
হযরত হুদ (আ) ছিলেন হযরত নূহ (আ)-এর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ। পাপ আর অন্যায়ের জন্য মহান রাব্বুল আলামীন নূহ (আ)-এর কওমকে গজবে নিপতিত করেন। মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়ে যায় তারা যারা কখনো ঈমান আনেনি। আর বেঁচে রইলো তারা যারা ঈমান এনেছিল আল্লাহর প্রতি এবং নূহের (আ) প্রতি। নূহ (আ)-এর বেঁচে যাওয়া সেই মানবগোষ্ঠী ইরামের বংশধারা পর্যন্ত একই বংশোদ্ভূত থাকে। ইরামের মধ্যে গড়ে উঠলো দুটি শাখা। একটির নাম আদ, আর অপরটির নাম সামুদ। মহান আল্লাহ আদ জাতির জন্য নবী হিসেবে নির্বাচন করলেন হুদকে (আ)। আর সামুদ জাতির নবী হলেন সালেহ (আ)। আদ এবং সামুদ জাতির জন্য এই দুইজন নবী ছিলেন একই সময়ে। এটা ছিল আল্লাহ পাকেরই এক বিশেষ মর্জি।
আরও মজার বিষয় হলো, হযরত হুদ এবং সালেহ (আ) একই সাথে হজ্ব আদায় করতে গিয়েছিলেন। তাদের হজ্বের বিবরণ দিতে গিয়ে রাসূল (সা) হযরত আবু বকরকে (রা) বলেন, ‘এই আসফান উপত্যকা দিয়েই হুদ এবং সালেহ (আ) আতিকের (বাইতুল্লাহর) হজ্ব করতে গিয়েছিলেন। তারা যাবার সময় আসফান উপত্যকার ওপর এসে ‘লাব্বাইক’ তালবিয়া বলেছিলেন। তাদের পরণে কম্বলের লুঙ্গি এবং গায়ে ছিল পালক অথবা চামড়ার চাদর।’
হযরত হুদ (আ) ছিলেন আদ জাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত নবী। তিনি তাঁর জাতিকে সবসময় ডাকতেন আল্লাহর পথে, সত্যের পথে, আলো ও ন্যায়ের পথে। কুরআন মজীদে আল্লাহ পাক ‘হুদ’ নামে একটি সূরা নাযিল করেছেন। এই সূরায় বিভিন্ন আয়াত থেকে জানা যায় হুদ (আ)-এর দাওয়াত ও বিবিধ বিষয় সম্পর্কে। যেমন সূরা হুদের ৫০ থেকে ৫৭ নম্বর আয়াতে হুদ (আ)-এর দাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহপাক বলছেন, “আদ জাতির জন্য আমি তাদের ভাই হুদকে নবী মনোনীত করলাম। হুদ বললো, ‘হে আমার জাতি! আল্লাহর আইন মেনে চলো। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। তোমরা শুধু মিথ্যাই রচনা করে যাচ্ছো। আমি তোমাদের কাছে পারিশ্রমিক চাই না। আমার দাওয়াতের বিনিময়ে আল্লাহ পাকই আমাকে উত্তম পুরষ্কার দান করবেন। হে আমার জাতি! তোমাদের অপরাধের গুনাহ মাফ চেয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত কর। তিনি তোমাদের প্রতি রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদের শক্তি-সামর্থ্য বাড়িয়ে দিতে থাকবেন।”
হযরত হুদ (আ) তাঁর জাতিকে বুঝাতে চাইলেন: “পাপপ্রবণ অবাধ্য জাতির মত তোমরা আমার কথার অবধ হয়ে আল্লাহর দিকে বিনীতচিত্তে ফিরে আসতে অনীহা পোষণ করো না।” হুদ (আ)-এর আকুল আহবানে তার জাতির মানুষ বললো: “তুমি তোমার নবী হবার কোনো প্রমাণই আমাদের সামনে পেশ করছো না। সুতরাং তোমার কথা মেনে নিয়ে আমরা আমাদের মাবুদগুলোকে বর্জন করতে পারি না। আসল কথা হলো, আমাদের কোনো একজন দেবতা তোমাকে বদ আছর করেছে।”
কি বদনসিব আদ জাতির! তারা সত্যকে বুঝতেই চাইলো না। বরং উদ্ভট বাহানা আর অজুহাত দাঁড় করালো। তবুও হতাশ হলেন না হুদ (আ)। ভেঙে পড়লেন না তাদের অশুভ আচরণে। তিনি আদ জাতির এইসব কথার জবাবে বললেন: “আমি আল্লাহ পাককে সাক্ষী রাখলাম। সাক্ষী থাকো তোমরাও। তোমরা যেসব কল্পিত বস্তু আল্লাহর সাথে শরীক করছো, সে সবকে আমি ঘৃণা করি। এমকাত্র আল্লাহ ছাড়া তোমরা সবাই একত্রিত হয়েও আমার কোনো ক্ষতি করতে চাইলেও তা পারবে না। আমাকে কোনো সুযোগই দিও না। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করছি। আল্লাহপাক আমারও প্রতিপালক, তোমাদেরও প্রতিপালক। এই জমিনে জীবিত সকল প্রাণের অস্তিত্বই তাঁর হাতের মুঠোয়। আমার রব অবশ্যই ন্যায়ের পক্ষে আছেন। সুতরাং তোমরা মানতে না চাইলে আমার কিছুই করার নেই। আমার কাছে যেসব ঘোষণা এসেছে, সেসব আমি তোমাদেরকে শুনিয়ে দিয়েছি। মনে রেখ, আমার প্রতিপালক তোমাদের জায়গায় অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করে নেবেন। তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবেনা। প্রকৃতপক্ষে আমার রব এমন যে, সবকিছু তাঁর নখদর্পণে রয়েছে।”
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বললেন, “তারপর আমার চূড়ান্ত ফয়সালা যখন তাদের উপর এসে গেল তখন হুদকে এবং হুদের ঈমানদার সাথীদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম সেই এক ভয়াবহ শাস্তি থেকে।”
হযরত হুদ (আ)-এর জাতিটি ছিল ধনে-বলে ও শক্তিতে সমৃদ্ধ। এজন্য তাদের মধ্যে ছিল আহমের তুফান। তারা কোনো কিছুই পরোয়া করতো না। তারা এক আল্লাহর ইবাদাত ছেড়ে পূজা করতে কল্পিত দেবতার। শিরক, বিদআত আর অন্যায়ের সয়লাবে তারা ভেসে চলছিল। ভেসে গেল তাদের মানবতাবোধ, সুনীতি, ইনসাফ, দয়ামায়া কিংবা ভ্রাতৃত্ববোধ। এক আল্লাহর আনুগত্য বাদ দিয়ে তারা মানবতাহীন জুলুম অত্যাচারে মেতে উঠলো। তারা এতটুকুও কান দিল না আল্লাহর সাবধান বাণীর দিকে। কান দিল না আদ (আ)-এর কথায়ও। আদ (আ) তাঁর জাতিকে আলোর পথ দেখানোর জন্য চেষ্টা চালালেন আপ্রাণ। কতভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন তাঁর জাতিকে। কিন্তু কিছুতেই তারা ফিরে এলো না আল্লাহর পথে। নবীর নির্দেশিত পথে। আসলে দুর্ভাগারা এমনি হয়। তাদের নসিবে কখনো শান্তি জোটে না। আদ জাতির জন্যও তাই হলো। তারা যখন পাপের সাগরে নিমজ্জিত হলো, যখন আল্লাহ পাক ও নবীর বিরুদ্ধাচারণ শুরু করলো, তখন- ঠিক তখনি তাদের ওপর নেমে এলো ঢলের মত বিশাল গজব। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই গজব ছিল তাদের কর্মেরই প্রাপ্য প্রতিফল।
হযরত হুদ (আ) তাঁর জাতির প্রতিটি মানুষকে প্রাণ দিয়ে। সেইজন্য তিনি চেয়েছিলেন তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তি। তিনি দু’হাত তুলে তাঁর জাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেছেন। অথচ, এই অকৃতজ্ঞ জাতিই তাঁকে কষ্ট দিয়েছে নানাভঅবে। তবুও হুদ (আ) কি এক গভীর মমতায় তাদেরকে বললেন: “আমার দায়িত্ব ছিল তোমাদেরকে বলা। তোমাদেরকে আমি সবই বলেছি। তারপরও তোমরা যদি না শোনো, তাহলে তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হবে।” তবুও শুনলো না তারা। বরং হুদের (আ) ওপর তাদের জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। হুদের (আ) বিরুদ্ধে তারা শেষতম আঘাত হানতে প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু আল্লাহপাকেরই ঘোষণা অনুযায়ী তারা হুদের (আ) কোনো ক্ষতিই করতে পারলো না। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি এলো।
সেই ঝড়ে আদ জাতির সকল দর্প ও অহঙ্কারের পর্বত মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তারা। কেবল অক্ষত অবস্থায় বেঁচে রইলেন আদ (আ) এবং তাঁর ঈমানদার সঙ্গীরা। এটা ছিল আল্লাহপাকেরই পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত। সেটাই প্রতিফলিত হলো। সূরা আল আরাফের ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলছেন: “হে (হুদ) তার জাতিকে বললো” তোমাদের প্রতিপালকের ক্রোধ ও শাস্তি তোমাদের ওপর নির্ধারিত হয়ে আছে।” একই সূরার ৭২ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক আরও বলছেন: “আর আমার অভিসম্পাত তাদের (আদ জাতির) সঙ্গে এই দুনিয়ায় রইলো, কিয়ামতেও রইলো। জেনে রাখ (হে নবী আদম)! আদ জাতি রহমত থেকে দূরে সরে গেল। তারা ছিল হুদের জাতি।”
কিভাবে ধ্বংস হলো এই প্রবল প্রতাপশালী জাতি? সবই আল্লাহপাকেরই শান। তিনিই সর্বশক্তির উর্ধ্বে বড় এক মহাশক্তিধর। তাঁর শক্তির সাথে অন্য কোনো শক্তিরই তুলনা চলে না। তারই দৃষ্টান্ত রয়ে গেল আদ জাতির ওপর। মাহন প্ররাক্রমশালী আল্লাহ পাক বলছেন : “আর আদ জাতিকে ঘূর্ণিবায়ু দিয়ে বিধ্বস্ত করা হয়েছে। সে ঘূর্ণিবায়ুকে সাত আট দিন ধরে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয। সেই সময় তাদেরকে যদি দেখতে পেতে তাহলে তুমি দেখতে যে, তারা এমনভাবে ভূপাপিত হচ্ছে, যেন তারা খেজুরের কর্তিত ডাল। আজ তাদের কাউকে বেঁচে থাকতে দেখতে পাচ্ছ কি?”
আদ জাতির নিপতিত সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি কেমন ছিল? সহীহ হাদিসে এর কিছুটা বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে: “সেই সময় আকাশের বুকে আদ জাতির মানুষ আর তাদের কুকুরগুলো চিৎকার করছিল। বৃষ্টির মত পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। আকাশে উঠে যাওয়া মানুষগুলো ভূ-পৃষ্টেট পড়লো। পড়ার সময় তাদের খাড়াভাবেনিচের দিকে ছিল। তাই পড়ার পরপরই তাদের মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাদের দেহগুলো থেতলে পড়ে রইলো। সেই থেতলে যাওয়অ দেহ ও মাথার ওপর ঝর ঝর করে পড়ছিল ওপর থেকে পাথর খন্ড। পাথরের আঘাতে তাদের দেহগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তারপর সেগুলো দীর্ঘ পাহাড় আর পাথুরে মাটির ছাইয়ের নিচে ঢেকে গেল। পৃথিবীর বুক থেকে এমনিভাবে বিলীন হয়ে গেল।” (ইবনু কাসীর)
বস্তুত আল্লাহর শক্তিই বড় শক্তি। যে কোনো শক্তিকেই তিনি মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেন। আর তাঁর সাথে কুফরী, শিরক ও বেয়াদবির পরিণাম!- সে তো এক ভয়াবহ অধ্যায়। যেমন তিনি দেখিয়েছেন নূহ (আ)-এর জাতিকে। দেখিয়েছেন আদ ও সামুদ জাতিসহ অনেককেই। সত্য বলতে, এভাবেই আল্লাহর শাস্তি নিপতিত হয় অবাধ্য জাতির ওপর, আর রহমত, বরকত ও সার্বিক নিরাপত্তায় সুস্থির রাখেন তাঁর অনুগত বাধ্য সাহসী প্রিয় বান্দাদের।