বিকেলে বিমলবাবু যখন এলেন, আমরাও একেনবাবুর বাড়িতে। শনি-রবিবার ছাড়া আমরা আসি না। আজকে অবশ্যই স্পেশাল ব্যাপার। বিমলবাবু দেখলাম কথা বলতে ভালোবাসেন। যা বললেন, তাতে দিলীপই যে খুনি, সে বিষয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। গীতা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে একা ছিল। ওর মা আর ভাই সেদিন গীতার জন্য কালীঘাটে গিয়েছিল পুজো দিতে। সেই সময়ে কাছাকাছি কেউ নেই দেখে দিলীপ ঘরে ঢোকে। গীতাদের পাশের খুপরিতে এমনিতে দুপুরে কেউ থাকে না। কিন্তু সেদিন ও বাড়ির ছোট ছেলেটা স্কুল কামাই করে বাড়িতে এক বন্ধìর সঙ্গে বসে গুলতি বানাচ্ছিল। সেই দিলীপকে ঘরে ঢুকতে দেখে। গীতার ঘর থেকে একটু গোঙানির আওয়াজও দুইবন্ধু শোনে। আর একটু বাদে দিলীপকে দ্রুত গতিতে চলে যেতে দেখে ওদের সন্দেহ হয়। গীতার ঘরের দরজা ফাঁক করে উঁকি দেয়; দেখে গীতা মরে পড়ে আছে। ওরাই চ্যাঁচামেচি করে লোকদের ডাকে। তাদেরই একজন এসে পুলিশে খবর দেয়।
“যে দুটো ছেলের কথা বলছ, তাদের বয়স কত? “
“বছর আট-দশ। না সেখানে কোনও ফাউল প্লে নেই। আমি ওদেরও জেরা করেছি। ফ্র্যাঙ্কলি মেয়েটার উপর কারোর বিশেষ রাগ না থাকলে কেউ ঐ অবস্থায় এ-কাজ করতে পারতো না।“
“তারমানে? “ একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।
“সারা ঘরে বমির গন্ধ। মেয়েটা অসম্ভব অসুস্থ ছিল। তা সত্যেও দিলীপকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বোঝাই যায় যে, দিলীপ ওর চুল ধরে টেনে বিছানায় ফেলে বালিশ চাপা দিয়ে অপকর্মটি করেছে।“
“এগুলো সব দিলীপ স্বীকার করেছে? “
“সেভাবে নয়, তবে বলেছে গীতাকে ও ভালোবাসতো, কিন্তু গীতা ওকে পাত্তা দিত নি। তখন বন্ধুরাই নাকি ওকে বলেছিল, জোর করে কর, তাহলেই দেখবি ঠিক পোষ মেনে যাবে।“
“চমৎকার অ্যাডভাইস ,” প্রমথ ডিসগাস্টিং মুখ করে বলল, “সস্তা সিনেমা দেখে আর বাজে বই পড়ে এইরকমই মেণ্টালিটিই হচ্ছে আজকাল।“
“তারপর ? “ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“দিলীপ প্রথমে ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু বন্ধুদের টিটকিরি সহ্য না করতে পেরে গীতার ঘরে ঢুকেছিল। তারপর গীতার মুখের চেহারা দেখে দিলীপ নিজেই ভয় পেয়ে যায়। গীতা চেঁচাবার চেষ্টা করাতে ওর মুখের উপর বালিশ চেপে ধরে। তাতেও কাজ না হওয়ায় – গলা টিপে ধরে। তবে গীতাকে ও মারতে চায় নি। গীতা যাতে চ্যাঁচাতে না পারে – তারই চেষ্টা করেছিল।“
“পোস্ট মর্টেমে মৃত্যুর কারণটা কি বেরিয়েছে – অ্যাসফিকসিয়েশন? “ একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ, শ্বাসরোধে মৃত্যু। তবে ফুল-রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায় নি। অবশ্য তার দরকারও নেই। গীতার বডিতে যে স্পার্ম পাওয়া গেছে – সেটা দিলীপেরই। সুতরাং এটা একেবারে ওপন এণ্ড শাট কেস।“
“তাই তো মনে হচ্ছে বিমল। ভালোকথা, গীতার মা আর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে? “
“হ্যাঁ, বিকেল বেলাতেই ফিরে এসে ভেঙ্গে পড়েছিল দুজনে। প্রসাদী ফুল আর মিষ্টি নিয়ে এসেছিল মেয়ের মুখে দেবে বলে। কাঁদতে কাঁদতে বুড়ি বলছিল, ‘মেয়েটা একটু মিষ্টি খেতে চেয়েছিল, বললাম, এখন না, একেবারে প্রসাদ নিয়ে আসছি। শেষ ইচ্ছেটাও পূর্ণ করতে পারলাম না বাবু।‘ কী বলে বুড়িকে সান্ত্বনা দিই বলুন!“
“আর কারোর সঙ্গে তোমার কোনও কথা হয়েছে? “
“তদন্তের জন্য নয়। তবে বস্তিতে ঢুকলে হাজার লোক এসে হাজার কথা বলে। দুয়েকজন দেখলাম গীতাকে অপছন্দই করতো। খুন হয়েছে তাতে অবশ্য সবাই দুঃখিত। ওর এক দূর সম্পর্কের মাসি তো বলেই ফেললেন, ‘বড় দেমাকি ছিল, মেয়েটা। দেখতে ভালো, তাই অনেকেই ওকে বৌ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার কাউকেই পছন্দ হয় না। এইতো দুহপ্তা আগে একটা সম্বন্ধ এনেছিলাম খুড়তুতো দেওরের ছেলের সঙ্গে। স্কুল পাশ ছেলে – ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। পঞ্চাননতলায় থাকে, কিন্তু ঘরটা পাকা। গীতাকে দেখে পছন্দ হয়েছে – পণ টন চায় না। গীতার মা-তো এক কথায় রাজি। মেয়েটা আমার মুখের উপর বলে, ও নাকি বস্তির কাউকে বিয়ে করবে না।‘ আমি ওকে বললাম, ‘কোন রাজপুত্তুর তোকে বিয়ে করবে শুনি? ‘ আমায় উল্টে বলে কিনা, ‘কদিন বাদেই দেখবে, কোন প্রাসাদে আমি যাই।‘ অত দেমাক কি ভালো বাবু? মধ্যে থেকে কতগুলো ব্যাটাছেলেকে চটিয়ে দিয়ে খুন হলি‘।“
এরপর এ নিয়ে আর বিশেষ কথা হল না। অন্যান্য গল্প হল কিছুক্ষণ। একেনবৌদির রান্না চেটেপুটে খেয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন বেশ রাতই হয়েছে।
পরদিন দুপুরে অফিসে প্রমথর একটা উত্তেজিত ফোন। “জানিস, ১৯৬৫ মিড-নাইট রেড বার্বিডল কত দামে বিক্রি হয়েছে কিছুদিন আগে? “
“না।“
“সতেরো হাজার ডলারে। “
“মাই গড ! কিন্তু অনিতামাসির মেয়ের ডল অত পুরনো হবে কি করে? “
“ও-তো পুরনো ডলও কিনেছিল গ্যারাজ সেল থেকে। আর মাসি বলল না, লাল ড্রেস পরা বার্বি-টা চুরি হয়েছে! তার থেকেও বড় খবর আছে।“
“কি? “
“বিস্ক-এর পুতুল দুশো হাজার ডলারেও বিক্রি হয়।“
“কি বলছিস যা তা! “
“যা তা কিছুই বলছি না, ইণ্টারনেট দেখ। সস্তা ডলও আছে পাঁচ দশ ডলারের, আবার অনেক দামেরও আছে।“
“একেনবাবুকে বলেছিস? “
“হ্যাঁ।“
“কি বললেন? “
“বললেন, ‘আমারও কেমন জানি মনে হচ্ছিল স্যার‘। অর্থাৎ আগেই খোঁজখবর নিয়েছেন, এখন বোকা বোকা ভাব দেখাচ্ছেন – যেটা ওঁর টিপিক্যাল স্টাইল – মোস্ট ইরিটেটিং।“
“তারমানে তুই বলছিস, যে-চুরি করেছে, সে এ ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ।“
“নিঃসন্দেহে।“
“তাহলে তো অশোক আর অজিত রায়ও তারমধ্যে পড়ে,” আমি বললাম।
“আর ঐ ব্রহ্মচারীটাকেও বাদ দিস না। হঠাৎ সন্ন্যাস ছেড়ে তিনি সংসার ধর্মে ফিরছেন – মহারাজের আশ্রমের ফ্রি-ফুড চলে গেলে খাওয়া থাকার টাকাটা আসবে কোত্থেকে? “
কথাটা প্রমথ মন্দ বলে নি। অবশ্য এ-তিনজন ছাড়াও অনেকেই অনিতামাসির কাছে আসে। তাদেরও কেউ হতে পারে। কাজের লোক এ ভাবে চুরি করবে না, কারণ এর মূল্য তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আর চুরি করলেও সেগুলো নিয়ে বেরোতে পারবে না, সিকিউরিটি গার্ড আটকাবে। যদিও ঘুষ দিয়ে সবকিছুই করা যায়।
“বিকেলে একেনবাবুর বাড়ি যাচ্ছি, তুইও আসিস।“
“একেনবাবুকে জানিয়েছিস ? “
“ওর বাড়িতে যাবো, আবার জানাবার কি আছে ? “
“তাও।“
“ হ্যাঁ, বলেছি।“
গল্পের দশম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।