গরম লাল চা

রাস্তার আশপাশে গড়ে ওঠা ছোটখাটো চায়ের দোকানের সাধারণত তেমন কোন নাম থাকে না। তবু কয়েকদিন ধরে বেশ আগ্রহ সহকারে দোকানের নামটা জানার চেষ্টা করে আসছে মমিন। আজকে গরম চায়ে দ্বিতীয়বার চুমুক দেবার আগে এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। আজকেই তাকে নামটা জানতে হবে। হ্যাঁ, আজকেই। কিছুক্ষণ আরেকটু ভেবে হটাৎ নিজেকেই জিজ্ঞেস করে মমিন, আজকে মানে কি, এখনই! চায়ের দোকানে মাত্র দুজন লোক কাজ করে। ঠিক দুজনও না, কাজ করে মূলত একজন। তাকে আবার লোকও বলা চলে না, বলতে হয় ছেলে। বয়স হবে এই চৌদ্দ ষোলোর ভেতর। আর একজন হল এই দোকানের মালিক। যিনি সারাদিন বসে বসে পান চিবান আর খদ্দেরদের কাছ থেকে টাকা গুছান। এমনিতে বিষয়টা খুব সাধারণ হলেও মমিনের কাছে পুরো ব্যাপারটাÑ অদ্ভূদ!
এই, শোন তো।

জামসেদুর রহমান সজীব
জ্বি আমারে কিছু কইলেন? মমিনের ডাক পেয়ে দোকানের ছেলেটি সেটা নিশ্চিত হতে চায়।
হু। তোকে ডাকলাম তো। আচ্ছা, তোদের এই দোকানের নামটা কি?
ক্যান? চায়ের দোকান।
আরে…! সেটা তো আমিও জানি যে এটা চায়ের দোকান। কিন্তু দোকানের একটা নাম তো থাকে, যে নামে এলাকার সবাই এই দোকানকে চিনবে?
ও, তাই কন। এমনিতে তো তেমন কুনো নাম নাই। তয় রহিম ব্যাপারীর চায়ের দোকান কইলে ধরেন ব্যাবাক মাইনষে চিনব এই দোকানডারে।
আচ্ছা। ঠিক আছে। তুই যা।
রহিম ব্যাপারীর দোকান। রহিম ব্যাপারীর দোকান! মনে মনে কিছুক্ষণ নামটা বিরবির করে মুখস্থ করার চেষ্টা করল মমিন। আর এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিপত্তি বাধলো আরেক জায়গায়। অমনোযোগী হয়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে নিজের জিভ পুড়িয়ে ফেলল। চায়ের ছ্যাঁকটা পাবার পর এক প্রকার লাফিয়ে উঠে নিজের কাপড়ে চা ফেলে সে এক বাজে অবস্থা তৈরী করে ফেলল মমিন। কিন্তু কিছু করার নেই। দোষটা তার। ফলটাও তাকেই ভুগতে হবে।
প্রথম কাপ চা নষ্ট করার পর চা খাবার জেদটা আরও বেশি রকমে চেপে যায় মমিনের। দ্বিতীয় বার চা কিনে খেয়ে তবেই দোকান ত্যাগ করে। মমিন যে হোস্টেলে থাকে সে হোস্টেল থেকে এই চায়ের দোকানটা কম করে হলেও পায়ে হেঁটে দেড় ঘণ্টার পথ! অথচ তার হোস্টেলের আশপাশেই কিন্তু অসংখ্য চায়ের দোকান আছে। কিন্তু তবু মমিন চা খেতে এতদূর আসে, পায়ে হেঁটে। গত দু মাস হল রোজই আসছে। একদিনও মিস নেই। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণও আছে। খুব অদ্ভূদ একটা কারণ। অন্তত মমিনের কাছে কারণটা অদ্ভূদই! দু মাস আগে একদিন হটাৎ বন্ধুর একটা কাজে পাশের এলাকাতে গিয়েছিল মমিন। সময়টা ছিল বিকেল, তার উপর বর্ষা মৌসুম। বাসায় ফেরার পথে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় মমিন রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটায় গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানিকে এক কাপ লাল চা দিতে বলতে গিয়ে এক মজার কান্ড ঘটে গেল। মমিনের সাথে একই সঙ্গে একটি মেয়েও লাল চা চেয়ে বসল। ঘটনার আকস্মিকতায় মমিন বিব্রতভাবে পাশে তাকিয়ে দেখে একটি রিক্সা দাঁড় করানো। আর রিক্সার ভেতর একজন মেয়ে বসে। রিক্সাওয়ালাকেও একটু পর দেখা গেল, সে আগে থেকেই দোকানে বসে চা খাচ্ছে। মেয়েটার গলার আওয়াজ শুনে রিক্সাওয়ালা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলÑ আপা কি কইলেননি?
হ্যাঁ। দোকানিকে বলো তো মিষ্টি করে এক কাপ গরম লাল চা দিতে।
আচ্ছা আফা, আমি এহনি আনতেছি। কথা বলার জন্যে মেয়েটি ঝুঁকে রিক্সার বাইরে মাথাটা এনেছিল। সেই মূহুর্তে মমিন মেয়েটাকে দেখতে পায়। একেবারে অন্যরকম লাগে তার কাছে। মেয়েটির চেহারায় একটা স্নিগ্ধতা আছে। কণ্ঠটা অসম্ভব রকম সুন্দর এবং মিষ্টি। এতই মিষ্টি যে দোকানি যদি চিনি ছাড়াও চা দেয় তবে মমিন নিশ্চিত চা’টা মেয়েটার গলায় নামতেই মিষ্টি হয়ে যাবে! কিছুক্ষণ পর মমিন কি মনে করে যেন মেয়েটির ন্যায় দোকানিকে মিষ্টি করে এক কাপ লাল চা দিতে বলে। অথচ মমিনের কিন্তু খুব মিষ্টি চা খাবার অভ্যাস নেই। মমিন চা খেতে খেতে অপেক্ষায় থাকল কখন আর একবার মেয়েটিকে এক নজর দেখা যায়। কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। মেয়েটি দ্বিতীয়বার দেখা দিল না। বৃষ্টিও থেমে আসল। আর বৃষ্টি থেমে আসতেই রিক্সাওয়ালা মেয়েটিকে নিয়ে তার গন্তব্যে রওনা হয়ে গেল। সেই মূহুর্তে যদি মেয়েটি একটি বারের জন্যেও মমিনের দিকে এক নজর চাইত, তখন সে দেখতে পেত মমিনের চোখে মাত্রই মেঘের বিস্ফোরণ ঘটেছে। কি এক অজানা কারণে মমিন তার চোখ ভিজিয়েছে।
তারপর কেটে গেছে দু’টো মাস। মমিন সেই আগের মতই রয়ে গেছে। যা কিছু বদলেছে সব মনের ভেতর। রোজ রোজ বিকেল হলেই মমিন তার হোস্টেল ছেড়ে অত্র এলাকার রহিম ব্যাপারীর চায়ের দোকানে গিয়ে হাজির হয়। অর্ডার করে এক কাপ মিষ্টি লাল চা। বেশ তৃপ্তি সহকারে সেই চা’টা খায় মমিন। আর অপেক্ষায় থাকে অপ্রত্যাশিত একটা মূহুর্তের। যে মূহুর্তটার জন্যে মমিন বিগত দু’মাস রহিম ব্যাপারীর চায়ের দোকানে এসে বসে থাকে। খুব অদ্ভূদ লাগে মমিনের। তবে কি এক ভালো লাগায় ঠোটের কোণে সব সময়ই এক চিলতে মৃদু হাসি লেগে থাকে। মন্দ নয়। বেশ তো যাচ্ছে!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!