খাসি

আমার নানাবাড়ি আমাদের বাসার কাছেই। পুরনো দিনের বাড়ি, সামনে পেছনে অনেক জায়গা, পাশে নারকেল সুপারিগাছের সারি ঘেরা পুকুর। বাড়িতে হাঁস-মুরগী গরু-ছাগল। এক খালার হাঁপানির ধাত। তাই বাড়িতে ছাগলের দুধের বেশ কদর।
ছাগলেরা যেমন হয়, কদিন পরপরই এক জোড়া ফুটফুটে ছানা। তার কিছু বকনা, আর কিছু এঁড়ে। দুধ ছাড়ার পরেই এঁড়েগুলোকে একটা বড় চটের বাজারের ব্যাগে ঢোকানো হত। তারপর তাদের মাথাগুলো বাইরে রেখে, ব্যাগের মুখের বাকিটা চটের সুতলির হালকা সেলাইয়ে বন্ধ করে দেয়া হতো। এতে করে চঞ্চলমতি এই শিশুগুলোকে অনায়াসেই পরিবহন করা যেত। সেই ব্যাগটি রিক্সার পাদানিতে ফেলে ফুলবাড়িয়া পশু হাসপাতালে নিয়ে যেত আমাদের মান্নান ভাই।
আশির দশকের গোড়ার দিকের ফুলবাড়িয়ার পশু হাসপাতাল। সদর দরজার ডানপাশেই বড় হলঘর। হলঘরের দেয়াল ঘেঁষে সিমেন্টের বসার জায়গাগুলো বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে গেছে। আর সব সরকারি দালানের মতই দেয়াল- হলুদ ওয়াশ দেয়া, খয়েরি-লাল বর্ডার। রাস্তার ওপারের ফারারসার্ভিসের দালান দেখা যায়, সেটারও প্রায় একই রং নকশা।

কোনায় কোনায় পানের পিক। সবুজ শিকের জানালায় জংধরা শিকল দিয়ে ঝোলানো টুকটুকে লাল রং-এর দানবাক্স। তাতে সাদা রং এর হাতে লেখা ঠিকানা। ঝনঝনিয়া আলিয়া মাদ্রাসা। পানের পিকের আলপনা থেকে বাঁচিয়ে দেয়ালে হ্যান দিয়ে লম্বা ডান্ডাওয়ালা এক শলার ঝাড়ুকে দুপায়ের ফাঁকে নিয়ে নাক ডেকে চলেছে এক জমাদার। তার খাটো ধুতিটি কখনো সাদা ছিল। কানে তার পাতার বিড়ি গোঁজা। ওদিকে এক এলশেসিয়ান, ইয়াব্বড় জিব বের করে হাঁপিয়ে চলেছে; তার মালকিন এক নিরীহ ঘোমটা মাথা বুড়ি, যার কালো ফ্রেমের পাশতোলা চশমার কোনাগুলো জাফরী কাটা; একটা কাঁচ অপরিস্কার, ঘষাঘষা।
সামনে বাদামি কাঠের টেবিল চেয়ার নিয়ে কাউন্টার। সাদা হাফশার্ট আর সাদাচুলের কেরানি মনযোগ দিয়ে রশিদ কেটে চলেছে। পাশে তার আদ্দিকালের স্ট্যান্ড ফ্যান বজ বজ শব্দ করে নিজের অক্ষে থেকেই ঘুরে ঘুরে কখনো ঝড়ো হাওয়া আবার কখনো ধীরস্থির গরমের অদলবদল। এতো বাতাসের পরেও তার খাঁচায় আটকে থেকে উড়ছে যুগান্তরের মাকড়সাজাল। টেবিলে রাখা ছোট রেডিওতে মৃদু শব্দে চলছে বানিজ্যিক কার্যক্রম, ঢাকা ‘ক’।

কাউন্টারে ছাগলপ্রতি একটাকা জমা দিয়ে হাতে রসিদ নিয়ে আমার পাশে ফিরে আসেন মান্নান ভাই। ডাক পড়ার অপেক্ষায় আমরা পকেটে করে নিয়ে আসা পানিফল ছিলে ছিলে খাই। মাটিতে ঝড়ে পড়ে সবুজ-বেগুনি-সাদা খোসাগুলো। ডাক পড়ে। বাজারের ব্যাগটিকে নিজের শিশুর মত পাঁজাকোলা করে নিয়ে উঠে দাঁড়ান মান্নান ভাই। বাচ্চাগুলোর একটা নাকি দুটো বলে ওঠে ম্যাঁ ম্যাঁ। একটা লোহার নিচু গেট মাথা নুঁইয়ে পেরিয়ে আমরা চলে আসি একটা সিমেন্ট ঢালা পাকা উঠনে।

সাদা জরির পাড়তোলা লুঙ্গী আর দারোয়ানদের কাঁধপট্টিওয়ালা শার্টের ওপর নীলচে সবুজ এপ্রন পরা এক মুশকো জোয়ান দাঁড়িয়ে আছে উঠনে। নাকওয়ালা উচু স্পনে্‌জর স্যান্ডেলটিকে কামড়ে ধরে আছে তার আত্মবিশ্বাসী বুড়োআঙুল। বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমার চিপায় আধপোড়া দোতলা সিগারেট; সে হাতেই লুঙ্গীটাকে প্রায় হাঁটুর কাছে তুলে এনে রেখেছে সে। আরেক হাতে এক বিদঘুটে যন্ত্র – ধাতব, মসৃণ ও আলোর প্রতিফলক। দেখতে কিছুটা পিচকারি, কিছুটা কাঁচি। তার পায়ের কাছে একটা বালতি; একটি শুঁড় উদ্যত হাতির ছাপামারা সেই বালতিতে। বালতির পাশে একটা জলচৌকির ওপরে রাখা একটা ছোট ডেটলের বোতলে মুখে এক দলা তুলো দিয়ে আটা, বোতলে মেঘলা তরল। আমি জানি, ওটা আসল ডেটল নয়, ওটা পানি মেশানো ডেটল। নিরেট ডেটলের রঙের শরষে তেলের মত, পানি মেশালেই সেটা হয় মেঘ রঙ এর। কাছে আসলে মুশকোর সাদা লুঙ্গীর ক্ষুদে ক্ষুদে রক্তের দাগ দেখা যায়। কিছু কালচে, কিছু চকচকে লাল।

মুশকো জোয়ানের চোখেমুখে শিশুর মত মাসুম হাসি। রেডিওতে বাজছে, ‘ হাতুড়ি মার্কা – সেলাই সুতা – শক্ত মজবুত – দামে শস্তা…”
ব্যাগ খুলে প্রথমে দুধসাদার ওপরে বাদামি ছোপওয়ালা এঁড়েটিকে এগিয়ে দেন মান্নান ভাই। সিগারেটটা মুখে চালান করে দিয়ে অভ্যস্ত বাম হাতে আলগোছে তাকে বগলদাবা করে নেয় মুশকো। এঁড়ের মাথা আর সামনের পাদুটো চলে যায় তার বগলের পেছনে। এঁড়ের পেছনের একটি পা ধরা থাকে তার বাঁ হাতে। মান্নান ভাই এগিয়ে গিয়ে টেনে ধরেন এঁড়ের আরেকটি পেছনের পা।

সেই বিদ্‌ঘুটে মেশিনটি চালানো হয়। কেউ কোন শব্দ করে না। না মেশিন, না এঁড়ে, না মুশকো। শুধু কিছু দুধসাদা লোম ক্রমশ রক্তাভ হয়। হাতের ঝটকায় শিশু ছাগলের অন্ডকোশ মেশিন থেকে বালতিতে ফেলতে ফেলতে মুশকো জওয়ান কী যেন মন্ত্র আওড়ায়। শুনতে পাই না।

তারপর ডেটল মাখা তুলো ছুঁয়ে দিয়ে খাসিটিকে উঠোনে ছেড়ে দেয়া হয়। যেন কিছুই হয়নি, এভাবেই মাটিতে দাড়িয়ে লেজ নাড়ে খাসি। উতসুক পায়ে গুটি গুটি হেঁটে বেরায়।

যান্ত্রিক দ্রুততায় আরেকটি এঁড়ে তার পুরুষত্ব হারায়। এবারো মন্ত্র আওড়ায় মুশকো। কৌতূহলী শিশু আমি তাকে শুধাই – কী মন্ত্র পড় তুমি? ততক্ষণে তৃতীয়টির পালা। হাতের ঝটকার সঙ্গে সঙ্গে মুশকো রসিকতার হাসি হেসে তার মন্ত্রটি আবার আওড়ায়। এবার একটু জোরে, আমি শুনতে পাই সে বলছে:
” কি সোনা হারাইলি মনু, কিসুই জানলি না” ।

দুঃখিত!