গরীবের বৌ-ছেলেমেয়ে ও কাল্লে গার্গ (৩য় পর্ব)

মহিলাকে তার স্বামী ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো সে একটা গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। ওই গুহায় বাস করতো ছোট্ট একজন মানুষ।বিশাল মেষের পাল চরাতো সে। প্রতিদিন একটি করে মেষ জবাই করে চুলায় চড়িয়ে দিয়ে চলে যেতো চারণভূমিতে। মহিলাকে সে মায়ের মতো গ্রহণ করলো। কিছুদিন পর ওই মহিলা তার স্বামী এবং ছেলেদেরও নিয়ে এলো গুহায়। ছোট্ট মানুষটি তাদেরকে ভালোভাবেই গ্রহণ করলো।

 

একদিন ছোট্ট মানুষটি তার বাবাকে বললো বাদশার মেয়ের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে। বাবা প্রস্তাব নেয়ার পর বাদশা ঠাট্টা করে বলেছিল: এক শর্তে বিয়ে দিতে পারি। শর্তটা হলো: ছেলের ঘর থেকে এই প্রাসাদ পর্যন্ত কালো হাঁটু বিশিষ্ট উটের লাইন থাকবে এবং প্রত্যেকটি উটের পিঠে থাকতে হবে স্বর্ণ রূপাভর্তি ভাণ্ডার’। মজার ব্যাপার হলো এসবের আয়োজন করে বিয়ের জন্য বাবা তার ছেলেকে নিয়ে এলো প্রাসাদে। সবাই তো অবাক।

বাদশা আদেশ দিলো উটগুলোকে একত্রিত করার জন্য। একের পর এক উটগুলোকে টেনে নেয়ার পর দেখা গেল একটি ছাগলের শিঙে বসে আছে ছোট্ট একজন মানুষ। বাদশা তাকে ভালোভাবে দেখলো। কারণটা হলো এর আগে রাজা আর কখনো এতো ছোটো মানুষ দেখে নি। ওই ছোট্ট মানুষ মানে কাল্লেগাগ প্রাসাদে ঢুকে সালাম করলো। বাদশাও তাকে স্বাগত জানালো। কাল্লেগাগ চামড়ার তৈরি তার বিশেষ আসনটি বিছিয়ে তার ওপর বসলো। গরিব লোকটি অর্থাৎ কাল্লেগাগের বাবা বললো: এই ছেলের সাথেই শাহজাদির বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বাদশা তো এ কথা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কেননা সে তো এখন তার কথা ফেরাতে পারবে না। বাধ্য হয়ে কাল্লেগাগের সাথেই তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলো।

 

ঘটা করে বিয়ে হলো। পুরো শহরকে আলোকসজ্জায় সাজানো হলো। সাত দিন সাত রাত উৎসব করা হলো। উৎসব শেষে বাদশার মেয়েকে নিয়ে কাল্লেগাগ ছাগলের শিঙে চড়েই গুহায় ফিরে গেল। বাদশা যদিও কথায় আটকে গিয়ে মেয়েকে এভাবে বিয়ে দিলো কিন্তু মানসিক পেরেশানি গেল না। সেজন্য কনের পেছনে পেছনে লোক পাঠালো অবস্থাটা কী বা কোথায় যাচ্ছে তারা জেনে আসার জন্য। রাজার পেয়াদারা গুহায় ঢুকে দেখলো এতো গুহা নয়, বিরাট এক বাড়ি। সবকিছুই আছে ওই বাড়িতে। কোনো কিছুর অভাব নেই। যতো মানুষই এলো সবারই জায়গা হয়েছে ওই বাড়িতে। সকল অতিথিকেই আপ্যায়ন করা হয়েছে ঠিকঠাকমতো। কিন্তু কে তৈরি করলো এই খাবার বোঝা গেল না। বাদশার লোকেরা বহু তদন্ত করেও কাউকে দেখলো না। অবশেষে তারা ফিরে গেল বাদশার দরবারে।

 

বাদশা তো অপেক্ষা করছিল কখোন তার পেয়াদারা ফিরে আসে। কী খবর জানার কৌতূহল নিয়ে বাদশা ছটফট করছিল। পেয়াদারা ফিরে এসেই বাদশার কাছে গেল এবং যা যা হয়েছে আর যা কিছু তারা দেখেছে সব হুবহু বর্ণনা করলো। কথাবার্তা শেষে তারা বললো: জানি না কাল্লেগাগ মানুষ নাকি জিন। বাদশা দেখলো যা হবার তো হয়েই গেছে এখন তো কিছু করার নেই। এদিকে কাল্লেগাগ আর তার স্ত্রী ভালোভাবেই তাদের জীবন কাটাচ্ছে। কাল্লেগাগ প্রতিদিন তার পশুপাল নিয়ে চলে যায় চারণভূমিতে। শাহজাদি ঘর সামলায়। একদিন কাল্লেগাগ তার স্ত্রী বললো চারণভূমিতে যাবার পর সে যেন তার বিশেষ আসনের ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকে। কোনোভাবেই যেন তাতে আগুন না লাগে। এই চামড়ার টুকরাটিতেই তার প্রাণবায়ু রয়েছে। এটা যদি পুড়ে যায় তাহলে তাকে আর দেখবে না কোনোদিন।

 

এ অবস্থায় তাকে লোহার জুতা পরতে হবে, লোহার লাঠি হাতে নিয়ে  তাকে খুঁজতে বেরুতে হবে। জুতা যখন ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাতলা সালুনির মতো হয়ে যাবে আর হাতের লাঠি হবে সুঁইয়ের সমান তখন তাকে খুঁজে পাবে। বাদশার মেয়ের হাতে একটা আংটি দিয়ে কাল্লেগাগ বললো যে এই আংটিটার বিশেষ গুণ রয়েছে। একদিন এই আংটি তার কাজে আসবে বলে জানালো। এক দুই বছর পেরিয়ে যাবার পর একদিন বাদশার মেয়ে নিজে নিজেই বললো: এই চামড়ার আসনটা আসলে কী! প্রতিদিন কাল্লেগাগ কেন এরকম গুরুত্বের সাথে দেখাশোনা করতে বলে যায়-যাতে না পোড়ে! সে মনে ভাবলো একদিন পরীক্ষা করে দেখবে।

 

শাহজাদি ওই চামড়ার আসনটি ছুঁড়ে মারলো চুল্লির আগুনের ভেতর। আসনে আগুন লাগতেই কাল্লেগাগ ছবির মতো হাজির হলো সামনে। চীৎকার করতে লাগলো সে: পুড়ে গেলাম! পুড়ে গেলাম বলে চীৎকার করতে লাগলো। এরপর শাহজাদির দিকে তাকিয়ে কাল্লেগাগ বললো: কেন করতে গেলে এ কাজ? আমি তো এখন অদৃশ্য হয়ে যাবো। এখন তোমাকে যেমনটি বলেছিলাম: লোহার জুতা পরতে আর লোহার লাঠি হাতে নিতে, তা-ই করতে হবে। আমাকে পাওয়া পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যেতে হবে। শাহজাদি তার এ কাজের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত হলো। নিজের প্রতি নিজের এতো রাগ হলো যে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কামারের কাছে গেল এবং তার জন্য লোহার জুতা বানানোর আদেশ দিলো। একটি লোহার লাঠিও তৈরি করতে বললো।

লাঠি জুতা তৈরি হবার পর শাহজাদি সেগুলো ব্যবহার করে শুরু করলো কাল্লেগাগের সন্ধান। পাহাড় পর্বত, নদী, সমুদ্র আর মরুপ্রান্তর হেঁটে হেঁটে খুঁজতে লাগলো তার স্বামী কাল্লেগাগকে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে লোহার জুতা ক্ষয়ে যখন সালুনির মতো শতছিদ্র হয়ে গেল আর লাঠিটা হয়ে গেল সুঁইয়ের মতো, তখন সে পৌঁছলো এক শহরে। ওই শহরে সে কোনো মানুষকে দেখতে পেল না। পুরো শহরে ঘুরে বেড়ালো। দেখলো একটা কুপের পাশে কিছু লোক সমবেত হয়ে এক জনের গায়ে পানি ঢালছে। নে কেবলি বলছে ‘পুড়ে গেলাম পুড়ে গেলাম’। শাহজাদি মনে মনে বললো: এ-ই সেই কাল্লেগাগ নয় তো! তার মনে পড়ে গেল আংটিটার কথা যেটা দিয়ে কাল্লেগাগ বলেছিল এই আংটি একদিন তোমার কাজে আসবে। সে আংটিটা একটা গামলাভর্তি পানিতে ছুঁড়ে মারলো। তারপর ওই গামলার পানি নিয়ে পুড়ে যাওয়া লোকটার গায়ে ঢাললো।

 

লোকটা নীরব হয়ে গেল এবং একপাশে গিয়ে বসে পড়লো। শাহজাদি তার দিকে তাকাতেই চিনতে পারলো: এ-ই তার স্বামী কাল্লেগাগ। স্বামী তাকে বললো: দেখো কী করেছো। তোমাকে বলেছিলাম যে এই চামড়ার আসন আমার প্রাণ। কেন এটা পুড়তে গেলে? শাহজাদি ক্ষমা চাইলো। দুজনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ফিরে গেল তাদের গুহায়। গিয়ে দেখলো বাবা-মা আর সন্তানেরা মিলে উট গরু ছাগল আর মেষগুলো চরাচ্ছে। কাল্লেগাগ আর তার স্ত্রীকে দেখে খুশি হয়ে তাদেরকে বরণ করে নিলো। কাল্লেগাগ তখন বললো: আমি এক পরীর সন্তান। রাগ করে আমি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি এবং ধীরে ধীরে এসব পশুর মালিক হয়েছি। সবাই আবারও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো এবং তারপর থেকে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।#

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!