খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রথম পরিচ্ছেদ

রাইচরণ যখন বাবুদের বাড়ি প্রথম চাকরি করিতে আসে তখন তাহার বয়স বারো । যশোহর জিলায় বাড়ি, লম্বা চুল , বড়ো বড়ো চোখ , শ্যামচিক্কণ, ছিপ্‌ছিপে বালক । জাতিতে কায়স্থ । তাহার প্রভুরাও কায়সথ । বাবুদের এক-বৎসর-বয়স্ক একটি শিশুর রক্ষণ ও পালন-কার্যে সহায়তা করা তাহার প্রধান কর্তব্য ছিল ।

সেই শিশুটি কালক্রমে রাইচরণের কক্ষ ছাড়িয়া স্কুলে , স্কুল ছাড়িয়া কলেজে , অবশেষে কলেজ ছাড়িয়া মুন্‌‌‌‌সেফিতে প্রবেশ করিয়াছে । রাইচরণ এখনো তাঁহার ভৃত্য ।

তাহার আর-একটি মনিব বাড়িয়াছে। মাঠাকুরানী ঘরে আসিয়াছেন ; সুতরাং অনুকূলবাবুর উপর রাইচরণের পূর্বে যতটা অধিকার ছিল তাহার অধিকাংশই নূতন কর্ত্রীর হস্তগত হইয়াছে ।

কিন্তু কর্ত্রী যেমন রাইচরণের পূর্বাধিকার কতকটা হ্রাস করিয়া লইয়াছেন তেমনি একটি নূতন অধিকার দিয়া অনেকটা পূরণ করিয়া দিয়াছেন । অনুকূলের একটি পুত্রসন্তান অল্পদিন হইল জন্মলাভ করিয়াছে, এবং রাইচরণ কেবল নিজের চেষ্টা ও অধ্যবসায়ে তাহাকে সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিয়া লইয়াছে ।

তাহাকে এমনি উৎসাহের সহিত দোলাইতে আরম্ভ করিয়াছে , এমনি নিপুণতার সহিত তাহাকে দুই হাতে ধরিয়া আকাশে উৎক্ষিপ্ত করে , তাহার মুখের কাছে আসিয়া এমনি সশব্দে শিরশ্চালন করিতে থাকে , উত্তরের কোনো প্রত্যাশা না করিয়া এমন-সকল সম্পূর্ণ অর্থহীন অসংগত প্রশ্ন সুর করিয়া শিশুর প্রতি প্রয়োগ করিতে থাকে যে , এই ক্ষুদ্র আনুকৌলবটি রাইচরণকে দেখিলে একেবারে পুলকিত হইয়া উঠে ।

অবশেষে ছেলেটি যখন হামাগুড়ি দিয়া অতি সাবধানে চৌকাঠ পার হইত এবং কেহ ধরিতে আসিলে খিল্‌খিল্‌ হাস্যকলরব তুলিয়া দ্রুতবেগে নিরাপদ স্থানে লুকাইতে চেষ্টা করিত , তখন রাইচরণ তাহার অসাধারণ চাতুর্য ও বিচারশক্তি দেখিয়া চমৎকৃত হইয়া যাইত । মার কাছে গিয়া সগর্ব সবিস্ময়ে বলিত , “ মা , তোমার ছেলে বড়ো হলে জজ হবে , পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করবে । ”

পৃথিবীতে আর-কোনো মানবসন্তান যে এই বয়সে চৌকাঠ-লঙ্ঘন প্রভৃতি অসম্ভব চাতুর্যের পরিচয় দিতে পারে তাহা রাইচরণের ধ্যানের অগম্য , কেবল ভবিষ্যৎ জজেদের পক্ষে কিছুই আশ্চর্য নহে ।

অবশেষে শিশু যখন টল্‌মল্‌ করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল সে এক আশ্চর্য ব্যাপার- এবং যখন মাকে মা , পিসিকে পিচি , এবং রাইচরণকে চন্ন বলিয়া সম্ভাষণ করিল , তখন রাইচরণ সেই প্রত্যয়াতীত সংবাদ যাহার-তাহার কাছে ঘোষণা করিতে লাগিল ।

সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ‘ মাকে মা বলে , পিসিকে পিসি বলে , কিন্তু আমাকে বলে চন্ন । ‘ বাস্তবিক , শিশুর মাথায় এ বুদ্ধি কী করিয়া জোগাইল বলা শক্ত । নিশ্চয়ই কোনো বয়স্ক লোক কখনোই এরূপ অলোকসামান্যতার পরিচয় দিত না , এবং দিলেও তাহার জজের পদপ্রাপ্তিসম্ভাবনা সম্বন্ধে সাধারণের সন্দেহ উপস্থিত হইত ।

কিছুদিন বাদে মুখে দড়ি দিয়া রাইচরণকে ঘোড়া সাজিতে হইল । এবং মল্ল সাজিয়া তাহাকে শিশুর সহিত কুস্তি করিতে হইত — আবার পরাভূত হইয়া ভূমিতে পড়িয়া না গেলে বিষম বিপ্লব বাধিত ।

এই সময়ে অনুকূল পদ্মাতীরবর্তী এক জিলায় বদলি হইলেন । অনুকূল তাঁহার শিশুর জন্য কলিকাতা হইতে এক ঠেলাগাড়ি লইয়া গেলেন । সাটিনের জামা এবং মাথায় একটা জরির টুপি , হাতে সোনার বালা এবং পায়ে দুইগাছি মল পরাইয়া রাইচরণ নবকুমারকে দুইবেলা গাড়ি করিয়া হাওয়া খাওয়াইতে লইয়া যাইত ।

বর্ষকাল আসিল । ক্ষুধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম শস্যক্ষেত্র এক-এক গ্রাসে মুখে পুরিতে লাগিল । বালুকাচরের কাশবন এবং বনঝাউ জলে ডুবিয়া গেল । পাড়-ভাঙার অবিশ্রাম ঝুপ্‌ঝাপ্‌ শব্দ এবং জলের গর্জনে দশ দিক মুখরিত হইয়া উঠিল , এবং দ্রুত বেগে ধাবমান ফেনরাশি নদীর তীব্র গতিকে প্রত্যক্ষগোচর করিয়া তুলিল ।

অপরাহ্নে মেঘ করিয়াছিল , কিন্তু বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা ছিল না । রাইচরণের খামখেয়ালী ক্ষুদ্র প্রভু কিছুতেই ঘরে থাকিতে চাহিল না । গাড়ির উপর চড়িয়া বসিল । রাইচরণ ধীরে ধীরে গাড়ি ঠেলিয়া ধান্যক্ষেত্রের প্রান্তে নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল । নদীতে একটিও নৌকা নাই , মাঠে একটিও লোক নাই — মেঘের ছিদ্র দিয়া দেখা গেল , পরপারে জনহীন বালুকাতীরে শব্দহীন দীপ্ত সমারোহের সহিত সূর্যাস্তের আয়োজন হইতেছে । সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে শিশু সহসা এক দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল , “ চন্ন , ফু । ”

অনতিদূরে সজল পঙ্কিল ভূমির উপর একটি বৃহৎ কদম্ববৃক্ষের উচ্চশাখায় গুটিকতক কদম্বফুল ফুটিয়াছিল , সেই দিকে শিশুর লুব্ধ দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছিল । দুই-চারি দিন হইল, রাইচরণ কাঠি দিয়া বিদ্ধ করিয়া তাহাকে কদম্বফুলের গাড়ি বানাইয়া দিয়াছিল , তাহাতে দড়ি বাঁধিয়া টানিতে এত আনন্দ বোধ হইয়াছিল যে, সেদিন রাইচরণকে আর লাগাম পরিতে হয় নাই ; ঘোড়া হইতে সে একেবারেই সহিসের পদে উন্নীত হইয়াছিল ।

কাদা ভাঙিয়া ফুল তুলিতে যাইতে চন্নর প্রবৃত্তি হইল না — তাড়াতাড়ি বিপরীত দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল , “ দেখো দেখো ও — ই দেখো পাখি, ঐ উড়ে — এ গেল । আয় রে পাখি আয় আয় । ” এইরূপ অবিশ্রান্ত বিচিত্র কলরব করিতে করিতে সবেগে গাড়ি ঠেলিতে লাগিল ।

কিন্তু যে ছেলের ভবিষ্যতে জজ হইবার কোনো সম্ভাবনা আছে তাহাকে এরূপ সামান্য উপায়ে ভুলাইবার প্রত্যাশা করা বৃথা — বিশেষত চারি দিকে দৃষ্টি-আকর্ষণের উপযোগী কিছুই ছিল না এবং কাল্পনিক পাখি লইয়া অধিকক্ষণ কাজ চলে না ।

রাইচরণ বলিল , “ তবে তুমি গাড়িতে বসে থাকো , আমি চট্ করে ফুল তুলে আনছি । খবরদার , জলের ধারে যেয়ো না । ” বলিয়া হাঁটুর উপর কাপড় তুলিয়া কদম্ব-বৃক্ষের অভিমুখে চলিল ।

কিন্তু , ঐ-যে জলের ধারে যাইতে নিষেধ করিয়া গেল , তাহাতে শিশুর মন কদম্ব ফুল হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া সেই মুহূর্তেই জলের দিকে ধাবিত হইল । দেখিল , জল খল্‌খল্‌ ছল্‌ছল্‌ করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে ; যেন দুষ্টামি করিয়া কোন্‌-এক বৃহৎ রাইচরণের হাত এড়াইয়া এক লক্ষ শিশুপ্রবাহ সহাস্য কলস্বরে নিষিদ্ধ স্থানাভিমুখে দ্রুত বেগে পলায়ন করিতেছে ।

তাহাদের সেই অসাধু দৃষ্টান্তে মানবশিশুর চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল । গাড়ি হইতে আস্তে আস্তে নামিয়া জলের ধারে গেল, একটা দীর্ঘ তৃণ কুড়াইয়া লইয়া তাহাকে ছিপ কল্পনা করিয়া ঝুঁকিয়া মাছ ধরিতে লাগিল — দুরন্ত জলরাশি অস্ফুট কলভাষায় শিশুকে বার বার আপনাদের খেলাঘরে আহ্বান করিল ।

একবার ঝপ্‌ করিয়া একটা শব্দ হইল , কিন্তু বর্ষার পদ্মাতীরে এমন শব্দ কত শোনা যায় । রাইচরণ আঁচল ভরিয়া কদম্বফুল তুলিল । গাছ হইতে নামিয়া সহাস্যমুখে গাড়ির কাছে আসিয়া দেখিল , কেহ নাই । চারি দিকে চাহিয়া দেখিল, কোথাও কাহারো কোনো চিহ্ন নাই ।

মুহূর্তে রাইচরণের শরীরের রক্ত হিম হইয়া গেল । সমস্ত জগৎসংসার মলিন বিবর্ণ ধোঁওয়ার মতো হইয়া আসিল । ভাঙা বুকের মধ্য হইতে একবার প্রাণপণ চীৎকার করিয়া ডাকিয়া উঠিল , “ বাবু — খোকাবাবু — লক্ষ্মী দাদাবাবু আমার। ”

কিন্তু চন্ন বলিয়া কেহ উত্তর দিল না , দুষ্টামি করিয়া কোনো শিশুর কন্ঠ হাসিয়া উঠিল না ; কেবল পদ্মা পূর্ববৎ ছল্‌ছল্‌ খল্‌খল্‌ করিয়া ছুটিয়া চলিতে লাগিল , যেন সে কিছুই জানে না, এবং পৃথিবীর এই-সকল সামান্য ঘটনায় মনোযোগ দিতে তাহার যেন এক মুহূর্ত সময় নাই ।

সন্ধ্যা হইয়া আসিলে উৎকন্ঠিত জননী চার দিকে লোক পাঠাইয়া দিলেন । লন্ঠন হাতে নদীতীরে লোক আসিয়া দেখিল , রাইচরণ নিশীথের ঝোড়ো বাতাসের মতো সমস্ত ক্ষেত্রময় “ বাবু খোকাবাবু আমার ” বলিয়া ভগ্নকন্ঠে চীৎকার করিয়া বেড়াইতেছে । অবশেষে ঘরে ফিরিয়া রাইচরণ দড়াম করিয়া মাঠাকরুনের পায়ের কাছে আসিয়া আছাড় খাইয়া পড়িল । তাহাকে যত জিজ্ঞাসা করে সে কাঁদিয়া বলে , “ জানি নে, মা । ”

যদিও সকলেই মনে মনে বুঝিল পদ্মারই এই কাজ , তথাপি গ্রামের প্রান্তে যে এক দল বেদের সমাগম হইয়াছে তাহাদের প্রতিও সন্দেহ দূর হইল না । এবং মাঠাকুরানীর মনে এমন সন্দেহ উপস্থিত হইল যে, রাইচরণই বা চুরি করিয়াছে ; এমন-কি , তাহাকে ডাকিয়া অত্যন্ত অনুনয়পূর্বক বলিলেন , “ তুই আমার বাছাকে ফিরিয়ে এনে দে — তুই যত টাকা চাস তোকে দেব । ” শুনিয়া রাইচরণ কেবল কপালে করাঘাত করিল । গৃহিণী তাহাকে দূর করিয়া তাড়াইয়া দিলেন ।

অনুকূলবাবু তাঁহার স্ত্রীর মন হইতে রাইচরণের প্রতি এই অন্যায় সন্দেহ দূর করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন ; জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, রাইচরণ এমন জঘন্য কাজ কী উদ্দেশ্যে করিতে পারে । গৃহিণী বলিলেন , “ কেন । তাহার গায়ে সোনার গহনা ছিল । ”

গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!