রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি সুস্থ দেহ আর সুন্দর মন নিয়ে ভালোভাবেই পড়াশোনার পাশাপাশি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছো। তবে যে একটা কথা মনে রাখবে, ইহকালীন পরীক্ষাই শেষ পরীক্ষা নয়, পরকালীন পরীক্ষাই চূড়ান্ত পরীক্ষা। অবশ্য পরকালীন পরীক্ষায় ভালোভাবে পাস করার জন্য আল্লাহপাক সুনির্দিষ্টভাবে গাইডলাইন দিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ায় কিভাবে চলতে হবে, কবরে কি কি প্রশ্ন করা হবে তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা আছে। সুতরাং পরকালীন পরীক্ষায় পাস করা কিন্তু তেমন কঠিন নয়। অবশ্য যারা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী দুনিয়ায় কাজ করে না তারা পরকালীন পরীক্ষাকে খুব ভয় করে। কারণ সেই পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। শুধু যে আখিরাতেই অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করতে হবে তাই নয় দুনিয়াতেও অপরাধীদেরকে নানাভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। মোটকথা, অন্যায় কিংবা অপকর্ম করে কেউ পার পেয়ে যাবে এমনটি ভাবা ঠিক নয়।
বন্ধুরা, রংধনু আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প প্রচার করেছি। গল্পটির নাম হচ্ছে ‘খুনের সাক্ষী পাখীরা।’
অনেক দিন আগে ইরানের এক শহরে বাস করতেন এক দরবেশ। দরবেশ ছিলেন খুবই জ্ঞানী। এজন্য লোকজন তাঁকে ‘দানাদিল’ নামে ডাকত। ‘দানাদিল’ মানেই হচ্ছে জ্ঞানী। লোকদের উপকার করা ও বিপদে আপদে সাহায্য করাই ছিল দরবেশের প্রধান কাজ। আর এজন্যই ওই শহরের ছোট-বড় সবাই দরবেশকে খুব সম্মান করতো।
একবার দরবেশ হজ্বে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কোন কাফেলার সঙ্গে না গিয়ে তিনি একাই পায়ে হেঁটে হজ্ব করতে রওনা হলেন। দরবেশ দিনের বেলায় পথ চলতেন আর রাতের বেলায় গ্রাম-গঞ্জে কারো বাড়ীতে কিংবা মুসাফির খানায় অবস্থান করতেন। এভাবে চলতে চলতে একদিন তিনি এক মরুভূমিতে গিয়ে পৌঁছলেন। মরুভূমির এক জায়গায় একটি পুরোনো বাড়ী দেখতে পেয়ে দরবেশ সেখানে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন।
ওই বাড়িতে বাস করতো একদল ডাকাত। ডাকাতরা গাট্টিবোচকা নিয়ে দরবেশকে বাড়ীতে প্রবেশ করতে দেখে খুশিতে বাগবাগ হয়ে গেল। তারা দরবেশকে মেরে সবকিছু কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ডাকাতরা লাঠিসোটা নিয়ে বৃদ্ধকে মারতে উদ্যত হলে দরবেশ বলল : বাবারা! তোমরা আমাকে মেরো না। একটু সবুর কর। আমি বাবা বড়ই একা মানুষ এছাড়া তোমাদের সাথে শক্তিতেও আমি পারবো না। তোমরা প্রথমে আমার কথা শোনো। তারপর যা ইচ্ছে তাই করো।’
ডাকাত বলল : এ্যাই বুড়ো! অনর্থক কথা বাড়াস না। তোর কাছে যা আছে তা ভালোয় ভালোয় দিয়ে দে। তুই মনে করিস না যে, কথার দ্বারা আমাদের ফাঁকি দিতে পারবি।
দরবেশ : না বাবারা! আমি তোমাদের কোন ফাঁকি দিতে চাইনে। আমি কেবল বলতে চাচ্ছি যে, আমার কাছে তেমন টাকা পয়সা নেই। আর আমার কাপড়চোপড় আছে তা তোমাদের কোন কাজেই লাগবে না। আমি দরবেশ মানুষ। হজ্বে যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। আমাকে কষ্ট দেয়া কোন বাহাদুরীর কাজ হবে না। আর আমাকে মেরেও তোমাদের কোন লাভ হবে না।
ডাকাত : তোকে মেরে আমাদের লাভ হবে কি না সে ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান দিতে হবে না। আমরা চোর ডাকাতের খাতায় নাম লিখিয়েছি সবদিক চিন্তা-ভাবনা করেই। আমরা যদি ডান-বাম চিন্তা করেই কাজ করতাম তাহলে তো ভালো মানুষের মতোই রুটি রোজগার করতাম।
দরবেশ : ঠিক আছে। তোমাদের যখন বিবেক বলতে কিছু নেই তাহলে এই নাও আমার গাট্টি বোচকা। এবার আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আমার পথে চলে যাই।
ডাকাত : কি বললি! তোকে ছেড়ে দেব? আমাদেরকে বোকা মনে করিস? তোকে আমরা ছেড়ে দেব আর তুই শহরে গিয়ে আমাদের আস্তানার কথা লোকজনকে বলে দিবি- তাই না? এ সুযোগ তুই পাবি না। বাঁচার চিন্তা বাদ দিয়ে শেষবারের মতো নামায বা দোয়া করার ইচ্ছে থাকলে তা করে নিতে পারিস। তোর হাতে আর সময় নেই।
দরবেশ : আমি জানি, তোমাদের কাছে ভাল কিছু আশা করা বৃথা। তবে তোমরা মনে রেখো, বিনা কারণে একজন অসহায় মানুষের রক্ত ঝরালে তোমাদের কপালে ভয়াবহ শাস্তি নেমে আসবে। তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না যে, কত তাড়াতাড়ি তোমরা আল্লাহর গজব আর মানুষের আদালতের সামনে বিচারের সম্মূখীন হবে।’
ডাকাত : কার বিচার? কিসের বিচার? আমাদের বিচার? হে: হে:হে:। তোকে মেরে ফেললে কে দেবে সাক্ষী? এই জনশূন্য মরুভূমিতে যেখানে গাছপালাও নেই সেখানে আদালত পেলি কোথায়-বুড়ো?
এই বলে ডাকাতরা খঞ্জর হাতে নিয়ে দরবেশকে ঘিরে ধরলো। দরবেশ দিশেহারা হয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলো কারো সাহায্যের আশায়। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন একঝাঁক পাখি তাঁর মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধ দরবেশ তৎক্ষণাৎ পাখিদের উদ্দেশ্যে বললেন: হে পাখিরা! তোমরা সাক্ষী থেকো, এই ডাকাতরা বিনা কারণে আমাকে মেরে ফেলছে। এই জালিমদের অত্যাচারের কথা তোমরা মানুষদের কাছে বলে দিও। ‘
বৃদ্ধের কথা শুনে ডাকাতরা আবারো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তারা দরবেশকে বললো : আমরা তো ভেবেছিলাম তুই একজন জ্ঞানী মানুষ। কিন্তু এখন দেখছি, একেবারে অজ্ঞ, মুর্খ। এ্যাই বুড়ো তোর নাম কি?
দরবেশ : লোকে আমাকে ‘দানাদিল’ বা জ্ঞানী বলে।
ডাকাত : তোর নাম দানাদিল! আজব নাম তো!! লোকে তোকে জ্ঞানী বলে অথচ তুই এত মুর্খ যে পাখির সাথেও কথা বলিস! তাদের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করিস। জেনে রাখিস, আরে তোর মত মুর্খ লোকের খুন ঝরালে আমাদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না।
এ কথা বলে ডাকাতরা নিষ্পাপ দরবেশকে হত্যা করলো। তারপর তার মালপত্র ভাগ করে নিলো। এদিকে ওই পথ দিয়ে একদল ব্যবসায়ী শহরের দিকে যাচ্ছিলো। তারা বৃদ্ধের লাশ দেখে চিনে ফেললো। এরপর তারা জানাজা নামায পড়ে দাফনের ব্যবস্থা করলো। দাফন শেষে শহরে ফিরে গিয়ে তারা দরবেশের হত্যার কথা প্রচার করলো। সব শুনে লোকজন দরবেশের জন্য দোয়া করলো এবং যেভাবেই হোক খুনীদের খুঁজে বের করার শপথ নিলো।
এরপর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ইরানে নববর্ষ শুরু হলো। নববর্ষের তের তারিখে শহরের লোকজন সাধারণত: ঘরবাড়ি ছেড়ে বনবাদাড় ও পার্কে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন বনভোজন ও ঘোরাফেরা করে তারা সন্ধ্যায় ফিরে যায় যার যার বাড়িতে। সেবারও তের তারিখে দরবেশের মহল্লার লোকজন পাশের একটি পার্কে গেল। ঘটনাক্রমে দরবেশের হত্যাকারী ডাকাতরাও সেদিন ওই পার্কে এলো সময় কাটাতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো সুযোগ বুঝে চুরি-ডাকাতি করা। ডাকাতরা সাধারণ পোশাক পরে একটি ঝোপের পাশে একটা দেবদারু গাছের নিচে বসে গল্প করছিলো। আর অপর পাশে দরবেশের মহল্লার কয়েকটি ছেলে খেলাধুলা করছিলো। এক সময় এক ঝাঁক পাখি এসে বসলো দেবদারু গাছটিতে। দেখতে দেখতে আরো অসংখ্য পাখি এসে বসলো গাছটিতে। কিছুনের মধ্যেই পাখিদের বিষ্ঠা এসে পড়তে লাগলো ডাকাতদের মাথার উপর। ডাকাতরা একজন আরেকজনকে ঠাট্টা মস্করা করে বলতে লাগলো:
ডাকাত ১ : দ্যাখ, দ্যাখ! পাখিদের আদব কায়দা দ্যাখ! ওরা কিনা আমাদের গায়ে পায়খানা করে দিচ্ছে!!!
ডাকাত ২ : আমার মনে হয় কি জানিস? হয়তো এরাই দানাদিল দরবেশের সেই বন্ধুর দল। আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে ও হত্যার প্রতিশোধ নিতে এসেছে।
ডাকাত ১ : আরে সেই বুড়োর কথা বলছিস? ও ব্যাটা আস্ত একটা গাধা। অথচ লোকেরা তাকে নাকি বলতো জ্ঞানী দরবেশ।
দস্যুরা যখন এসব কথাবার্তা বলছিল তখন ঝোঁপের ওপারে ছেলেগুলো মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনছিলো। তারা যখন বুঝতে পারলো যে,এ লোকগুলোই দানাদিল দরবেশকে খুন করেছে; তখন তারা চুপি চুপি পুলিশের কাছে গিয়ে সবকিছু বলে দিলো। মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশ এসে ডাকাতদের পাকড়াও করে ফেললো। তাদেরকে থানায় নেয়া হলে মারের ভয়ে সবকিছু স্বীকার করলো। এরপর যা হবার তাই হলো। অর্থাৎ বিচারে কারো হলো ফাঁসি আর কারো হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এভাবেই দানাদিল দরবেশের খুনের সাক্ষ্য পাওয়া গেলো পাখিদের কাছ থেকে।
বন্ধুরা, দেখলে তো দরবেশের দোয়া কিভাবে কাজে লাগলো? কথায় বলে না ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’ ডাকাতদের বেলায়ও তাই হলো। ডাকাতরা মনে করেছিল বৃদ্ধকে হত্যা করলে তারা পার পেয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল অন্য রকম। তাই তো সামান্য পাখিই ওই হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে রইল। #
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।