গরু-ভেড়ার অনুতাপ

প্রাচীনকালের এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তিনটি প্রাণী পাশাপাশি চলছিল—একটি উট, একটি গরু এবং একটি বুনো ভেড়া। চলতে চলতে তারা তাদের ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন নিয়ে কথা বলছিল। সেইসাথে নিজেদের জীবনের সুখকর ও হাসির বিভিন্ন স্মৃতির কথা বলাবলি করছিল।

সময়টা ছিল বসন্তকাল। আবহাওয়াও ছিল উপভোগ্য। খোশ আলাপ করতে করতে পুরনো তিন বন্ধু গিয়ে পৌঁছল এমন এক জায়গায়, যেখানে খুব মজার ও সুস্বাদু ঘাস-উদ্ভিদ ছিল। এরকম ঘাস কিংবা উদ্ভিদ সাধারণত ওই মরুতে খুব কমই দেখা যেত। স্বাভাবিকভাবেই তিন বন্ধুই খুশি হয়ে গেল বিরল স্বাদের ওই উদ্ভিদ দেখে।

উট বলল, “আমরা এই উদ্ভিদগুলো সমান তিন ভাগে ভাগ করে নিয়ে যে যার অংশ খাব।”

ভেড়া একবার ভালো করে উদ্ভিদগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল, পরিমাণে খুবই কম। হাত দিয়ে সেগুলো একবার নেড়েচেড়ে দেখে বলল, “এই সামান্য ঘাস যদি ভাগ করতে যাই, তাহলে প্রত্যেকের ভাগেই খুব কম পরিমাণে পড়বে। কারও পেটই ভরবে না।”

গরু বলল, “ঠিকই বলেছ, কিন্তু কী করা যাবে? যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ থাকত, তাহলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু যেহেতু তা নেই, সেহেতু ভাগ না করে উপায় কী?”

গরুর কথা শুনে ভেড়া বলল, “কেন, উপায় আছে। আমি একটা চিন্তা করেছি।”

উট এবং গরু আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল, “কী ভেবেছ?”

একবার উদ্ভিদের দিকে আরেকবার তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ভেড়া বলল, “উপায় হলো—আমাদের তিনজনের যে কোনো একজন সবগুলো উদ্ভিদ খাবে।”

সেই প্রাচীনকাল থেকেই একটা প্রবাদ সবাই শুনে এসেছি আমরা—“মুরব্বিদের সম্মান করা ওয়াজিব।” যারা ছোট, তাদের উচিত বড়দের জন্য নিজেদের ছোটখাট অধিকার ত্যাগ করা।

উট এ কথা শুনে বলল, “আইডিয়াটা মন্দ না। কিন্তু আমরা কী করে জানব যে আমাদের তিনজনের মাঝে কে বেশি বয়স্ক?”

ভেড়া বলল, “প্রথম প্রস্তাব যদি সবাই মেনে নিই, তাহলে আমরা সবাই নিজ নিজ জন্মতারিখ ঘোষণা করতে পারি। তাহলেই বোঝা যাবে বয়সে কে বেশি বড়। যে-ই বয়োবৃদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত হবে, সে-ই খাবে এই ঘাসগুলো।”

উট এবং গরু ভেড়ার কথা মেনে নিল।

উট বলল, “চিন্তাটা বেশ ভালো। এবার আমরা আমাদের নিজ নিজ বয়স নিয়ে কথা বলতে পারি।”

তারা প্রথমেই ভেড়াকে বলল তার বয়স নিয়ে কথা বলতে।

ভেড়া একটু ভারিক্কি ভাব দেখিয়ে গোঁ গোঁ করে কিছুটা অহংকারের স্বরে বলল, “আমার বয়স হযরত ইসমাইল (আ.) এর কুরবানির সময় থেকে হিসাব কর।”

উট আর গরু অবাক দৃষ্টিতে ভেড়ার দিকে তাকাল।

গরু বলল, “তার মানে তোর বয়স এত বেশি?”

ভেড়া গর্বের সাথে বলল, “হ্যাঁ, যে কোনো ভেড়াকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। আমি আমার ছোটবেলায় যে চারণভূমিতে ঘুরে বেড়াতাম, সেই চারণভূমিতে ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে কুরবানী করা ভেড়াটিও আমার সাথে চরে বেড়াত। ও আমার বন্ধু ছিল, খুব ভালো বন্ধু। সেই ভেড়াটি আমাদের গোত্রেরই ছিল।”

উট এবং গরু ভেড়ার কথা শুনে ঢোক গিলল।

গরু বলল, “ঠিক আছে, আমি এখন বলছি আমার বয়সের কথা। দেখি, কার বয়স বেশি—তোর না আমার?”

ভেড়া গরুর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর বলল, “বেশ ভালো কথা। ঠিক আছে, বলো দেখি, তোমার বয়স কত? কবে জন্ম হয়েছে তোমার?”

গরু বলল, “আমি ভেড়ার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর দুটি গরু ছিল। ওই দুটি গরু দিয়ে তিনি জমি চাষ করতেন। তাদেরই একটি হলাম আমি।”

ভেড়া এবার বুঝতে পারল, গরু তো তার চেয়েও বেশি চালাক।

মনে মনে বলল, “ভুল হয়ে গেছে! আমি যদি সবার আগে বয়স বলতে রাজি না হতাম, তাহলেই ভালো ছিল। ফাঁদে পড়ে গেলাম। এখন তো কোনোরকম প্রতিবাদও করা যাবে না। এখন যদি বলি যে গরু মিথ্যা বলছে, তাহলে তো আমার মিথ্যাচারও ধরা পড়ে যাবে।”

গরু দেখল উট এবং ভেড়া অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

গবগব করে বলল, “হ্যাঁ! বয়সটা আমার বেশিই। এতই বেশি যে তোমরা গুণেও শেষ করতে পারবে না। বলতেও পারবে না কত বয়স আমার।”

উট এবার মনে মনে বলল, “হায় রে দুষ্টু গরু! হায় রে ভেড়া! তোমরা আমার সামনে তোমাদের বয়সের কথা বলছ? এমন কাজ করব যে সারাজীবন মনে থাকবে আমাদের তিনজনের মাঝে কার বয়স বেশি!”

এই বলে উট একটা মজার হাসি দিল এবং ঘাসগুলো খেতে শুরু করে দিল।

বিরল এই উদ্ভিদগুলো খুবই সুস্বাদু ছিল।

উদ্ভিদগুলো সব খেয়ে উট, গরু এবং ভেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাদেরকে বলতে চাই না যে আমার বয়স কত কিংবা তোমাদের চেয়ে আমার বয়স কত বেশি। আমার শরীরের দিকে কিংবা আমার ঘাড়ের দিকে যদি কেউ ভালোভাবে একটু দৃষ্টি দেয়, তাহলেই সে বুঝতে পারবে আমি বয়সে তোমাদের চেয়ে কত বড়। আমার জন্ম কবে কোথায় হয়েছে, সে কথা বলার অপেক্ষাই রাখে না। আমাকে যে-ই দেখবে, সে-ই বুঝতে পারবে যে আমি অন্তত তোমাদের চেয়ে ছোট নই—কী বলো!”

গরু আর ভেড়া বিস্ময়ের সাথে উটের দিকে তাকিয়ে অনুতাপ বোধ করল।

অনুতাপ এইজন্য যে তারা দুজনই নিজেদের বয়স সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা দিয়েছিল। সেই মিথ্যাচারের জন্যই তারা এখন অনুতপ্ত।

 

বন্ধুরা, গল্পটি শুনলে আশা করি ভালো লেগেছে।

এ গল্প থেকে আমরা দুটি শিক্ষা নিতে পারি—

১. নিজেকে বড় ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরার জন্য কখনই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়।
২. নিজের অতীত খারাপ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া ভালো ও পছন্দনীয় কাজ।

—সাতক্ষীরা থেকে পাঠিয়েছেন মহিবুল্লাহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

গরু-ভেড়ার অনুতাপ

প্রাচীনকালের এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তিনটি প্রাণী পাশাপাশি চলছিল—একটি উট, একটি গরু এবং একটি বুনো ভেড়া। চলতে চলতে তারা তাদের ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন নিয়ে কথা বলছিল। সেইসাথে নিজেদের জীবনের সুখকর ও হাসির বিভিন্ন স্মৃতির কথা বলাবলি করছিল।

সময়টা ছিল বসন্তকাল। আবহাওয়াও ছিল উপভোগ্য। খোশ আলাপ করতে করতে পুরনো তিন বন্ধু গিয়ে পৌঁছল এমন এক জায়গায়, যেখানে খুব মজার ও সুস্বাদু ঘাস-উদ্ভিদ ছিল। এরকম ঘাস কিংবা উদ্ভিদ সাধারণত ওই মরুতে খুব কমই দেখা যেত। স্বাভাবিকভাবেই তিন বন্ধুই খুশি হয়ে গেল বিরল স্বাদের ওই উদ্ভিদ দেখে।

উট বলল, “আমরা এই উদ্ভিদগুলো সমান তিন ভাগে ভাগ করে নিয়ে যে যার অংশ খাব।”

ভেড়া একবার ভালো করে উদ্ভিদগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল, পরিমাণে খুবই কম। হাত দিয়ে সেগুলো একবার নেড়েচেড়ে দেখে বলল, “এই সামান্য ঘাস যদি ভাগ করতে যাই, তাহলে প্রত্যেকের ভাগেই খুব কম পরিমাণে পড়বে। কারও পেটই ভরবে না।”

গরু বলল, “ঠিকই বলেছ, কিন্তু কী করা যাবে? যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ থাকত, তাহলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু যেহেতু তা নেই, সেহেতু ভাগ না করে উপায় কী?”

গরুর কথা শুনে ভেড়া বলল, “কেন, উপায় আছে। আমি একটা চিন্তা করেছি।”

উট এবং গরু আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল, “কী ভেবেছ?”

একবার উদ্ভিদের দিকে আরেকবার তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ভেড়া বলল, “উপায় হলো—আমাদের তিনজনের যে কোনো একজন সবগুলো উদ্ভিদ খাবে।”

সেই প্রাচীনকাল থেকেই একটা প্রবাদ সবাই শুনে এসেছি আমরা—“মুরব্বিদের সম্মান করা ওয়াজিব।” যারা ছোট, তাদের উচিত বড়দের জন্য নিজেদের ছোটখাট অধিকার ত্যাগ করা।

উট এ কথা শুনে বলল, “আইডিয়াটা মন্দ না। কিন্তু আমরা কী করে জানব যে আমাদের তিনজনের মাঝে কে বেশি বয়স্ক?”

ভেড়া বলল, “প্রথম প্রস্তাব যদি সবাই মেনে নিই, তাহলে আমরা সবাই নিজ নিজ জন্মতারিখ ঘোষণা করতে পারি। তাহলেই বোঝা যাবে বয়সে কে বেশি বড়। যে-ই বয়োবৃদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত হবে, সে-ই খাবে এই ঘাসগুলো।”

উট এবং গরু ভেড়ার কথা মেনে নিল।

উট বলল, “চিন্তাটা বেশ ভালো। এবার আমরা আমাদের নিজ নিজ বয়স নিয়ে কথা বলতে পারি।”

তারা প্রথমেই ভেড়াকে বলল তার বয়স নিয়ে কথা বলতে।

ভেড়া একটু ভারিক্কি ভাব দেখিয়ে গোঁ গোঁ করে কিছুটা অহংকারের স্বরে বলল, “আমার বয়স হযরত ইসমাইল (আ.) এর কুরবানির সময় থেকে হিসাব কর।”

উট আর গরু অবাক দৃষ্টিতে ভেড়ার দিকে তাকাল।

গরু বলল, “তার মানে তোর বয়স এত বেশি?”

ভেড়া গর্বের সাথে বলল, “হ্যাঁ, যে কোনো ভেড়াকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। আমি আমার ছোটবেলায় যে চারণভূমিতে ঘুরে বেড়াতাম, সেই চারণভূমিতে ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে কুরবানী করা ভেড়াটিও আমার সাথে চরে বেড়াত। ও আমার বন্ধু ছিল, খুব ভালো বন্ধু। সেই ভেড়াটি আমাদের গোত্রেরই ছিল।”

উট এবং গরু ভেড়ার কথা শুনে ঢোক গিলল।

গরু বলল, “ঠিক আছে, আমি এখন বলছি আমার বয়সের কথা। দেখি, কার বয়স বেশি—তোর না আমার?”

ভেড়া গরুর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর বলল, “বেশ ভালো কথা। ঠিক আছে, বলো দেখি, তোমার বয়স কত? কবে জন্ম হয়েছে তোমার?”

গরু বলল, “আমি ভেড়ার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর দুটি গরু ছিল। ওই দুটি গরু দিয়ে তিনি জমি চাষ করতেন। তাদেরই একটি হলাম আমি।”

ভেড়া এবার বুঝতে পারল, গরু তো তার চেয়েও বেশি চালাক।

মনে মনে বলল, “ভুল হয়ে গেছে! আমি যদি সবার আগে বয়স বলতে রাজি না হতাম, তাহলেই ভালো ছিল। ফাঁদে পড়ে গেলাম। এখন তো কোনোরকম প্রতিবাদও করা যাবে না। এখন যদি বলি যে গরু মিথ্যা বলছে, তাহলে তো আমার মিথ্যাচারও ধরা পড়ে যাবে।”

গরু দেখল উট এবং ভেড়া অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

গবগব করে বলল, “হ্যাঁ! বয়সটা আমার বেশিই। এতই বেশি যে তোমরা গুণেও শেষ করতে পারবে না। বলতেও পারবে না কত বয়স আমার।”

উট এবার মনে মনে বলল, “হায় রে দুষ্টু গরু! হায় রে ভেড়া! তোমরা আমার সামনে তোমাদের বয়সের কথা বলছ? এমন কাজ করব যে সারাজীবন মনে থাকবে আমাদের তিনজনের মাঝে কার বয়স বেশি!”

এই বলে উট একটা মজার হাসি দিল এবং ঘাসগুলো খেতে শুরু করে দিল।

বিরল এই উদ্ভিদগুলো খুবই সুস্বাদু ছিল।

উদ্ভিদগুলো সব খেয়ে উট, গরু এবং ভেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাদেরকে বলতে চাই না যে আমার বয়স কত কিংবা তোমাদের চেয়ে আমার বয়স কত বেশি। আমার শরীরের দিকে কিংবা আমার ঘাড়ের দিকে যদি কেউ ভালোভাবে একটু দৃষ্টি দেয়, তাহলেই সে বুঝতে পারবে আমি বয়সে তোমাদের চেয়ে কত বড়। আমার জন্ম কবে কোথায় হয়েছে, সে কথা বলার অপেক্ষাই রাখে না। আমাকে যে-ই দেখবে, সে-ই বুঝতে পারবে যে আমি অন্তত তোমাদের চেয়ে ছোট নই—কী বলো!”

গরু আর ভেড়া বিস্ময়ের সাথে উটের দিকে তাকিয়ে অনুতাপ বোধ করল।

অনুতাপ এইজন্য যে তারা দুজনই নিজেদের বয়স সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা দিয়েছিল। সেই মিথ্যাচারের জন্যই তারা এখন অনুতপ্ত।

 

বন্ধুরা, গল্পটি শুনলে আশা করি ভালো লেগেছে।

এ গল্প থেকে আমরা দুটি শিক্ষা নিতে পারি—

১. নিজেকে বড় ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরার জন্য কখনই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়।
২. নিজের অতীত খারাপ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া ভালো ও পছন্দনীয় কাজ।

—সাতক্ষীরা থেকে পাঠিয়েছেন মহিবুল্লাহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

মুগীরা ইবন শু’বা (রা)

নাম আবু আবদিল্লাহ মুগীরা, পিতা শু’বা ইবন আবী আমের। আবু আবদিল্লাহ ছাড়াও আবু মুহাম্মাদ ও…

সাপের তওবা

একটি সাপের ঘটনা বর্ণনা করছি। আমার কাছে যারা তালীম গ্রহন করতে আসে প্রথমেই আমি কাউকে…

আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ আস-সাহমী-(রা)

আবু হুজাফাহ আবদুল্লাহ নাম। পিতার নাম হুজাফাহ। কুরাইশ গোত্রের বনী সাহম শাখার সন্তান। ইসলামী দাওয়াতের…