খানিকটা তামার তার-২য় অংশ

তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মানিকের চোখে পড়ল আর এক দৃশ্য। অমরবাবুর বাড়ির সামনে গ্যাস-পোস্টের উপরে একটা মূর্তি। পরমুহূর্তে মূর্তিটি ঝাঁপ খেল মাটির উপরে । গ্যাসের আলোকে চিনতে বিলম্ব হল না। জয়ন্ত ।
মানিক হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে, জয়ন্ত আবার এসে দাঁড়ালো ঘরের ভিতরে । তার হাসি-হাসি মুখ।
‘ এসব কী জয়ন্ত, তুমি চোরের মত অমরবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলে?’
‘ গিয়েছিলাম।’
‘ তোমার পায়ে রবারের জুতো, হাতে রবারের দস্তানা!’
‘ হাঁ, এ হচ্ছে ভালকানাইজড্ (vulcanized) রবার।’
‘ আশ্চর্য!’
‘ এর চেয়ে বেশি আশ্চর্য যদি হতে চাও তাহলে ছুটে যাও টেলিফোনের কাছে।’
‘ তারপর?’
‘ গিরীন্দ্রকে ফোন কর । বল, এখনি সদলবলে ছুটে আসতে।’
‘ সেকি, এই রাতে! এই ঝড়-জলে ?’
‘ হাঁ, হাঁ, হাঁ! বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো না । গিরীন্দ্রকে বল এখনি সদলবলে অমরবাবুর বাড়িতে না গেলে এ মামলার কিনারা হবে না । ততক্ষণে আমি একটু বিশ্রাম করে নি।’

অল্পক্ষণ পরেই একদল পাহারাওয়ালা নিয়ে গিরীন্দ্র এসে হাজির হলেন হন্তদন্তের মত।
সে কোনও প্রশ্ন করার আগেই জয়ন্ত বললে, ‘ এখন কোনও কথা নয় । এখনই আমাদের যেতে হবে অমরবাবুর বাড়ির ভিতরে ।’
দ্বারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে এই অসময়ে পুলিশ দেখে অবাক হয়ে গেল। জয়ন্ত সকলকে নিয়ে উঠে গেল একেবারে উপরে। রাস্তার ধারের বারান্দায় গিয়ে সে টর্চের আলো ফেললে। সেখানে পড়ে আছে একটা নিশ্চেষ্ট মূর্তি।
গিরীন্দ্র সভয়ে বললে, ‘ বাবা! আবার বজ্রাঘাতে মৃত্যু নাকি?’
জয়ন্ত বললে, ‘ আরো এগিয়ে দেখ।’
গিরীন্দ্র কয়েক পদ অগ্রসর হয়ে ভাল করে দেখে মহা বিস্ময়ে বলে উঠল, ‘ একি,
সুরেনবাবু! এঁর হাত পা মুখ বাঁধলে কে !’
জয়ন্ত বললে, ‘ আমি।’
‘ কেন?’
‘ সুরেন হচ্ছে খুনী।’
‘ খুনী! সুরেনবাবু আবার কাকে খুন করেছেন ?’
‘ অজিত আর অসীমকে ।’
এমন সময় বারান্দার তৃতীয় ঘরের একটা জানালা খুলে গেল। ভিতর থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল অমলের ভীত মুখ ।
জয়ন্ত বললে, ‘ সুরেন আজ আবার বধ করতে চেয়েছিল ঐ বেচারা অমলকে।’
গিরীন্দ্র বললে, ‘ কিন্তু অজিত আর অসীমের মৃত্যু হয়েছে বজ্রাঘাতে! বজ্র তো সুরেনবাবুর হাতে ধরা নয় ।’
‘ অসীম আর অজিত বজ্রাঘাতে মারা যায়নি। তাদের মৃত্যু হয়েছে মানুষের হাতে বন্দী বিদ্যুত্-প্রবাহের দ্বারা।’
‘ প্রমাণ।’
‘ ঐ জানালার দিকে তাকিয়ে দেখ?’
জানালার ছয়টা গরাদের গায়ে জড়ানো রয়েছে খানিকটা তামার তার।
গিরীন্দ্র মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, ‘ আমি বুঝতে পারছি না।’
‘ বিদ্যুত্-প্রবাহ সবচেয়ে বেশি জোরে চলে রুপোর ভিতর দিয়ে । তারপর তামার স্থান ।
তারপর সোনা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি।’
‘ বুঝলুম । কিন্তু এই তামার তারের ভিতর দিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হবে কেমন করে?’
‘ সামনেই ট্রামের লাইন। মাথার উপরকার যে মোটা তারের সাহায্যে বৈদ্যুতিক ট্রাম
চলে, জানালার এই তামার তারের অন্য প্রান্তে এখনো ঝুল্ছে তার সঙ্গে লগ্ন হয়ে ।
মাঝখান থেকে তার কেটে দিয়েছি আমি নইলে এতক্ষণে আমাকেও কেউ জীবিত
অবস্থায় দেখতে পেতে না।’
‘ কী ভয়ানক, কী ভয়ানক! কিন্তু – ‘
‘ এখনো তোমার মনে ” কিন্তু ” আছে। তাহলে আরো একটু পরিষ্কার করে বলছি শোন।’
জয়ন্ত বলতে লাগল, ‘ সুরেন হচ্ছে একটি প্রথম শ্রেণীর অতি চালাক শয়তান ।
মাথা খাটিয়ে নরহত্যার বেশ একটি নূতন উপায় আবিষ্কার করেছিল। কাজ করত
এমন একটি রাতে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্র যেদিন তাকে সাহায্য করবে। কী করে সে মনের মত রাত্রি নির্বাচন করত ; এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে! আমি মনে করি, আমার মতন সেও কোন সরকারি আবহ-বিদ্যাবিদদের কাছে আনাগোনা করত।
‘ এরূপ অবস্থায় মানুষের পক্ষে কী করা স্বাভাবিক, এ নিয়ে সে মনে মনে আলোচনা করেছিল। এই বর্ষাকালেও গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ আমরা, শয়নগৃহের জানালার পাশেই শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করি। রাত্রে যদি হঠাত্ বৃষ্টি আসে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর বৃষ্টির ছাট থেকে আত্মরক্ষার জন্যে নিদ্রাজড়িত চক্ষে তাড়াতাড়ি সর্বাগ্রে খোলা জানালাগুলো দুমদাম শব্দে বন্ধ করে দিই ।
‘ আমাদের এই অভ্যাসের উপরেই নির্ভর করে সুরেন পাতত চমত্কার ফাঁদ। খানিকটা তামার তার সে এমনভাবে জানালার গরাদগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রাখত যে জানালা বন্ধ করতে গেলেই সেই তার স্পর্শ করা ছাড়া উপায় নেই। তামার তারের অপর প্রান্ত সে নিক্ষেপ করত বৈদ্যুতিক শক্তিতে জীবন্ত ট্রামের তারের উপরে । জলে জানালার তার আরও জীবন্ত হয়ে উঠত, তখন তাকে ছুঁলেই মৃত্যু অনিবার্য ।
‘ তারপর যথাসময়ে সুরেন আবার এসে নিজের অপকীর্তির গুপ্ত চিহ্ণগুলি বিলুপ্ত করে দিত। আমার বিশ্বাস বিপজ্জনক মৃত্যুকে এমন ভাবে খেলা করার সময়ে আমার মত সুরেনও ব্যবহার করত ভালকানাইজড্ রবারের জুতো ও দস্তানা। ফলে বৈদ্যুতিক শক্তিতাকে আক্রমণ করতে পারত না।
‘ সুরেন এটাও হয়ত অনুমান করেছিল যে, একই বাড়িতে একেকভাবে উপর-উপরি তিন জন লোকের মৃত্যু হলে পুলিশের সন্দেহের সীমা থাকবে না। কিন্তু এটাও তার অজানা ছিলনা যে, আসল রহস্য আবিষ্কার করতে না পারলে যে কোনও সন্দেহই পঙ্গু হয়ে থাকবে কারণ সন্দেহ ও প্রমাণ এক কথা নয়। কিন্তু সুরেন অতি চালাক কিনা, তার চক্রান্ত বুঝবার মতন লোকও যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, এটা সে ধারণায় আনতে
পারেনি। এ হচ্ছে অতি চালাকের দুর্বলতা ।
‘ একই বাড়িতে উপর-উপরি দুই ব্যক্তির বজ্রাঘাতে মৃত্যু, অথচ ঘরে বজ্রাঘাতের
চিহ্ণ নেই এবং মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া যায় ঠিক জানালার ধারেই! এইসব অস্বাভাবিক
ব্যাপার দেখেই আমি পেয়েছিলুম এর মধ্যে হত্যাকারীর হাতের সন্ধান! টারপর
বারান্দায় দাঁড়িয়ে জীবন্ত তারের দিকে তাকিয়ে থাকতেই আমার মনে ফুটে উঠল
সন্দেহের ভীষণ ইঙ্গিত।
‘ তারপর হত্যার উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে বিলম্ব হল না। অমরবাবুর তিন পুত্রের অবর্তমান
সম্পত্তির মালিক হবেন তাঁর কন্যা এবং সুরেন হচ্ছে সেই কন্যার স্বামী ?
‘ ঘটনাস্থলের উপর পাহারা দেবার জন্যই আমি সামনের বাড়ী খানা ভাড়া
নিয়েছিলুম। আবহ-বিদ্যাবিদ বললেন, আজ গভীর রাত্রে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা ।
আমিও অবিজাগ্রত হয়ে উঠলুম বারান্দার উপরে চোরের মতন সুরেনের আবির্ভাব দেখে। চুপি চুপি গ্যাসপোস্টের সাহায্যে বারান্দায় উঠে অন্ধকারে লুকিয়ে রইলুম। তারপর সুরেনের মৃত্যু-ফাঁদ পাতা যেই শেষ হল, আমিও অমনি বাঘের মতন তার ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়লুম- আমি চেয়েছিলুম তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতে। সে ট্মু শব্দটি করবার আগেই আমি তাকে বন্দী করে ফেললুম এবং তখনই কেটে দিলুম
বৈদ্যুতিক শক্তিতে জীবন্ত মৃত্যু-ফাঁদের তার।’

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!