শান্তা বলল, আমি তোমাকে এর আগে কোথায় দেখেছি। কোথায়? আমার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠল। আমাকে তো ওর দেখার কথা নয়। উত্তর না-দিয়ে শান্তা জিগ্যেস করল, আমাকে কি তুমি এর আগে কোথাও দেখেছ? না। সত্যি করে বল? শান্তার কন্ঠস্বর এই মুহূর্তে বুড়িদের মতো কেমন খনখনে শোনাচ্ছে।
আমি কি বলব? আমি কি শান্তাকে বলব যে রোমেলের বাসায় তোমার ছবি দেখেছি? তুমি আসলে মৃত। রামুর কাছেই কোথাও অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছ। এসব কথা কি বলা যায়? আমরা হাঁটতে- হাঁটতে লনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আমরা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, ঠিক সেখানেই একটি কফি গাছ। টিলাটি এখানে ঢালু হয়ে অন্তত তিনশ ফুট নীচে নেমে গেছে। ধবল জোছনায় টিলার ঢালে শাল গাছ, কলা গাছ, কাঁঠাল গাছ এমন কী নীচের রাস্তাও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে মঠের চূড়াও চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। আমার কেন যেন মনে হল শান্তা আমাকে ইচ্ছে করে টিলার কিনারে নিয়ে এসেছে। কেন? শান্তার উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা গেল না। তবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। ওর চোখে মনি দুটি ফসফরাসের মতন জ্বলজ্বল করছে। জ্বলজ্বলে চোখে বারবার আমার ডান বাহুর দিকে তাকাচ্ছে। যেখানে এথিন লামা ছোট্ট নীল শঙ্খ বেধে দিয়েছে। মনে হল ওই নীলশঙ্খের ওপর শান্তার আক্রোশ। শান্তা বলল, তোমার ডান বাহুতে কি একটা নীল রঙের শঙ্খ বাঁধা আছে?
হ্যাঁ। আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তুমি জানলে কি করে? খসখসে কন্ঠে শান্তা বলল, আমি জানি। তুমি এখন ওই নীলশঙ্খটা বাহু থেকে খুলে নীচে ফেলে দাও। নীলশঙ্খ ফেলে দেব? কেন? আমার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে। শান্তা ধমকের সুরে বলল, ওসব মাদুলিতে কাজ হয় না। তারপর কন্ঠস্বর নরম করে বলল। তা ছাড়া আমি তোমাকে আজ রাতে আশ্চর্য এক দেশে নিয়ে যাব । যেখানে দিনও হয় না রাতও হয় না … শান্তার কথা শেষ হল না … কফি গাছের ওপাশ থেকে কে যেন বেরিয়ে এল। খসখসে কন্ঠে বলল, কেমন আছ? কে? আমি চমকে উঠলাম। আমি … আমি এথিন লামা। ওহ্ । আপনি?
কিন্তু এথিন লামা এখানে এল কী ভাবে? উড়ে আসেনি তো। তবে এথিন লামাকে দেখে শান্তা যে ভয় পেয়েছে তা ঠিকই বুঝতে পারলাম। শান্তার মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। আমার দিকে ফিসফিস করে বলল, চল, এখান থেকে চলে যাই। ওই লোকটা ভালো না। আমি কতকটা রুক্ষ কন্ঠে বললাম, তুমি যাও । আমি আসছি। শান্তা দ্রুত হাঁটতে থাকে। পিছন দিকে একবারও ফিরে তাকাল না। আমি মুখ ফিরিয়ে কফি গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি ওখানে এথিন লামা নেই। যেন এথিন লামা আসেনি। গভীর বিস্ময় নিয়ে বাংলোয় ফিরে এলাম। রাতে খাওয়া তেমন জমল না। খরগোশের মাংস রাবারের মতো ঠেকল। ছোট খালু সেনাবাহিনীতে থাকার সময় বান্দরবানের গভীর অরণ্যে অজগর শিকারের কাহিনী বলছেন। শান্তা মন দিয়ে শুনে যাচ্ছে। তেমন কিছু খেল না শান্তা। আমি কিচেনে এলাম। মং ছিং প্লেট-গ্লাস ধুচ্ছিল। মিলি খালা চুলার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে দুধ ভরতি সসপ্যান। মিলি খালাকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলাম, শান্তার মা তোমার ঠিক কি রকম বান্ধবী হয় বল তো ? মিলি খালা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল, কেন রে? হঠাৎ? এমনি । বল না। ছোট খালা বলল, শান্তার মা সাবিহার সঙ্গে কলেজে পড়েছি। তারপর ওর বিয়ে হয়ে গেল। মাঝে- মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল। এই। অনেক দিন দেখাসাক্ষাৎ হয় না, না? আমি জিগ্যেস করি। হ্যাঁ। তুই জানলি কি করে? মিলি খালাকে অবাক মনে হল। তার পর মিলি খালা বলল, সকালে আমার কিন্তু খটকা লাগল আবীর । কি? আজ সকালে শান্তা যখন এল। তখন বললাম, বাড়ি চিনলে কি করে? শান্তা এড়িয়ে গেল। বলল, ওর এক মামা টিলার নীচে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক ওপরে উঠে এলেন না বলে কেমন খটকা লাগল। শান্তার সঙ্গে কোনও ব্যাগট্যাগও ছিল না। হুমম। আমি শরীরে শিরশিরানি আর কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। তার আগে মিলি খালার লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে এলাম। দোতলার সিঁড়ির পরে ছোট করিডোর। অল্প পাওয়ারের নীল আলো জ্বলে ছিল। ডান পাশের প্রথম ঘরটি আমার। ঘরটা ছোট। তবে গরাদহীন জানালাটা বেশ বড়। বিছানায় শুয়ে এ.আর আরভিং –এর লেখা ‘টিবেটান মিষ্ট্রি অভ ফ্লাইং লামা’ বইটি পড়ছি। মন বসছে না। কেবল শান্তার মুখটা ভাসছিল। রোমেল বলল, গত বছর শান্তারা সপরিবারে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে রামুর কাছে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মিলি খালা বললেন, শান্তাকে আজ সকালে ওর এক মামা দিয়ে গেলেন। ঠিক কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল? শান্তা যদি অ্যাক্সিডেন্টে মারাই যায় তাহলে শান্তা এলই-বা কেন? কী ভাবে এল? মৃত্যুর পরও কি বেঁচে থাকা সম্ভব? এসব চিন্তা সরিয়ে বই পড়ার চেষ্টা করি। ‘টিবেটান মিষ্ট্রি অভ ফ্লাইং লামা’বইটি মিলি খালার লাইব্রেরি থেকে এনেছি। লামারা উড়তে পারে কি না সেটাই জানতে ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ নেভির সদস্য এ.আর আরভিং তিব্বতে গিয়েছিলেন। বইতে সে অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেছেন এ. আর আরভিং। তিনি নাকি লামাদের উড়তে দেখেছেন। কিন্তু কথাটা কতটুকু সত্যি? এথিন লামাও কি উড়তে পারে? মং ছিং নাকি এথিন লামাকে উড়তে দেখেছে।
ঘুম আসছিল না। ঘর অন্ধকার। ঘরে রিডিং ল্যাম্পের আলো। সে আলোয় হঠাৎ দেখি দরজার কাছে শান্তা দাঁড়িয়ে। দরজা তো বন্ধ ছিল। ও এল কি করে? শান্তার পরনে সাদা নাইটি। আমি আতঙ্ক সিদে হয়ে বসি। হাত থেকে বই খসে যায়। শান্তা খনখনে কন্ঠে বলল, তখন তুমি কিচেনে মিলি খালাকে বললে আমাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে ? আমি চমকে উঠলাম। ও জানল কি করে? কিচেনে মং ছিং ছাড়া অন্য কেউ ছিল না । মুহূর্তেই আমি এক লাফে জানালার কাছে চলে আসি। গরাদহীন জানালাটা খোলা। জানালার ওপাশে একটি গালিচা। শূন্যে ভাসছে। গালিচার ওপরে দাঁড়িয়ে এথিন লামা। আমি বিস্মিত হব কী- পরক্ষণেই নিজেকে গালিচার ওপর আবিস্কার করলাম। গালিচা খানিকটা সরে অনেকখানি ওপরে উঠে এল। ঠিক লনের ওপর। জোছনার আলোয় লন আলোকিত। যেন দিন। নীচে তাকিয়ে দেখি জানালা দিয়ে অনেকখানি কয়লার গুঁড়া ছিটকে বেরিয়ে এসে ঘূর্নির আকার ধারণ করল। গালিচা দুলছিল। কয়লার গুঁড়া নারীমূর্তি ধারণ করে গালিচা ঘিরে আকাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। আর রক্ত হিম করা খল খল হাসি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।এথিন লামা চারপাশে নীল রশ্মি ছুঁড়ে মারতে লাগল। কালো নারীমূর্তি শূন্যে মিলিয়ে গেল। নীচে তাকিয়ে দেখি লনে ছোট খালু, মিলি খালা আর মং ছিং এসে দাঁড়িয়েছে । মিলি খালা চিৎকার করে কী যেন বলছে।
এথিন লামা ধীরে ধীরে গালিচা নামিয়ে আনল। গালিচা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি। তোর কোনও ক্ষতি হয়নি তে? বলে মিলি খালা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি লজ্জ্বা পেলাম। আমি তো আর ছোটটি তো নই। মং ছিং ঝুঁকে এথিন লামাকে প্রণাম করল। হাজার হলেও গুরু। ছোট খালু বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। লামাদের শূন্যে ওড়ার দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়েছেন। এথিন লামা হাসছিল। বলল, কদিন আগে মঠে বসে ধ্যান করার সময় জেনেছিলাম এমনই এক ঘটনা ঘটবে। তাই রামুতে বাসে উঠে এর পাশে বসি। বলে আমাকে দেখাল। আমার মনে পড়ল এথিন লামা আমার বাহুতে ছোট নীলশঙ্খ বেঁধে দিয়েছিল। বাহু স্পর্শ করে নীলশঙ্খটা ঠিক জায়গায় আছে বলে নিশ্চিন্ত হলাম। শঙ্খটি এথিন লামা তিববতের মানস সরোবরের পাড়ে কুড়িয়ে পেয়েছিল।ওটাই তো আমাকে ডাকিনী শান্তার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল। আবার যে ডাকিনীর খপ্পড়ে পড়ব না কে বলতে পারে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।