খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-তৃতীয় পরিচ্ছেদ

একদিন রাইচরণ হঠাৎ কর্মে জবাব দিল এবং ফেল্‌নাকে কিছু টাকা দিয়া বলিল , “ আবশ্যক পড়িয়াছে , আমি কিছুদিনের মতো দেশে যাইতেছি । ” এই বলিয়া বারাসাতে গিয়া উপস্থিত হইল । অনুকূলবাবু তখন সেখানে মুন্সেফ ছিলেন ।

অনুকূলের আর দ্বিতীয় সন্তান হয় নাই , গৃহিণী এখনো সেই পুত্রশোক বক্ষের মধ্যে লালন করিতেছিলেন ।

একদিন সন্ধ্যার সময় বাবু কাছারি হইতে আসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন এবং কর্ত্রী একটি সন্ন্যাসীর নিকট হইতে সন্তানকামনায় বহু মূল্যে একটি শিকড় ও আশীর্বাদ কিনিতেছেন, এমন সময়ে প্রাঙ্গনে শব্দ উঠিল “ জয় হোক, মা ” ।

বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কে রে । ”

রাইচরণ আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল , “ আমি রাইচরণ । ”

বৃদ্ধকে দেখিয়া অনুকূলের হৃদয় আর্দ্র হইয়া উঠিল । তাহার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে সহস্র প্রশ্ন এবং আবার তাহাকে কর্মে নিয়োগ করিবার প্রস্তাব করিলেন ।

রাইচরণ ম্লান হাস্য করিয়া কহিল , “ মাঠাকরুনকে একবার প্রণাম করিতে চাই । ”

অনুকূল তাহাকে সঙ্গে করিয়া অন্তঃপুরে লইয়া গেলেন । মাঠাকরুন রাইচরণকে তেমন প্রসন্নভাবে সমাদর করিলেন না; রাইচরণ তৎপ্রতি লক্ষ না করিয়া জোড়হস্তে কহিল , “ প্রভু , মা , আমিই তোমাদের ছেলেকে চুরি করিয়া লইয়াছিলাম । পদ্মাও নয় , আর কেহও নয় , কৃতঘ্ন অধম এই আমি — ”

অনুকূল বলিয়া উঠিলেন , “ বলিস কী রে । কোথায় সে । ”

“ আজ্ঞা , আমার কাছেই আছে , আমি পরশ্ব আনিয়া দিব । ”

সেদিন রবিবার , কাছারি নাই । প্রাতঃকাল হইতে স্ত্রীপুরুষ দুইজনে উন্মুখভাবে পথ চাহিয়া বসিয়া আছেন । দশটার সময় ফেল্‌নাকে সঙ্গে লইয়া রাইচরণ আসিয়া উপস্থিত হইল ।

অনুকূলের স্ত্রী কোনো প্রশ্ন কোনো বিচার না করিয়া , তাহাকে কোলে বসাইয়া , তাহাকে স্পর্শ করিয়া , তাহার আঘ্রাণ লইয়া , অতৃপ্তনয়নে তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া , কাঁদিয়া হাসিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন । বাস্তবিক ছেলেটি দেখিতে বেশ — বেশভূষা আকারপ্রকারে দারিদ্র্যের কোনো লক্ষণ নাই । মুখে অত্যন্ত প্রিয়দর্শন বিনীত সলজ্জ ভাব । দেখিয়া অনুকূলের হৃদয়েও সহসা স্নেহ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল ।

তথাপি তিনি অবিচলিত ভাব ধারণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কোনো প্রমাণ আছে ? ”

রাইচরণ কহিল , “ এমন কাজের প্রমাণ কী করিয়া থাকিবে । আমি যে তোমার ছেলে চুরি করিয়াছিলাম সে কেবল ভগবান জানেন , পৃথিবীতে আর কেহ জানে না । ”

অনুকূল ভাবিয়া স্থির করিলেন যে , ছেলেটিকে পাইবামাত্র তাঁহার স্ত্রী যেরূপ আগ্রহের সহিত তাহাকে আগলাইয়া ধরিয়াছেন এখন প্রমাণসংগ্রহের চেষ্টা করা সুযুক্তি নহে ; যেমনই হউক , বিশ্বাস করাই ভালো । তা ছাড়া রাইচরণ এমন ছেলেই বা কোথায় পাইবে । এবং বৃদ্ধ ভৃত্য তাঁহাকে অকারণে প্রতারণাই বা কেন করিবে ।

ছেলেটির সহিতও কথোপকথন করিয়া জানিলেন যে , সে শিশুকাল হইতে রাইচরণের সহিত আছে এবং রাইচরণকে সে পিতা বলিয়া জানিত , কিন্তু রাইচরণ কখনো তাহার প্রতি পিতার ন্যায় ব্যবহার করে নাই , অনেকটা ভৃত্যের ভাব ছিল ।

অনুকূল মন হইতে সন্দেহ দূর করিয়া বলিলেন , “ কিন্তু রাইচরণ , তুই আর আমাদের ছায়া মাড়াইতে পাইবি না । ”

রাইচরণ করজোড়ে গদ্‌গদ কণ্ঠে বলিল , “ প্রভু বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাইব । ”

কর্ত্রী বলিলেন , “ আহা, থাক্‌ । আমার বাছার কল্যাণ হউক । ওকে আমি মাপ করিলাম । ”

ন্যায়পরায়ণ অনুকূল কহিলেন , “ যে কাজ করিয়াছে উহাকে মাপ করা যায় না । ”

রাইচরণ অনুকুলের পা জড়াইয়া কহিল , “ আমি করি নাই, ঈশ্বর করিয়াছেন । ”

নিজের পাপ ঈশ্বরের স্কন্ধে চাপাইবার চেষ্টা দেখিয়া অনুকূল আরো বিরক্ত হইয়া কহিলেন , “ যে এমন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিয়াছে তাহাকে আর বিশ্বাস করা কর্তব্য নয় । ”

রাইচরণ প্রভুর পা ছাড়িয়া কহিল , “ সে আমি নয়, প্রভু । ”

“ তবে কে । ”

“ আমার অদৃষ্ট । ”

কিন্তু এরূপ বৈফিয়তে কোনো শিক্ষিত লোকের সন্তোষ হইতে পারে না ।

রাইচরণ বলিল , “ পৃথিবীতে আমার আর কেহ নাই । ”

ফেল্‌না যখন দেখিল সে মুন্সেফের সন্তান , রাইচরণ তাহাকে এত দিন চুরি করিয়া নিজের ছেলে বলিয়া অপমানিত করিয়াছে , তখন তাহার মনে মনে কিছু রাগ হইল । কিন্তু তথাপি উদারভাবে পিতাকে বলিল , “ বাবা , উহাকে মাপ করো । বাড়িতে থাকিতে না দাও , উহার মাসিক কিছু টাকা বরাদ্দ করিয়া দাও । ”

ইহার পর রাইচরণ কোনো কথা না বলিয়া একবার পুত্রের মুখ নিরীক্ষণ করিল , সকলকে প্রণাম করিল ; তাহার পর দ্বারের বাহির হইয়া পৃথিবীর অগণ্য লোকের মধ্যে মিশিয়া গেল । মাসান্তে অনুকূল যখন তাহার দেশের ঠিকানায় কিঞ্চিৎ বৃত্তি পাঠাইলেন তখন সে টাকা ফিরিয়া আসিল । সেখানে কোনো লোক নাই ।

সমাপ্ত

গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!