রাইচরণ দেশে ফিরিয়া গেল । এতকাল তাহার সন্তানাদি হয় নাই , হইবার বিশেষ আশাও ছিল না । কিন্তু দৈবক্রমে বৎসর না যাইতেই তাহার স্ত্রী অধিক বয়সে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিয়া লোকলীলা সংবরণ করিল ।
এই নবজাত শিশুটির প্রতি রাইচরণের অত্যন্ত বিদ্বেষ জন্মিল । মনে করিল , এ যেন ছল করিয়া খোকাবাবুর স্থান অধিকার করিতে আসিয়াছে । মনে করিল , প্রভুর একমাত্র ছেলেটি জলে ভাসাইয়া নিজে পুত্রসুখ উপভোগ করা যেন একটি মহাপাতক । রাইচরণের বিধবা ভগ্নী যদি না থাকিত তবে এ শিশুটি পৃথিবীর বায়ু বেশিদিন ভোগ করিতে পাইত না ।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে , এই ছেলেটিও কিছুদিন বাদে চৌকাঠ পার হইতে আরম্ভ করিল এবং সর্বপ্রকার নিষেধ লঙ্ঘন করিতে সকৌতুক চতুরতা প্রকাশ করিতে লাগিল । এমন-কি , ইহার কন্ঠস্বর হাস্যক্রন্দনধ্বনি অনেকটা সেই শিশুরই মতো । এক-একদিন যখন ইহার কান্না শুনিত রাইচরণের বুকটা সহসা ধড়াস্ করিয়া উঠিত; মনে হইত, দাদাবাবু রাইচরণকে হারাইয়া কোথায় কাঁদিতেছে ।
ফেল্না — রাইচরণের ভগ্নী ইহার নাম রাখিয়াছিল ফেল্না — যথাসময়ে পিসিকে পিসি বলিয়া ডাকিল । সেই পরিচিত ডাক শুনিয়া একদিন হঠাৎ রাইচরণের মনে হইল, ‘ তবে তো খোকাবাবু আমার মায়া ছাড়িতে পারে নাই , সে তো আমার ঘরে আসিয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছে । ‘
এই বিশ্বাসের অনুকূলে কতকগুলি অকাট্য যুক্তি ছিল, প্রথমত , সে যাইবার অনতিবিলম্বেই ইহার জন্ম । দ্বিতীয়ত , এতকাল পরে সহসা যে তাহার স্ত্রীর গর্ভে সন্তান জন্মে এ কখনোই স্ত্রীর নিজগুণে হইতে পারে না । তৃতীয়ত , এও হামাগুড়ি দেয় , টল্মল্ করিয়া চলে, এবং পিসিকে পিসি বলে । যে-সকল লক্ষণ থাকিলে ভবিষ্যতে জজ হইবার কথা তাহার অনেকগুলি ইহাতে বর্তিয়াছে ।
তখন মাঠাকরুনের সেই দারুণ সন্দেহের কথা হঠাৎ মনে পড়িল — আশ্চর্য হইয়া মনে মনে কহিল , ‘ আহা , মায়ের মন জানিতে পারিয়াছিল তাহার ছেলেকে কে চুরি করিয়াছে । ‘ তখন , এতদিন শিশুকে যে অযত্ন করিয়াছে সেজন্য বড়ো অনুতাপ উপস্থিত হইল । শিশুর কাছে আবার ধরা দিল ।
এখন হইতে ফেল্নাকে রাইচরণ এমন করিয়া মানুষ করিতে লাগিল যেন সে বড়ো ঘরের ছেলে । সাটিনের জামা কিনিয়া দিল । জরির টুপি আনিল । মৃত স্ত্রীর গহনা গলাইয়া চুড়ি এবং বালা তৈয়ারি হইল । পাড়ার কোনো ছেলের সহিত তাহাকে খেলিতে দিত না; রাত্রিদিন নিজেই তাহার একমাত্র খেলার সঙ্গী হইল । পাড়ার ছেলেরা সুযোগ পাইলে তাহাকে নবাবপুত্র বলিয়া উপহাস করিত এবং দেশের লোক রাইচরণের এইরূপ উন্মত্তবৎ আচরণে আশ্চর্য হইয়া গেল ।
ফেল্নার যখন বিদ্যাভ্যাসের বয়স হইল তখন রাইচরণ নিজের জোতজমা সমস্ত বিক্রয় করিয়া ছেলেটিকে কলিকাতায় লইয়া গেল । সেখানে বহুকষ্টে একটি চাকরি জোগাড় করিয়া ফেল্নাকে বিদ্যালয়ে পাঠাইল । নিজে যেমন-তেমন করিয়া থাকিয়া ছেলেকে ভালো খাওয়া , ভালো পরা , ভালো শিক্ষা দিতে ত্রুটি করিত না । মনে মনে বলিত , ‘ বৎস , ভালোবাসিয়া আমার ঘরে আসিয়াছ বলিয়া যে তোমার কোনো অযত্ন হইবে , তা হইবে না । ‘
এমনি করিয়া বারো বৎসর কাটিয়া গেল । ছেলে পড়ে শুনে ভালো এবং দেখিতে শুনিতেও বেশ , হৃষ্টপুষ্ট উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ — কেশবেশবিন্যাসের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি , মেজাজ কিছু সুখী এবং শৌখিন । বাপকে ঠিক বাপের মতো মনে করিতে পারিত না । কারণ , রাইচরণ স্নেহে বাপ এবং সেবায় ভৃত্য ছিল , এবং তাহার আর-একটি দোষ ছিল সে যে ফেল্নার বাপ এ কথা সকলের কাছেই গোপন রাখিয়াছিল । যে ছাত্রনিবাসে ফেল্না বাস করিত সেখানকার ছাত্রগণ বাঙাল রাইচরণকে লইয়া সর্বদা কৌতুক করিত এবং পিতার অসাক্ষাতে ফেল্নাও যে সেই কৌতুকালাপে যোগ দিত না তাহা বলিতে পারি না । অথচ নিরীহ বৎসলস্বভাব রাইচরণকে সকল ছাত্রই বড়ো ভালোবাসিত; এবং ফেল্নাও ভালোবাসিত , কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি ঠিক বাপের মতো নহে- তাহাতে কিঞ্চিৎ অনুগ্রহ মিশ্রিত ছিল ।
রাইচরণ বৃদ্ধ হইয়া আসিয়াছে । তাহার প্রভু কাজকর্মে সর্বদাই দোষ ধরে । বাস্তবিক তাহার শরীরও শিথিল হইয়া আসিয়াছে , কাজেও তেমন মন দিতে পারে না , কেবলই ভুলিয়া যায় — কিন্তু , যে ব্যক্তি পুরা বেতন দেয় বার্ধক্যের ওজর সে মানিতে চাহে না । এ দিকে রাইচরণ বিষয় বিক্রয় করিয়া যে নগদ টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল তাহাও নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে । ফেলনা আজকাল বসনভূষণের অভাব লইয়া সর্বদাই খুঁতখুঁত করিতে আরম্ভ করিয়াছে ।