খুনের আগে খুন — ষষ্ঠ অংশ

এরমধ্যে অশোক আবার কলকাতায় এলো। আমাকে ফোন করে বলল, ও ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়াতে একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। এবার মাত্র অল্প কয়েকদিন থাকবে। এর পরে কবে আসবে ঠিক নেই, তাই একদিন জমিয়ে আ®া দিতে হবে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনিতামাসির ফোন পেলাম। কাল রবিবার দুপুরে আমাদের সবার নেমন্তন্ন। একেনবৌদির মা অসুস্থ, তাই বাপের বাড়িতে আছেন কয়েকদিন। এই অবস্থায় অনিতামাসির আমন্ত্রণ একেবারে গিফ্ট ফ্রম গড।

অশোক বলেছিল তাড়াতাড়ি যেতে। তাই এগারোটা নাগাদ আমরা অনিতামাসির বাড়িতে পৌঁছলাম। দরজা খুলল একটি অপরিচিত যুবক। অশোক তখনও আসে নি। গীতা একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে আলমারিগুলো ঝাড়ছে, আর মাসি সোফায় বসে কি একটা বুনছেন।
বললেন, “আয় আয় বোস, অশোকটা এখনও এলো না কেন কে জানে।“ তারপর গীতাকে বললেন, “গীতা, আর ঝাড়পোছ করতে হবে না, তুই ওদের একটু চা খাওয়া বরং, বিশ্বনাথের জন্যেও করিস।“
“আমি নিচে যাচ্ছি মা ,” ছেলেটি বলল।
“যাও, একটু বাদে এসে চা খেয়ে যেও।“
ছেলেটি চলে যেতেই অনিতামাসি বললেন, “ও হল বিশ্বনাথ, আমার ড্রাইভার, বড় ভালো ছেলে।“ তারপর একটু অনুচ্চস্বরেই বললেন, “ইচ্ছে ছিল, গীতার সঙ্গে বিয়ে দিই।“
সেই সময়ে ডোরবেল বেজে ওঠাতে চুপ করে গেলেন।
আমি উঠে দরজা খুলে দেখি, অশোক আর সেই কাঁচা-পাকা চুল-অলা ভদ্রলোক, অজিত রায়।
আমি বললাম, “বেশ তো তুমি, আমাদের তাড়াতাড়ি আসতে বলে, নিজেই এলে দেরি করে।“
আর বোল না, হঠাৎ রাস্তায় মিস্টার রায়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা – টাইমটা গুবলেট হয়ে গেল ।“
“দোষটা আমারই ,” অজিত রায় স্বীকার করলেন। “উনি আমাকে বলেন নি যে, এখানে আসছেন। যখন বললেন, তখন ভাবলাম দিদিকে খবরটা দিয়ে যাই।“
“কি খবর? “
“আপনার ক্লজেট সমস্যার সমাধানের খবর।“
অনিতা-মাসি তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে, অজিত রায় বললেন, “বাঃ, এরমধ্যেই ভুলে গেছেন ! সেদিন বললেন না যে, আপনার ক্লজেটে জায়গা হচ্ছে না, ঠেসে ঠেসে কাপড় রাখতে হচ্ছে? “
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে।“
“সেটার সল্যুশন খুঁজে বার করলাম। একটা সল্যুশন হচ্ছে যেসব জামাকাপড় ব্যবহার করছেন না, সেগুলো প্লাস্টিকের স্পেস ব্যাগ-এ ঢুকিয়ে সেটাকে ভ্যাকুয়াম-সিল করা। ভ্যাকুয়ামের জন্য সব কিছু চাপে পড়ে ছোট হয়ে যাবে।“
স্পেস-ব্যাগের ব্যাপারটা আমি জানতাম। ম্যানহাটানে জায়গার অভাব। আমার প্রফেসর ওঁর কম্বলটম্বলগুলো কতগুলো স্পেশাল প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢুকিয়ে সেটা সিল-করে ভেতরের বাতাস ভ্যকুয়াম ক্লিনার দিয়ে টেনে বার করে ফেলতেন। ভাঁজকরা একফুট মোটা কম্বলগুলোও চেপ্টে শক্ত হয়ে চার ইঞ্চির মতো হয়ে যেত! কিন্তু এখানেও সেই সব ব্যাগ পাওয়া যায় জেনে আমি আশ্চর্য হলাম।
“আমার কাছে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আছে। বলেনতো কয়েকটা ব্যাগ কিনে আনতে পারি। তবে আমেরিকায় ওগুলো প্রায় অর্ধেক দামে পাবেন।“ বলে অজিত রায় অশোকের দিকে তাকালেন।
অশোক তাকানোর অর্থটা বুঝল। বলল, “আমি নিয়ে আসতে পারি, কিন্তু আমি এবার কবে আসবো ঠিক নেই।“
“আচ্ছা, আচ্ছা, ওসব কথা পরে হবে। হ্যাঁরে, গীতা আরও দু-কাপ চা করিস ,” অনিতামাসি চেঁচিয়ে বললেন, “অশোক আর অজিত এসেছে।“
“করছি মা।“ উত্তর এলো রান্না ঘর থেকে।
“না, না, শুধু এক কাপ,”অজিত রায় চেঁচিয়ে গীতার উদ্দেশ্যে বললেন। তারপর মাসিমাকে বললেন, “আমাকে পালাতে হবে। খবরটা দেবার জন্য শুধু এসেছিলাম। আমি নিজে একটা স্পেস-ব্যাগ কিনে দেখি কিরকম কাজ করে, তারপর আপনাকে বোলব।“ বলে আমাদের নমস্কার জানিয়ে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন।
“খুব নলেজেবল লোক স্যার ,” একেনবাবু প্রায় নিজের মনেই বললেন।
অনিতামাসি বললেন, “কার কথা বলছ, অজিতের? “
হ্যাঁ, ম্যাডাম — মানে মাসিমা।“
“দিনরাত ইণ্টারনেট-এ বসে থাকেন, উনি খবর রাখবেন নাতো রাখবে কে? “ অশোকের কথা বলার সুরে মনে হল, ও বোধহয় অজিত রায়ের প্রতি খুব একটা সন্তুষ্ট নয়।
“তা কি করে হয় স্যার, এতগুলো বিজনেস চালাচ্ছেন ! “
“মানে? “
“ঐ বললেন না স্যার, দিনরাত ইণ্টারনেট-এ বসে থাকেন – তাই যদি হয়, তাহলে বিজনেস চালানোর সময় পান কখন? “
“বিজনেস চালানো আর চলা তো এক ব্যাপার নয়।“
একেনবাবু মাঝেমাঝেই উল্টোপাল্টা কথা বলে কথা বাড়ান। অনিতামাসি অজিত রায়কে স্নেহ করেন, ওর সামনে এ নিয়ে আলোচনা করাটা মোটেই প্রীতিকর নয়। আমি কথা ঘোরানোর জন্য অনিতামাসিকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার ব্রহ্মচারী-আর্টিস্টের খবর কি? “
“জানি না রে; এইতো তিন দিন আগে এসে হাসিমুখে কত গল্প করে গেল। গতকাল এলো, দেখলাম মুখটা একেবারে কালো। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে। উত্তর দিতে চাইল না। শুধু বলল, সময় যখন আসবে, তখন বলবে। বেশিক্ষণ ছিল না চলে গেল। আজকে আসতে বলেছিলাম। বলল, কি সব কাজ আছে।“
“সন্ন্যাসী মানুষেরও মন খারাপ হয়? “ প্রমথ একটু ঠাট্টার সুরেই বলল।
তারপর একথা সেকথা হল কিছুক্ষণ। একেনবাবু অশোককে বললেন, “আপনি কি স্যার, একেবারে গুডবাই? “
“আরে না। এত সহজে কি ব্যবসা গোটানো যায়। বছরে বার দুয়েক আসতেই হবে। তারপর দেখা যাক কি হয়। চাকরিটা নিলাম ঠিকই, কিন্তু চাকরির বাজারও যা, আজ আছে কাল নেই।“
অনিতামাসি দেখলাম একটু বিষণ্ণØ। একবার বলেও ফেললেন, “এক ছেলেতো চলল, এখন তোমরাও আবার না পালাও।“

গল্পের সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!