়ে শিক ধরে দু’পা ঝুলিয়ে নাচাতে থাকে; শিকের ওপারে সামনের খেলার মাঠটার সীমানা দেওয়াল পেরিয়ে মিরপুর রোডটা উত্তর দিক থেকে এসে সরু হতে হতে দক্ষিণে মিশে গেছে নিউমার্কেটের দিকে। নিউমার্কেটের দিকের গাড়ি গুলো শব্দ করতে করতে ছোট হতে হতে হারিয়ে যায়, আর বিপরীত দিক অর্থাৎ আসাদ গেটের দিকের গুলো ছোট থেকে বড় হতে হতে চলে যায় চোখের আড়ালে। এই শব্দ, যাওয়া আসার মাঝে মিরাজ গুন গুন করে কয়েকটা লাইন বারে বারে আউড়ায়
—কো কো করি না,
বাঁশি বাজে না,
ফুল ফোটে না।
মিরাজের ছোট্ট বুকটা ধক্-ধক্ করছে, যেন এখনি বেরিয়ে আসবে।স্কুলের গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতে হাই মিরাজকে বলল:
–কি রে, মুখ ভার কেন?
–না, কিছু না বলে উড়িয়ে দিলেও ওর মনে ঝড় চলছে।
আজ টিফিন পিরিয়ড শেষে জালালের সাথে হাইয়ের এক চোট হয়ে গেছে।
প্রাইমারী স্কুল গুলোতে কিছু ছাত্র থাকে, যারা একটু বেশী বয়সে স্কুলে আসে।গায়ে-গতরে এরা ক্লাসের অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে বেশ বড়-সড় হয়।এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ তার গায়ের জোরের প্রমাণ দিতে চায়।জালাল তাদেরই একজন।
বিশ্বনাথ বসে বসে কাঁদছিল।
–এই কাঁদছিস ক্যান, বলে হাই ওকে মৃদু ধাক্কা দিল।
–আচার দেইনি বলে জালাল আমার হাত মুঁচড়ে আচার কেড়ে নিয়েছে?
–জালাল কই?
মিরাজ আঙুল দিয়ে পিছনে দেখাল।
হাই ঘুরে জালালের সামনে গেল।জালাল বেঞ্চে বসা ছিল, উঠে দাঁড়াল- ওর মাথা হাইকে ছাড়িয়ে গেল।
–তুই বিশ্বকে মেরেছিস?
–মেরেছি, তোর কি?
হাইয়ের শরীরের তুলনায় বড় হাতটা বিদ্যুৎ গতিতে জালালের গাল স্পর্শ করল:
–ঠাস, শব্দে সবাই চমকিত।
সম্বিত ফিরে পেয়ে, তবেরে বলে জালাল হাইকে জাপটে ধরতে যায়।
ও পিছু হটে, এমন সময় কলাবাগানের মামুন (একাধিক মামুন থাকায় ওর নামের আগে..) দরজার কাছ থেকে চিল্লিয়ে উঠেঃ
–বাতেন স্যার আসতেছে।
সবাই যে যার বেঞ্চে সুবোধ বালকের মত বসে পড়ল।
হাই-মিরাজ-হাবিবের পিছনের বেঞ্চে বসল জালাল।
হাসতে হাসতে সবার দিকে একবার তার সন্ধানী চোখ বুলিয়ে বাতেন স্যারঃ
–চিল্লা-চিল্লি কিসের?
–কিছু না স্যার, তড়িৎ উত্তর হাইয়ের।
জালালও চুপ, কারণ সবাই জানে স্যারের পদ্ধতিটা।
যে বিচার দিবে, যার বিরুদ্ধে দিবে-দু’জনকেই সামনে ডেকে পুরো ঘটনা জানবেন, তার পর দু’জনকেই সমান সমান বেতের বাড়ি।
বাংলা পড়িয়ে স্যার চলে যাওয়ার সাথে সাথে পিছন থেকে জালাল হিস হিসিয়ে বললঃ
–ছুটির পর তোকে দেখে নেব!
সেই ঘটনার রেশ ধরেই চাপা উত্তেজনা।
স্কুল থেকে বিশ কদম এগিয়ে ডানে মোড় নিতেই জালাল ও তার দল ওদের পথ রোধ করে দাঁড়াল।
ওরা দলে ভারী, হাই চট করে বলেঃ
—সাহস থাকে তো একা আয়।
জালালের আঁতে ঘা লাগে, একাই সামনে এগিয়ে আসে, হাইও সামনে এগোয়,মাঝখানে দু’জন, দু’দল দু’পাশে।
জালাল ষাঁড়ের মত হাইয়ের দিকে ধেঁয়ে আসে, হাই সরে যায়-হাই জানে কুস্তিতে ওর সাথে পারা কঠিন, বক্সিংয়ে কাবু করতে হবে।
সবাই হৈ হৈ করে উৎসাহ দিচ্ছে।
–ওই, কি হইছেরে?
পিছন ফিরে নান্নু ভাইকে দেখে মিরাজের মনটা খুশিতে ভরে উঠে।
ভীড় ঠেলে সামনে এসে হাইকে দেখেঃ
–মারপিট করবার লাগছস্ ক্যা?
হাই সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলে।
জালাল প্রতিবাদ করতে যায়।
নান্নু ২য় লেনের বাসিন্দা, হাইকে ভাল ভাবেই চেনেন।তাই জালালকে থামিয়ে দিয়ে বলেনঃ
–যা হইবার হইছে, (জালালের দিকে আঙুল তুলে) আর কারো গায়ে হাত তুললে, তোর কপালে খারাবি আছে। যা, ভাগ সব।

সেদিন যেন মিরাজ উড়তে উড়তে হাবিবদের বাসায় এলো। হাইয়ের বীরত্বের কথা খালাম্মাকে বলার আগেই উনি মিরাজকে থামিয়ে দিলেন, উনি হাবিবের মুখে সব কাহিনী আগেই শুনেছেন।
–দেখ মিরাজ, মারামারি করা ভাল নয়,হাবিবকে বলেছি, তুমি আমার সন্তানের মত, তোমাকেও বলছি, আবদুল হাইয়ের সাথে মিশো না।
মিরাজের রঙিন বেলুনটাকে কেউ যেন পিন দিয়ে ফুঁটো করে দিল!
খালাম্মা উপদেশের সুরে আরো কি কি যেন বলছে, ওর কানে ঢুকছে না, ও নখ দিয়ে আপন মনে টেবিল খুঁটতে খুঁটতে ‘ওহ’ করে মৃদু আওয়াজ করল।
–কি হলো, বলে উনি মিরাজের হাতটা ধরে পরখ করে আঁতকে উঠেন।
–এত বড় ফোঁড়া, বাসার কাউকে দেখাওনি।
ও ‘না’ সূচক মাথা নাড়ে।
–ব্যথা করছে না?
উনার গলায় এমন একটা কিছু ছিল যা ওর দিন তিনেকের পুরনো ‘ফোঁড়া’-র সয়ে যাওয়া পুরনো ব্যথাটাকে জাগিয়ে তুলল,ব্যথাতুর দৃষ্টিতে উনার দিকে চোখ তুলে তাকাল।
–আ হা রে, বলে সস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
–চুপটি করে বস, আমি আসছি – বলে উনি রান্না ঘরের দিকে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর একটা পাত্রে গরম পানি আর তুলো নিয়ে এলেন। তুলোটা গরম পানিতে ডুবিয়ে ফোঁড়াটার উপর আস্তে করে ধরলেন।
মিরাজ অবাক হয়ে দেখল, পূঁজ গুলো কেমন বেরিয়ে আসছে, ব্যথাটা কমে আসছে ! তারপর একটা শুকনো তুলো দিয়ে মুছে পরম মমতায় মলম লাগিয়ে দিলেন।
–এখন কেমন লাগছে?
মিরাজ কিছু বলতে পারে না, মাথা নীচু করে দু’ই ঠোঁট একত্র করে আবেগটাকে লাগাম পরাতে চায়।কিন্ত্ত তবুও চোখ দু’টো ঝাপছা হয়ে আসে, মার হারিয়ে যাওয়া মুখটা অন্য কেউ দখল নিয়ে নেয়!!!!

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!