একটা মানুষের আর কত সয়।শেষ পর্যন্ত গজুখুড়ো কার কয়েকবার একটা ভাঙ্গা ছাতার ন্যাড়া বাটের আগায়,একটা ছোট পুঁটলি বেধে রেগেমেগে সত্যি সত্যি বনে চলে গেলেন।যাবার আগে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে গেলেন,আমি চললাম হয়ত তোমাদের সাথে আমার শেষ দেখা।যদি কোন ফালতু সম্পতি থাকত,সে সব তোমাদের মধ্যে ভাগ রকে দিয়ে জেতাম।কিন্তু সে শব বলাই রাখার কোনো সুযোগ দাওনি,তখন সে কথা উঠছে না।অবিশ্যি পৈত্রিক সম্পতি শেয়ার আছে।আরও তিনদিন পুরুষ যাবৎ দলিল পত্র খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।জমি-জমার চৌহদ্দি তো কারো জানা নেই-ই,উপরন্ত মধ্যি খান থেকে-এখানে নালু ভুলু ন্যালা খ্যাপা ইত্যাদি দলের মধ্যে কেউ এক জন বলে উঠল,ওরে খোঁড়া লিখে রাখ।
সত্যি সত্যি উপরন্ত দিয়ে বাক্য রচনা করেছে-বড়জন প্রচণ্ড ধমক দিলেন,ছোটদের দেখা যাবে,শোনা যাবে না।ফুলিদিও তেড়ে বলল,কেন যাবে না।আহা,তাহলে খেজুর শেষ কথাগুলো যেন শুনতে পাব না।বলে যা গজু,মনে রাখিস সবচেয়ে সুবিধা হল যে যদি কোন গুনুধর তার অংশ বেঁচে দিয়ে থাকেন,তারো কোন প্রমান নেই।সে যাই হোক গে,বাকি কথা বেড়ে গেলে মহা হালকা করে যাস।গজুখুড়ো হাড়ি মুখে করে বললেন,আমি চললাম।এ বাড়ির লোকেদের চাইতে বনের বাঘের দয়ামায়া বেশি-বড়জন ধমক দিয়ে বললেন,আরে বাজে বকিস নে।গত ৪০ বছরের মধ্যে তুই একবারও ছিঁড়িখানায় যাস নি,বাঘ দেখিসনি আর সদর বনের লোকেশন-ও জানিস নে।তাছাড়া বাঘ না বন বিড়াল না খাটাস তা চোখে দেখলেও চিনবি নে।এ ধরনের তুচ্ছ হিংসার কথা শুনে,কান লাল করে গজুখুড়ো হাটা দিলেন।তার এক মাত্র সান্তনা যে পুঁটুলিতে বাঁধা আছে,নিতান্ত দরকারি জিনিসপত্র ছাড়াও ঝুলিতে রাখা কুড়িটি মাংসের বড়া আর কুড়িটা তিন কোনা পরেটা।এতে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না।কারণ আত্নহত্যা মহাপাপ আর এতটুকু তার কর্তব্যই বলা যায় না।আর না খেলে তোঁ কেউ বাঁচতে পারে না।মন ভাল রাখার জন্য বাটা সুদ্ধ সব মিঠে পানও পকেটে ভরে এনেছেন।দুইদিন ভাল চলবে। বাবা!গজু দত্ত চৌধুরি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভুতের ব্যাগার খেটে এনেছে তা ভুললে চলবে কেন?কোথায় যে যাচ্ছেন নিজেও জানে না।আসলে এদিন তা অনেক দিন আসি নি। সে যাই হোক ওসব ভাবলে চলবে ন।গজুগুড়ো অন্য চিন্তা ছেড়ে হেঁড়ে গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে গাইতে বড় বড় পা ফেলে হেঁটে চললেন।মনে পড়ে মিলিটারিতে মুখ্য নবগতরা লেফট রাইট গুলিয়ে ফেলত বলে,এক পায়ে ঘাস,বিচুলি মাচ করাতে হত,ঘাস বিচালি-ঘাস বিচালি।
বলতে বলতে পায়ে চলার ভারি ছন্দ এসে গেল।গজুখুড়ো অনায়াসে ঘণ্টা তিনেক হাটা দিয়ে এক অজানা বনভুমিতে পৌছে দেখেন পথ তার কাঁটাগাছের বেড়ার সামনে শেষ হয়ে গেছে। কাটাগাছের বেড়ার পাশেই একটা বাস স্টপ দেখে গজুখুড়ো খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেখানে দাঁড়ালেন।সংসারের উপর ঘৃনা তার আড়াই গুন বেঁড়ে গেল।পায়ের বুড়ো আঙুল ফোস্কা,তলায় গোটা তিনেক পেরেক তোঁ ফুতেছেই,বেশিও হতে পারে।আর বলে কি না দিশী চপ্পলে লোহার জিনিস থাকে না,শুধু সেলাই করে তৈরি।এতে তার বন গমনের বাসনা আরও বেড়ে গেল।গাছের ফলমূল খাবেন,ঝর্নার বিশুদ্ধ জল পান করবেন,সভ্যতা একটা অভিশাপ ছাড়া আর কিছু নয়।যত তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলা যায় ততই মঙ্গল।আহঃবাচা গেল,ঐতোঁ বাসের হেড লাইট!আর হাঁটতে হবে না। বাসে একটু ঝিমুনি ধরেছিল হয় তোঁ;হঠাৎ ঝাকি দিয়ে ড্রাইভার বলল,সামনে গাছ ভেঙে পড়েছে,আর যাবে না।বলে দিব্যি শেয়ার ব্যবস্তা করতে লাগল।গজুখুড়ো চেয়ে দেখেন দুদিকে ঘন বন।ভালোই হল,এই তো বনে গমন করবার উৎকষ্ট যায়গা।পেরেক উঠা চটি জোড়া সিটের তলায় গুঁজে দিয়ে ছাতার বাটে বাঁধা পুঁটুলি সহ খুড়ো বাস থেকে নেমে পড়লেন।তারার আলোয় চারিদিকে তাকিয়ে হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।এক দিকের বনের আগাগোড়া জদ্দুর চোখ যাই দুমানুষ উঁচু পাঁচিল তোলা,অন্য দিকে ঘন বনের গাছরা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে,যেন ডুকটে মানা করছে।আম্পদ্দা তোঁ কম নয়।উনি হলেন বলতে গেলে একরকম বনের মালিক।আর ওকেই ডুকটে মানা করা।আর ও শাপটাও নিশ্চয় ওদের এলাকা।সরকারের আস্পদ্দা দেখে অবাক হতে হয়।সাধে ভোট পায় না।বাড়ি বাড়ি ঘুরে,একটা পরিবারে প্রাইভেট প্রপাটি বাইরের লোককে ঘিরে নেবে আর কেউকিছু বলবে না।এর একটা বিহিত উনি না করে ছাড়বেন না।ঠিক এই সময়ে একেবারে কানের কাছে একটা হিংস্র বন্য ডাক শুনে,এক সৌড়ে অন্য পাশের ঐ দুর্ভেদ্য বনের মধ্যে সেদিয়ে গেলেন।আহঃবাচা গেল। এখানে কি শান্তি,কি আরাম।রাস্তা থেকে যাকে বলা হয়েছিল দুর্ভেদ্য অরন্যনী,ভেতর সেদিয়ে মনে হচ্ছে শান্তিনিকেতন।বরং আরও ভাল।সেখানে সেবার পৌষে সে কি হট্টগোল শুনে এসেছিল।এখানে কি শান্তি,কি আরাম!
কিছুদূরে চলে এসে গজুখুড়ো দেখেন যেন তাড়ি অপেক্কায় দাঁড়িয়ে আছে ডালপালা মেলে একটা বটগাছ।ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো টুকরো টুকরো ছড়িয়ে আছে।পাশের একটা ছোট পুকুরের জল টলমল করছে।আর কি চাই? পুটলা-পুটলি নামিয়ে রেখে খুড়ো গিয়ে ক্লান্ত পা দুতিকে আস্তে আস্তে জলে নামিয়ে দিলেন।মনে হল সব জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে গেল।আমার চোখ বুজে আসছিল,এমন সময় কি একটা বড় কিছু জল থেকে ঘাই দিয়ে উঠল!বাব!ছোট হাঙ্গর টঙ্গর নয়তো!টপ করে তুলে নিয়ে খুড়ো ছুটে এসে বট গাছের একটা মস্ত উঁচু শেকড়ের উপর বসে পড়লেন।এবার খাদ্য গুলো সদ্ব্যবহার করা যাক।শেষটা যদি ভেপসে উঠে।তাদের উপর দিয়েতো কম ঝক্কি যায়নি।ভাগ্যিস পা জলে দেবার আগে হাতে মুখে আচ্ছা করে জল দিয়েছিলাম।এই সব ভাবতে ভাবতে গজুখুড়ো পুঁটলিটি খুলে সুখাদ্য নামক দোকানের দুটি বাক্সে পোরা মাংসের বড়া আর পরেটা বের করলেন।খোদ বড় বৌঠানের রান্না।সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধে চারি দিকে মো মো করে উঠল।আর-আর –দুপাশের কালোপানা বড় সাইজের বোন মানুষ না ভাল্লুক না কি যেন ঘেঁসে এসে হাত থেকে বাক্সসুদ্ধ কেড়ে নিল।নাকে এল একটা ঘেমো ঘেমো বুনো গন্ধ।না,মুচ্ছো যাননি গজুখুড়ো।সারা জীবন সেই ঠাকুর দাদা,বাবা,বড় দার আমল থেকে তিনি বিপদের মোকাবেলা করে এসেছেন,এখন এলিয়ে পড়ার বান্দা নন তিনি।সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে মাথার উপরকার ঝুলে ডাল ধরে ফুড়ুৎ করে উপরে উঠে গেলেন এবং অনেক টা উচুতে না পৌছনো অবধি থামলেন না। সেখানে একটা ফ্যাকড়ে জায়গায় পা গুটিয়ে বসে দুই হাত শুন্যে তুলে টকশোরের শুরু তাহাগিদে স্মরণ করে বিনিতভাবে বললেন ই-ই-ই-ক! চারদিক প্রথমে চুপচাপ।দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল হালুম হুলুম ডাক।
তার সাথে গায়ের রক্ত মিহি করা একটা খ্যা-খ্যা-খ্যা-খ্যা মত বিকট হাসি।খুঁড়োর গায়ের সব চুল খাড়া দিয়ে উঠল।তবে কি ঘুমিয়ে পড়ে একে বারে সোদর বনে পৌছে গেছেন?সেখানে তো ঘনঘন ঝড় ঝাপটা হয়।নাকি-নাকি- একটা বিশ্রী সম্ভনা মনের মধ্যে দানা বাধতে লাগল-নাকি মালিকের গাড়ি-সমিতির সুযোগ নিয়ে এখানে দিব্যি সুন্দর এক সংরক্ষিত অরন্য ফাঁদা হয়েছে।কি সাংঘাতিক কথা!তাই উঁচু দেয়াল।অথচ ন্যায্য মালিকের নো পয়সা নোট কিচ্ছু। রাগের চোটে গাছতলার ভাল্লুকদের এবং ফেলে রাখা ২০টা মাংসের বড়া আর ২০ তিন কোনা পরেটার কথা মনেই ছিল না।এই সময় নিচে একটা হাঁচড় পাঁচড় শব্দ শোনা গেল আর পায়ের আঙুল কিসে এসে আঁচড়াল।ভালুক!ভালুক রা গাছে চড়ছে!পা গুটিয়ে নিয়ে প্রাণপণে গাছ আঁকড়ে ধরলেন গজুখুড়ো।গাছের গায়ে একটা খদল মালুম দিল আর তার মধে সযত্নে রক্ষিত সম্ভুত দস্যুদের রক্ষিতা একটা গয়নার বাক্স।আরো মনে গেল ভাল্লুক রা ফলমূল,মধু,পোকামাকড় ইত্যাদি নিরামিষ খাবার খায়।রেগে একটু পা চুড়ে বললেন,এ্যাই!কি হচ্ছে!নিচের থেকে খাবার আর ন্যালার আর খ্যাপার মিলিত কণ্ঠস্বর কানে এল আহা, ২০তা বোড়া আর ২০টা পরেটা তাতে তোমার কম অধিকার না থাকলেও তোমার আগে তো নিলেন তার দু।চারটি পড়ে।ভালো চাও তোঁ নেমে এসো।নইলে সব খেয়ে ফেলব।আর বেশিক্ষন রাখলে ভেপসেও উঠবে।আঃ বাঁচা গেল।ন্যালা খ্যাপার গলা যে এত মিষ্টি,খুড়ো তা আগে লক্ষ্য করিনি।তবুও অদের আসকরা দিলে মাথায় উঠবে।তাই কড়া গলায় বললেন,বগলে এত বড় একটা গয়নার বাক্স নিয়ে কি করে নামবি শুনি?তাছাড়া অনহারে অত্যাচারে আত্নীয়স্বজনের নির্মম ব্যাবহারে আমার পা কাপছে,হাতে জর পাচ্ছি না।ন্যালা বলল,এই ছোড়দা,খুঁড়োর বাক্সটা নিয়ে নে,তার পর ঠেলে ফেলে দে।এত দুঃখ কষ্টে জখন টস্কান নি,এই সামান্য পতনে কিছুই হবে না।বাক্স বগলে নিয়েই খচ মচ করে নিচে নেমে,টেনে এক চড় না দিয়ে ছেলেদুটোকে বুকে জড়িয়ে ধরে,হাউ-মাউ করে কেঁদে খুড়ো বললেন,ওরে হতভাগারা,এ জন্মে আর দেখা হবে না। ন্যালা বলল,হু,বললেই হল কি না।তাহলে জিবনের সত্য অভিজ্ঞতা গুলো শেখাবে কে শুনি? ওরা বড় জামাটার টমটম গাড়ি এনেছিল।
ঘোড়ার মুখে দানার থলি ঝোলানো ছিল সে চুপ করে দাড়িয়েছিল।সইস বগেশ লাগামটা ঘোড়ার গলায় ঝুলিয়ে রেখে,গাড়িতে বসে নাক ডাকাচ্ছিল।খ্যাপা বলল,অ্যাই তর ভুতের ভয় নেই?কি যে বল দাদা, আমার গলায় ভুতের মাদুলি আছে না।বারি পৌছাতে মাত্র আধঘণ্টা লেগেছিল।গজুখুড়ো তোঁ অবাক!বাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুম দিলেন, তার আগে হেঁটে হেঁটে চপ্পলের দফারফা।আর ফিরতে আধ ঘণ্টা।বড় জ্যাঠা বলেন,তা তুই যে আমাদের পুরনো তিন ভাগ বেড় দিয়েছিস।গাছ না পড়লে আবার বারি পৌছে যেতিস,অত কষ্ট করতে হত না।ন্যাগা বগল থেকে বাক্স বের করে বলল,আরও এটাও পাওয়া যেত না।বড় জ্যাটা পড়ে জান আর কি!ই কি এ যে সেই তিন পুরুষ নিখোঁজ দলিলের বাক্স।এর চাবি আমার মাথার কাছে আছে। আশা হচ্ছে জমিদার চৌহদ্দির রহস্য বোধ হয় ভেদ হবে।গজু খুড়ো গরম হয়ে বললেন,জান বড়দা,আমাদের কিচ্ছু না বলে দুমানুষ উঁচু পাঁচিল ঘিরে বোধ হয় ব্যাঘ্র প্রকল্প বানিয়েছে।হালকা হুলুম ডাক শুনলাম,আরে ও দিকটা নয়রে,ওটা তোঁ আমরা সরকারকে ভাড়া দিয়েছি,নাসে মাসে মোটা টাকা পাওয়া যায়।
অন্য দিকটা নিয়ে ভাবনা ছিল।এবার ফয়শালা হবে।ওখানে বাক্স কি করে গেল।তাই ভাবি।বাক্স খোলা হল।সব জিনিস নিখুঁত নকসা আঁকা,দলিলপত্রে কেউ আঁচড় কাটিনি।দেখে সবাই হাঁ।কোন প্যাঁচ নেই।তাহলে লুকানো কেন?টুপ করে একটা ছোঁড়া কাগজের টুকরো মাটিতে পড়ল।তাতে সবুজ কালিদিয়ে,আঁকাবাকা অক্ষরে ভুল বানান সহ লেখা রয়েছে যেমন আমার লজেন লুকিয়ে রাখছি।দাদু বুজুক ঠেলা।ইতি দেবেশ।বড়দাদু রেগেমেগে বললেন, বেটাচ্ছেলে তো কম বদমাইশ নয়।সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল,অ্যা!কি দুষ্ট!কে এই দেবেশ? দাদু কাণ্ঠ হেসে বললেন,স্বয়ং আমার ঠাকুরদা।ওরে চিঠিটা তুলে রাখ।ওর ঐতিহাসিক মুল্য আছে।