এক লোক ছিল বেশ গরিব। সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তার ছিল তিন সন্তান আর বৌ নিয়ে সুন্দর সংসার। সহায় সম্বল বলতে ছিল কেবল একটি গরু। একদিন লোকটি তার গরুটাকে জবাই করলো এবং নাড়িভুঁড়ি বের করে আনলো। যখন নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করছিল ভয় পেয়ে গেল লোকটি। আতঙ্কে ভুঁড়িটাকে ছিদ্র ছিদ্র করে ফেললো। যখন দেখলো ভুঁড়িটা আর ব্যবহার উপযোগী নেই, তার মাথায় একটা চিন্তা এলো। ভুঁড়ি তার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললো: পানির নালায় গিয়ে এটা ভর্তি করে পানি নিয়ে আসো। পানি ভর্তি করতে না পারলে আর ফিরে এসো না।
তার নিরীহ স্ত্রী তো কিছুই জানতো না। সে স্বামীর কথামতো চলে গেল ভুঁড়ি ভরে পানি আনতে। কিন্তু ভুঁড়ি যতোই পানিতে ডুবিয়ে ভর্তি করতে চাইলো, হলো না। পানি থাকেই না, পড়ে যায় সব। বেচারি ক্লান্ত হয়ে গেল। খালি ভুঁড়ি নিয়েই অবশেষে বাসায় ফিরে গেল সে। গিয়ে দেখে ঘরের দরোজা বন্ধ। দরোজায় ঠক ঠক করে আঘাত করে বললো: দরোজা বন্ধ করেছো কেন? তার স্বামী বললো: পানি এনেছো নাকি আনো নি? স্ত্রী বললো: তুমি ভুঁড়িটাকে শতছিদ্র করে রেখেছো, ওর ভেতর পানি থাকে নাকি! স্বামীও দরোজা আর খুললো না, বললো: যাও নিজের কাজে যাও। বলেছি না! ভুঁড়ি ভর্তি করে পানি আনতে না পারলে বাসায় এসো না!
মহিলা তার স্বামীকে ভালো করেই জানতো যে এই লোক কখনো তার কথার অন্যথা করবে না। তাই সে ফিরে গেল। কিন্তু দেখলো বরফ পড়ছে। ভীষণ ঠাণ্ডা বাইরে। এই আবহাওয়ায় সামনে এগুলো নির্ঘাত বরফ হয়ে যাবে নিজেই। তাড়াতাড়ি করে ভুঁড়িটাকে মাঝখান থেকে দুই টুকরা করলো। সেগুলো দুই পায়ের নীচে বেঁধে হাঁটতে লাগলো। যেতে যেতে পৌঁছলো এক পাহাড়ের কাছে। সেখানে দেখলো ধোঁয়ার চিকন একটা কুণ্ডলী থেকে থেকে বের হচ্ছে এবং বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। মহিলা ওই ধোঁয়ার উৎসের খোঁজে হাঁটতে শুরু করলো। যেতে যেতে চমৎকার একটা গুহায় গিয়ে পৌঁছলো। কিন্তু এতো সুন্দর এবং পরিপাটি যে একেবারেই গুহা বলে মনে হচ্ছে না। বাসা বাড়ির মতো মনে হচ্ছিলো তার।
মহিলা ভেতরে গেল। চারপাশে ভালো করে দেখে নিলো কোথায় কী আছে বা কে আছে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলো না অথচ পাতিলভর্তি মাংস দেখতে পেল চুলার ওপর পাকানো হচ্ছে। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলো সে, তাই চুলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পরই তার ক্লান্তি এবং ঠাণ্ডা ভাব চলে গেল। চুলার ওপর থেকে চামুচে করে একটু পানি মুখে দিলো সে। মনে মনে ভাবছিল এই গুহার মালিক কে? যতোই এদিকে সেদিক তাকালো কাউকেই দেখতে পেলো না। তবে গুহার শেষ প্রান্তে একটা হ্রদ তার নজরে এলো। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো মহিলা।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছিলো। মহিলা ভাবলো রাতের বেলা নিশ্চয়ই গুহার মালিকের দেখা পাওয়া যাবে, দিনের বেলা হয়তো কাজে কর্মে গেছে কোথাও। সে নিজেকে ভালো করে লুকানোর চেষ্টা করলো। এমন এক জায়গা বেছে নিলো যেখানে লুকালে একদম দেখা যাবে না। মহিলা দেখতে চাচ্ছিলো কে বা কারা এই গুহায় বাস করে। হঠাৎ কানে ভেসে আসতে লাগলো: ‘উটেরা হায় হায়…. ঘোড়ার পাল হায় হায়…… মেষের দল হায় হায়….. গরুর পাল হায় হায়….’ শব্দ যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে তাকিয়ে দেখলো এক পাল পশু এগিয়ে আসছে গুহার দিকে।
একটা সময় গুহায় ফিরে এলো এবং যে যার জায়গায় চলে গেল। কিন্তু পশুগুলোর সাথে কাউকেই দেখা গেল না। অবাক হয়ে গেল মহিলা। একটু পরে দেখা গেল ছোট্ট একটি মানুষ চিরুনির সমান হবে, বসে আছে একটি ছাগলের শিঙে। ওই ছাগল ধীরে ধীরে আসছে গুহার দিকে। গুহামুখে আসার পর ছোট্ট মানুষটি ছাগলের শিঙ থেকে নীচে নেমে এলো। চামড়ার একটা বিছানা বিছিয়ে বসলো এবং দেয়ালে হেলান দিলো। হঠাৎ আশপাশে দেখে বললো: কেমন যেন মানব গন্ধ পাচ্ছি, মানবগন্ধ…। এই বলে নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকলো। কাউকে খুঁজে না পেলেও সে নিশ্চিত যে গুহায় কোনো মানুষ আছে। চীৎকার করে বললো: ‘যে-ই আছো গুহার ভেতরে, মানুষ হও, জিন হও, দৈত্য হও কিংবা পরী বেরিয়ে আসো লুকিয়ে থেকো না। সোলায়মান নবীর কসম, তোমাকে কিছু করবো না। বেরিয়ে আসো’!
মহিলা এবার অন্ধকার স্থান থেকে বেরিয়ে এসে বললো: আমি মানুষ। তোমার ঘরে আমার কোনো কাজও নেই। এই পাহাড়ের ভেতর আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। তাই ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি পাবার জন্য একটু আশ্রয় নিয়েছি এখানে। ছোট্ট মানুষটির নাম হলো কাল্লে গাগ। তার মাথা মুণ্ডানো ছিল ডিমের মতো। সে মহিলাকে বললো: তুমি আমার মায়ের মতো। আমিও তোমার সন্তানের মতো। আমার কেউ নেই। তাই তুমি এখানেই থাকো। আমি দিনের বেলা চলে যাই রাখালবৃত্তিতে। ঘর খালিই থাকে। তুমি ঘরটা একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে আর খাবার দাবারের ব্যবস্থা করবে। সব মিলিয়ে বাসা দেখভাল করবে।
কাল্লে গাগের প্রস্তাবে মহিলা বেশ খুশি হয়ে গেল। সে মেনে নিল। তারপর থেকে কাল্লে গাগ দিনের বেলা চলে যায় মেষ চরাতে। পাতিলে মাংস দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যায় সে। দায়িত্ব দিয়ে যায় মহিলার ওপর। সন্ধ্যায় যখন ফিরতো বাসায়, ততক্ষণে মাংস বেশ সুন্দর সিদ্ধ হয়ে যেত। সেগুলো রান্না করে দু’জনেই খেত। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিনরাত।
একদিন হঠাৎ মহিলার মনে পড়ে গেল তার নিজের সংসারের কথা, ছেলেপুলের কথা। বাচ্চাদের জন্য তার মন পুড়ছিল। কাল্লে গাগকে সে বললো: আমার ঘর আছে। ছেলেপুলে আছে। তাদেরকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে। কাল্লে গাগ বললো: ঠিক আছে। দেখে আসো! মহিলা কিছু মাংস ও অন্যান্য খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের বাসার উদ্দেশ্যে।#