অনিতামাসির বাড়ি গিয়ে দেখি ওঁর চেহারা একেবারে বিধ্বস্ত। শুনলাম গীতা মারা গেছে! আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। অপরাধ বোধেও জর্জরিত হলাম – মাসিমা আমাকে একজন ভালো ডাক্তার খুঁজে দিতে বলেছিলেন।
না, অসুখে মৃত্যু নয়, মৃত্যু ঘটেছে আরও ভয়ঙ্কর ভাবে। অসুস্থ সে ছিলই। কিন্তু সেই অবস্থাতেই কেউ গীতাকে ধর্ষণ করে গলা টিপে খুন করেছে। মাই গড!
সান্ত্বনা দেবার কোনও ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একেনবাবুকে ডাকার কারণ মাসিমা চান যে খুনি যেন ধরা পড়ে। আমাদের দেশের পুলিশের উপর অনিতামাসির আস্থা নেই। বললেন, “গীতা বড় ঘরের মেয়ে হলে, পুলিশ হয়তো একটু নড়ে চড়ে বসতো। আমার কাছে ও মেয়ের মতো, কিন্তু পুলিশের কাছে ও বস্তির একটা মেয়ে। জানোইতো মানুষদের এখানে কি ভাবে আমরা দেখি।“
শোকে দুঃখে মাসিমা কথাগুলো বললেন বটে, কিন্তু পুলিশ যে নিষ্ক্রিয় সেটা মনে হল না। খানিক বাদেই একজন পুলিশের লোক বাড়িতে এলো। ভাগ্যক্রমে, তিনি আবার একেনবাবুকে চেনেন! বললেন, “স্যার, আপনি এখানে? “
একেনবাবু বিশ্বশুদ্বুì লোককে ‘স্যার‘ বলেন, তাই একেনবাবুকে একজন ‘স্যার‘ বলছেন দেখে, এই অবস্থাতেও একটু হাসি পেলো।
“আরে বিমল যে, তুমি এই কেসটা দেখছ? “
“হ্যাঁ, স্যার।“
“মেয়েটি আমাদের খুব পরিচিত। ম্যাডাম চান যে, আমি এ ব্যাপারে একটু সাহায্য করি।“
“হ্যাঁ, উনি যে খুব আপসেট আমি বুঝেছি। সেইজন্যেই ভাবলাম, ম্যাডামকে বলে যাই, যে খুনিকে ধরেছি, এবং সে খুন করার কথা স্বীকারও করেছে।“
“এরমধ্যেই ? লোকটা কে ? “ মাসিমা প্রশ্ন করলেন।
“ঐ বস্তিরই একটা লোক, ভ্যানরিক্সা চালায়। অনেকদিন ধরেই আপনার মেড-সার্ভেণ্টকে উত্যক্ত করছিল।“
অনিতামাসি চুপ করে রইলেন, দেখলাম দুচোখ দিয়ে ওঁর জল গড়িয়ে পরছে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন।
“গুড জব, বিমল।“ একেনবাবু বললেন।
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। লাকিলি একটা আই-উইটনেস পেয়ে গেলাম। নইলে বেশ ঝামেলাই হত। আচ্ছা চলি স্যার, আজ আবার আমার স্টেশনে ডিউটি।“ বলে বিমলবাবু অদৃশ্য হলেন।
বিমলবাবু চলে যাবার পর আমরা কিছুক্ষণ অনিতামাসির কাছে রইলাম। একেনবাবুর প্রয়োজন অনিতামাসির ফুরিয়েছে, কিন্তু মনের ক্ষতটাতো যাবে কি করে! নিজের মনেই অনেক কথা বলে চললেন, “খবরটা গতকাল বিকেলে পাই। পেয়েই অজিতকে ফোন করি, ও সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। এই কষ্টের মধ্যে পুলিশ এসে হাজার প্রশ্ন শুরু করে, তখন অজিত না থাকলে নিজেকে সামলাতেই পারতাম না। সন্ধ্যায় সত্য কোত্থেকে খবর পেয়ে এলো। সত্য আসার পর অজিত গেল। বেচারা সত্য একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। বলল, ও মঠ ছেড়ে দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন ? তখন ও ভীষণ কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে যা বলল, তা শুনে আমি হতবাক। তোমাদের বোধহয় বলি নি, আমি গীতার সঙ্গে বিশ্বনাথের সম্বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলাম। গীতা প্রথমে উত্তর দিত না। আমি জানি, বিশ্বনাথ গীতাকে বিয়ে করতে খুবই আগ্রহী ছিল। শেষে বিশ্বনাথ অধৈর্য হতে শুরু করল। তখন আমি গীতাকে বেশ চাপই দিলাম, একটা উত্তর দেওয়ার জন্যে। ও তখন সোজাসুজি ‘না‘ বলল – বিশ্বনাথকে দাদার মত দেখে, স্বামী বলে ভাবতে পারবে না। এদিকে সত্য বলল দিন দশেক আগে নাকি ও গীতাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল! গীতা সত্যকে খুব পছন্দ করতো আমি বুঝতাম । তবে সত্যের যে গীতাকে এরকম ভালো লাগে কোনোদিন বুঝি নি । কিন্তু, এটাতো অসম্ভব ব্যাপার। গীতা যে পরিবেশে বড় হয়েছে আর সত্য যে জায়গা থেকে এসেছে, তারমধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। সে যাইহোক, সত্য বলল, গীতা নাকি সত্যের এই প্রস্তাবে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর বলেছিল, “এ হয় না। আপনি আমার জন্য সংসারে ফিরে এলে আমার পাপ হবে।“ সত্য অনেক বুঝিয়েও ওকে রাজি করাতে পারে নি। আমি সেদিন তোমাদের বলেছিলাম না যে, সত্যের মন খারাপ। সেটা ঐ ঘটনার ঠিক পরপর।“
আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, প্রথম যেদিন সত্যানন্দকে দেখি, গীতা দরজা খুলে ওঁকে দেখে একটু কেমন লজ্জা পেয়েছিল। তাহলে কি ও আঁচ করেছিল যে, সত্যানন্দ ওকে কামনা করছেন?
আমরা এক ঘণ্টার মতো থেকে “আবার আসবো“ বলে বিদায় নিলাম। গাড়িতে দেখলাম একেনবাবুর মুখ একটু গম্ভীর।
“কি ব্যাপার বলুন তো? “
একেনবাবু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আমাকে স্যার একটু ইস্ট যাদবপুর থানায় নামিয়ে দেবেন ? “
“সেটা কোথায়? “
“এইতো সামনে, মুকুন্দপুরে।“
“কি করবেন? “
বিমলের সঙ্গে একটু দেখা করতাম।
কেন হঠাৎ বিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন, তার উত্তর ওঁর কাছ থেকে আদায় করতে পারবো না জানি, তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কতক্ষণ লাগবে আপনার? “
“বেশিক্ষণ নয় স্যার। ও-ও নিশ্চয় ব্যস্ত আছে।“
একেনবাবুকে নামিয়ে দিয়ে আমরা গাড়িতেই বসে রইলাম। মিনিট পনেরোর মধ্যেই একেনবাবু ফিরে এলেন।
“আপনার কাজ হল? “
“বিমল আসবে আজ সন্ধ্যায়। তখন ভালো করে সবকিছু জানতে পারবো।“
গাড়ি চালাতে চালাতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার বলুন তো মশাই? হঠাৎ ইস্ট যাদবপুর থানায় গেলেন, মনে হচ্ছে কিছু একটা আপনাকে ভাবাচ্ছে।“
“সেটা স্যার, অস্বীকার করব না।“
“তা আমাদের একটু খোলসা করে বলুন না, ভাবটা তো দেখান আমাদের না হলে আপনার চলে না।“ এতক্ষণ গাড়িতে বসে থেকে প্রমথর মেজাজটা একটু চড়েছিল। তাই তিক্ত ভাবেই বলল কথাটা।
“আসলে স্যার আমি একটু কনফিউসড।“
“কনফিউজড? “
“ হ্যাঁ স্যার।“
“কেন? “
“আপনি খেয়াল করেছিলেন কিনা জানি না, মাসিমার আলমারি থেকে দুটো পুতুল মিসিং।“
“পুতুল মানে বার্বিডল? “
“ হ্যাঁ স্যার, চীনেমাটির একটা পুতুল আর একটা বার্বিডল।“
“কি বলছেন যা তা! “ প্রমথ বলল।
“ঠিকই বলছি স্যার। তিনটে চীন মাটির পুতুল ছিল, এখন সেখানে দুটো, আর বার্বি ছিল দশটা, তারমধ্যে তিনটে বাক্সের মধ্যে। সেখানে রয়েছে নটা। বার্বিডলের একটা বাক্স অদৃশ্য হয়েছে।“
“আপনি প্রথমদিন বসে বসে গুনেছেন? “
“আমার স্বভাব স্যার, কি করবো।“
“হাউ অ্যাবাউট ক্রিস্টালগুলো ? “ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“সেগুলো ঠিকই আছে স্যার। চোদ্দটা ছিল, চোদ্দটাই আছে।“
“অনিতামাসি হয়তো কাউকে পুতুল দুটো দিয়েছেন,” আমি বললাম।
“পসিবল স্যার।“
“মাসিকে জিজ্ঞেস করলেই পারতেন, শুধু শুধু কনফিউজড না হয়ে ,” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল।
“চুরির কথা শুনে পুলিশ কি বলল ? “ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“চুরির কথাতো ওদের বলি নি স্যার।“
“কেন বলেন নি জানতে পারি, তাড়াহুড়ো করে তো গেলেন ওদের কাছে ? “ প্রমথ তির্যক ভাবে প্রশ্নটা করল।
“সত্যিই চুরি হয়েছে কিনা, সেটা তো আমরা জানি না স্যার।“
“তাহলে এতো কনফিউসড হলেন কেন? “
“চুরি হলে স্যার, একটু কনফিউজড হবারই ব্যাপার।“
“আপনি একটা যাচ্ছেতাই ,” বলে প্রমথ দেখলাম মোবাইলে কাকে ফোন করছে।
“মাসি, আমি প্রমথ। আচ্ছা, তুমি কি কোনও বার্বিডল বা চীনেমাটির পুতুল কাউকে দিয়েছো ? … দাও নি? …..একেনবাবু বলছেন কয়েকটা পুতুল মিসিং। দ্যাখো তো। … ঠিকই বলেছেন একেনবাবু? …..। বাইরের কেউ এসছিল নাকি? মিস্তিরি আর ইলেকট্রিকের লোক। ঠিক আছে, একেনবাবুকে বলছি। …. হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা আসবো। তুমি ভেবো না।“ ফোনটা কান থেকে নামিয়ে প্রমথ বলল, “মাসি কনফার্ম করলেন। লাল ড্রেস পরা বার্বির বাক্সটা মিসিং, আর একটা ব্রিস্ক পুতুল।“
“সেটা আবার কি? “ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি তার কি জানি, যা বললেন তাই বলছি।“ টিপিক্যাল প্রমথ!
সারাটা পথ একেনবাবু ঘন ঘন পা নাচালেন আর স্বগতোক্তি করলেন, “সত্যি ভেরি কনফিউসিং।“
প্রমথ শেষে বিরক্ত হয়ে বলল, “কি এত কনফিউসিং মশাই, জিনিস চুরি হয় না ? কোলকাতায় তো সব সময়ই ছিঁচকে চুরি হচ্ছে। না আপনি গীতার রেপ এবং মার্ডার আর এই ছিঁচকে চুরিটাকে মেলাতে চাচ্ছেন ? “
“না স্যার, বিমল কনফিডেণ্ট যে দিলীপ খুন করেছে।“
“দিলীপ? “
“ঐ যে বস্তিতে থাকে – ভ্যান রিক্সা চালায়। তাকে গীতার ঘরে ঢুকতে দেখেছে একটা ছেলে আর খানিকবাদে বেরিয়েও আসতে দেখেছে। আর দিলীপ স্বীকারও করেছে বিমলের কাছে।“
“স্বীকারোক্তিটা কি পিটিয়ে আদায় করা হয়েছে, না সিমপ্লি প্রশ্ন করে ? পিটুনি খেলেতো বাপিও স্বীকার করবে গীতাকে রেপ করেছে।“
“ইডিয়টের মতো কথা বলিস না ,” আমি ধমক দিলাম।
একেনবাবু শুধু বললেন, “ফরেন্সিক টেস্ট-এর রেসাল্ট এখনও আসে নি। সেটা এলে পাকা প্রমাণ পাওয়া যাবে।“
“কি রে, শুনলিতো একেনবাবু কি বললেন? “ প্রমথ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়লো।“ উনি পুলিশের লোক, জানেন কি ভাবে এদেশে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। তাই পাকা প্রমাণের দরকার।“
গল্পের নবম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।