খুনের আগে খুন– চতুর্থ অংশ

কাজের যে মেয়েটি দরজা খুলল, ভারি মিষ্টি চেহারা তার। অশোক বলল, “তুমি এখনো এখানে?“
মেয়েটি একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, “এক্ষুণি যাচ্ছি আপনার বাড়ি, আজ একটু দেরি হয়ে গেল।“
“মাসি বাড়িতে আছেন ? “
অনিতামাসি খাবার ঘরে বসে একজন কাঁচা-পাকা চুলওয়ালা ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করছিলেন। উঁকি দিয়ে অশোককে দরজায় দেখে উত্ফুল্ল হয়ে বললেন, “এসো, এসো, ভেতরে এসো। আজকে গীতাকে একটু আটকে রেখেছি। তোমার অসুবিধা হল বোধহয়।“
“এতটুকু নয় ,” অশোক বলল। “দেখুন কাদের নিয়ে এসেছি, এঁদের সঙ্গে বসে ক্লাবে খেলাম।“
মাসিমার এবার প্রমথর দিকে নজর পড়ল। “আরে তুই, কতদিন ধরে তোর খোঁজ করছি ! কতজনকে জিজ্ঞেস করেছি – কোথায় আছিস – কেউই জানে না।“
“সেইজন্যেইতো ধরে নিয়ে এলাম ,” অশোক বলল।
“ভালো করেছো। তোমাকেওতো দেখেছি আমি নিউ ইয়র্কে।“
“ হ্যাঁ,” আমি বললাম, “ আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম একদিন। আমি বাপি।“
“ হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে আমার। কিন্তু আপনাকে বোধহয় দেখি নি।“
“আমাকে স্যার, মানে ম্যাডাম, আপনি বলছেন কেন ? “
“ইনি হচ্ছেন একেনবাবু, কিছু চুরিটুরি গেলে এঁকে খবর দিও, দুর্দান্ত গোয়েন্দা।“ প্রমথটার সত্যি কোনও সেন্স নেই। এগুলো কি না বললেই নয়।
অনিতামাসি অবশ্য মজা পেলেন কথাটায়। হাসিমুখে বললেন, “ওমা, সত্যি, তুমি গোয়েন্দা?“
একেনবাবু চুপ করে রয়েছেন দেখে, আমিই বললাম, “উনি সত্যিই একজন নামকরা গোয়েন্দা।“
“ওঁর কীর্তিকাহিনী এক কথায় বলা যাবে না ,” প্রমথ ফোড়ন কাটল।
বেচারা একেনবাবু, একবার শুধু বাধা দেবার চেষ্টা করলেন, “কী যে বলেন স্যার আপনারা।“
“তাহলে বাপু তোমরা একদিন শনিবার বা রবিবার একদিন এসো। সারাদিন থাকবে, খাবে-দাবে – আর আমাকে গল্পগুলো শোনাবে। আমার আবার মিস্ট্রি খুব ভাল লাগে।“
ç“প্রথম পার্টটাতে অসুবিধা নেই ,” প্রমথ বলে উঠল, “দ্বিতীয় পার্টটাতেই মুশকিল। এমনিতে বক বক করলেও, একেনবাবু নিজের কীর্তির কথা বলতে চান না । বাপি সানন্দে বলবে, কিন্তু ঘটনাগুলো ভীষণ গুলিয়ে ফেলবে।“
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “তুই চুপ করবি।“
“বেশ, বেশ, না হয় অন্য গল্পই তোরা করিস ,” কথাটা বলে অনিতামাসির খেয়াল হল যে, কাঁচা-পাকা চুলের সঙ্গে আমাদের আলাপ করানো হয় নি। বললেন, “এই দেখো, একদম ভুলে গেছি, এ হল অজিত রায়। খুব বড় বিজনেসম্যান – কলকাতায় দশ বারোটা ওষুধের দোকানই আছে।“
“আটটা ,” ভদ্রলোক মাসিমাকে সংশোধন করলেন।
“ঐ হল, অনেকগুলো। কিন্তু অজিতের বড় পরিচয় হল, ও একটা ওয়াকিং এনসাইক্লোপিডিয়া। হেন খবর নেই ও রাখে না। যে কোনও ব্যাপারে খোঁজখবরের দরকার হলেই আমি অজিতকে ধরি। তোমরা বিশ্বাস করবে না ,” বলে অজিত রায় কত খবরাখবর রাখেন তার ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন। অনিতামাসির এই কমপ্লিমেন্টের তোড়ে অজিতবাবু লজ্জিত হচ্ছিলেন। শেষে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি আজ চলি, দিদি। একবার দোকানগুলো-তে মুখ দেখিয়ে আসতে হবে।“ তারপর আমাদের সবাইকে নমস্কার করে বললেন, “খুব ভালো লাগলো আপনাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। আবার দেখা হবে নিশ্চয়।“
“কাল পারলে এসো ,” অনিতামাসি বললেন।
“আসবো ,” বলে অজিতবাবু বিদায় নিলেন।

বেশ কয়েক ঘণ্টা আমরা কাটালাম অনিতামাসির কাছে। এক মুহূর্তে অনিতামাসি আমাদের আপন করে নিলেন। একেনবাবু যে একেনবাবু – তিনিও তিন চারবার ‘স্যার‘ আর ‘ম্যাডাম‘ বলার পর অনিতামাসির সস্নেহ ধমকে ‘মাসিমা‘ বলা শুরু করলেন। এরমধ্যে অশোকের বাড়ির কাজ সেরে সেই কাজের মেয়েটি গীতা ফিরে এলো। আমাদের চা আর চপ করে খাওয়াল।
“আমার বাড়িতে মিষ্টি রাখি না, আমার ডায়েবিটিস, কিন্তু মিষ্টি দেখলে লোভ সামলাতে পারি না, তাই ঐ পাট বাড়ি থেকে চুকিয়েছি।“
“বাপির মিষ্টি না খাওয়াই ভালো ,” প্রমথ মন্তব্য করল, “যা মুটোচ্ছে।“
কথাটা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক, পুরো সত্যিও নয়। কিন্তু এ নিয়ে অনিতামাসির সামনে তর্ক করাটা ঠিক হবে না বলে চুপ করে রইলাম। অনিতামাসিই আমাকে ডিফেণ্ড করলেন, “কিযে বলিস, একটু স্বাস্থ্য থাকা ভালো।“
“স্বাস্থ্য থাকা আর মোটা হওয়া – দুটো এক নয়।“
আমি প্রায় বলতে যাচ্ছিলাম, ‘আমি মোটা তাতে তোর কি? ‘ কিন্তু সেটা নিতান্তই ছেলেমানুষী হবে। অনিতামাসিই কথা ঘোরালেন, বললেন, “অশোকতো দিন দশেক থেকেই পালায়। তোমরাতো এখানে থাকো, মাঝে মাঝে বুড়ি মাসিমাকে দেখে যেও।“
অশোক প্রতিবাদ করল, “মাসি, আমি অন্তত: পনেরো দিন করে থাকি, আর এবার দুসপ্তাহ বাদেই আবার আসবো।“
কথাটা শুনে অনিতামাসি খুসি হলেন, “বাঃ, এটা তো সুখবর।“

এর পর অবশ্য অনিতামাসির বাড়ি আমাদের বেশ কিছুদিন যাওয়া হয় নি। অশোক আবার কলকাতায় এলে নিশ্চয় যোগাযোগ করবে, তখন যাওয়া যাবে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই অনিতামাসি প্রমথকে ফোন করে আমাদের সবাইকে নিমন্তন্ন করলেন। এমনকি প্রমথর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে একেনবৌদিকেও। একেনবৌদির অবশ্য সেদিন ওঁর মাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা। উনি আসতে পারলেন না। আমরা তিনজন শুধু হাজির হলাম অনিতামাসির এপার্টমেন্টে।

গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!