বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ জালিম শাসকদের জুলুম নির্যাতনের কারণে দিশেহারা। মজলুমদের চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও জালিমদের জুলুম যেন থামতেই চায় না। জালিমরা মনে করে- তাদের অন্যায়ের বোধহয় কোন বিচার হবে না। অথচ পবিত্র কোরআনের সূরা ইবরাহীমে বলা হয়েছে, “জালিমদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে করো না। আল্লাহতায়ালা তাদেরকে শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন।” অন্যদিকে সূরা শুরাতে বলা হয়েছে, “জুলুমবাজরা তাদের জুলুমের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।” রাসূল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহতায়ালা জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন, অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না।” অন্যদিকে জনৈক আরব কবি জালিমদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “ক্ষমতা থাকলেই জুলুম করো না, জুলুমের পরিণাম অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। জুলুম করার পর তুমি তো সুখে নিদ্রা যাও কিন্তু মজলুমের চোখে ঘুম আসে না। সে সারা রাত তোমার ওপর বদদোয়া করে এবং আল্লাহ তা শোনেন । কেননা, তিনিও ঘুমান না।”
পৃথিবীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক জালিম শাসকের চরম শাস্তি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আর কিয়ামতের দিন তাদের জন্য অপেক্ষা করেছে চরম লাঞ্ছনা ও অপমান।
আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ ছিলেন একজন জালিম শাসক। তার শাসনামলে নবীবংশের মহান ইমামদের ওপর জুলুম-নির্যাতন এবং আলেম ও প্রতিবাদীদের কারাগারে নিক্ষেপ ও হত্যা বহু ঘটনা ঘটেছে। একবার খলিফা হারুনুর রশিদ কবি আবুল আতাহিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কবি সেখান থেকে খলিফাকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠির একটি অংশে তিনি লিখেছিলেন- “আল্লাহর কসম! জেনে রেখ, অত্যাচার স্বয়ং অত্যাচারীর জন্যই ভয়ঙ্কর অমঙ্গল ডেকে আনে। অত্যাচারী সব সময়ই অসৎ। ওহে জালিম! কিয়ামতের দিন যখন আমরা একত্রিত হব, তখন কে প্রকৃত ঘৃণিত তা তুমি জানতে পারবে।” খলিফা হারুনুর রশিদের কথা যখন উঠলই তখন তার আমলের একজন বিখ্যাত আলেমের কথা বলব। ওহাব ইবনে উমার নামের ওই আলেমকে খলিফা হারুন বাগদাদের প্রধান বিচারপতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই আলেম একজন জালিম শাসককে সহযোগিতা করতে চাননি বলে বাকী জীবন ‘পাগল’ হবার ভান করে রাজদরবার থেকে দূরে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ‘বাহলুল পাগল’ নামেই পরিচিত হন। ঘটনাটি এ রকম-
আব্বাসীয় বংশের পঞ্চম খলিফা হারুনুর রশিদ একবার বাগদাদে একজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে চাইলেন। কাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায় এ নিয়ে তিনি তার সভাসদদের সাথে পরামর্শ করতে বসলেন। সবাই বলল-ওহাব ইবনে উমার অর্থাৎ বাহলুলের চেয়ে এই পদের যোগ্য আর কেউ নেই। কারণ তিনি একজন নামকরা আলেম ও ফকীহ ব্যক্তি।
সবার পরামর্শে খলিফা হারুন বাহলুলকে ডাকলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ফকীহ সাহেব! আপনাকে আমরা প্রধান বিচারপতি বানাতে চাই। এত বড় পদে বসতে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি নেই।
বাহলুল খলিফার এ প্রস্তাবে মোটেই রাজি ছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন, এ ধরনের কোন দায়িত্ব খেয়ানত ও গোনাহ’র ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। তাছাড়া, কোন জালিম শাসককে সহযোগিতা করার পক্ষপাতি তিনি ছিলেন না। তাই তিনি বললেন :মাননীয় খলিফা, আমি আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ আমি নিজেকে এ কাজের যোগ্য মনে করি না।
খলিফা বললেন-কিন্তু বাগদাদের লোকেরাতো আপনাকেই এই কাজের জন্য সবচেয়ে যোগ্য মনে করে। তাদের পরামর্শেই তো আমি আপনাকে ডেকেছি।
বাহলুল বললেন: না, না তারা ঠিক বলেনি। আমার যোগ্যতার ব্যাপারে তারা আমার চেয়ে বেশী জানে না। এরপরও যদি আপনি মনে করেন যে, আমি মিথ্যা বলছি তাহলে আমাকে বিচারক বানানো ঠিক হবে না। কারণ কোন মিথ্যাবাদী বিচারক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
বাহলুলের সাহস ও যুক্তি দেখে খলিফা খানিকটা অবাক হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বাহলুল ইচ্ছে করেই দায়িত্ব এড়াতে চাইছে। খলিফা হারুন এবার ভয়ভীতি দেখানোর কৌশল নিলেন। রেগে গিয়ে বাহলুলকে বললেন,তুমি যত তাল-বাহানাই কর না কেন, আমার আদেশ তোমাকে মানতেই হবে। নইলে তোমাকে চরম শিক্ষা দেব।
অবস্থা বেগতিক দেখে বাহলুল বললেন-আমাকে একদিন সময় দিন। আপনার প্রস্তাবটা নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করি। তারপর সিদ্ধান্ত জানাই।
খলিফা হারুন বললেন, ঠিকাছে! তোমাকে একদিনের সময় দিলাম। তবে মনে রেখ- আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে মেনে নিতেই হবে।
এরপর বাহলুল বাদশাহ হারুনের দরবার থেকে বের হয়ে এলেন। বাসায় এসে চিন্তা-ভাবনার পর তিনি অদ্ভুত এক কৌশল গ্রহণ করলেন। কৌশল অনুযায়ী পরদিন সকালে তিনি পাগলের বেশ ধরে লম্বা একটা লাঠি নিয়ে বাজারে গেলেন। মানুষজন দেখল, বাহলুলের কাপড়-চোপড় ঠিক নেই। হাতের লাঠিতে সওয়ার হয়ে তিনি চিৎকার করে বলছেন- এই তোমরা আমরা সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। নইলে আমার এই ঘোড়া তোমাদেরকে লাথি মেরে ফেলে দিতে পারে। তখন কিন্তু আমার কোন দোষ দিতে পারবে না।
একজন বিজ্ঞ আলেম লাঠিকে ঘোড়া বানিয়ে অদ্ভুত আচরণ করছে দেখে মানুষজন অবাক হয়ে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগল, বাহলুল পাগল হয়ে গেছে। তাদের একজন গিয়ে হারুনুর রশিদের কাছে এই খবর দিল। হারুন সব শুনে বললেন-তোমরা যা বলছ তা সত্য নয়। বাহলুল পাগল হয়নি বরং সে দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কাছ থেকে পালাচ্ছে।
এ ঘটনার পর খলিফা হারুন বাহলুলকে আর বাগদাদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিলেন না। বাহলুলও দায়িত্ব এড়ানোর জন্য বাকী জীবন পাগলের বেশেই কাটিয়ে দেন।
বিখ্যাত ওলি ওহাব ইবনে উমারের ‘বাহলুল পাগল’ হওয়ার কাহিনী জানা হলো। এ পর্যায়ে শুনলে। আমরা তার কিছু মূল্যবান উপদেশ শুনব- যা তিনি দিয়েছিলেন বিখ্যাত সুফি সাধক জুনাইদ বাগদাদীকে। ঘটনাটি এ রকম-
একদিন বাহলুলের সঙ্গে জুনাইদ বাগদাদির দেখা হলো। জুনাইদ বাহলুলকে কিছু উপদেশ শোনানোর জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন। বাহলুল বললেন, তোমার উপদেশ শোনার কি প্রয়োজন। তুমি নিজেই তো একজন মহাজ্ঞানী মানুষ।
জুনাইদ বললেন, কি যে বলেন হুজুর! আমি একজন মুখ্য-সুখ্য মানুষ। আপনার কাছ থেকে কিছু মূল্যবান কথা না শুনলে আমার তৃপ্তি মিটবে না।
বাহলুল বললেন, ঠিকাছে। আমি তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করব। যদি ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারো তাহলে কিছু উপদেশ দেব। তুমি কি জানো- কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে খেতে হয় এবং কিভাবে ঘুমাতে হয়?
হযরত জুনাইদ (রহ.)-এর কাছে প্রশ্ন তিনটি খুব সহজ মনে হল। তাই তিনি বললেন- আপনার প্রথম প্রশ্নে উত্তরে বলছি- আমি খুব নম্র ও ভদ্রভাবে কথা বলি যাতে শ্রোতা বিরক্ত না হয়। আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল কিভাবে খেতে হয়? এর উত্তর হলো- খাবার আগে আমি ভালভাবে হাত ধুয়ে নিই এবং ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আহার শুরু করি। খাওয়া শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। আপনার তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল ঘুম সম্পর্কে। আমি ঘুমাবার আগে ওজু করে নেই। তারপর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিছানায় শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়েই কালেমা শাহাদত পাঠ করি, এরপর ঘুমিয়ে পড়ি।
জুনাইদের উত্তরগুলো শুনে বাহলুল উঠে দাঁড়ালেন। এরপর বললেন, ভেবেছিলাম তুমি একজন জ্ঞানী লোক। এখন দেখছি ইসলামের মূল বিষয়গুলোও তুমি জানো না।
এই বলে বাহলুল সেখান থেকে চলে যেতে লাগলেন। জুনাইদ তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বললেন- এভাবে চলে যাবেন না হুজুর। আমি বড্ড গুনাহগার বান্দা। আমাকে কিছু উপদেশ দিন।
জুনাইদের জোরাজুরিতে বাহলুল থামলেন। এরপর বললেন: শোনো। নম্র ও ভদ্রভাবে কথা বলে কোনো লাভ নেই যদি কথাটা মিথ্যা হয়, কারণ মিথ্যা সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ। কথা বলার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে সত্য কথা বলা হচ্ছে কিনা। খাওয়ার সময় আল্লাহর নাম নেয়া বা আল্লাহকে স্মরণ করার মধ্যে কোনই কল্যাণ নেই যদি খাবারটা হয় হারাম বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত। খাওয়ার আগে তোমার নিশ্চিত হওয়া উচিত যা খাচ্ছ তা হালাল কি না অর্থাৎ বৈধ উপায়ে অর্জিত কিনা।
এরপর বাহলুল ঘুম সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন এভাবে- ওজু করে এবং কালেমা পাঠ করে ঘুমানোতে কোনই উপকারিতা নেই যদি তোমার অন্তরে থাকে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা। জেনে রেখো, পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে যে ঘুমায় তার ঘুম হচ্ছে প্রকৃত ধার্মিকের ঘুম। বুঝলে জুনাইদ, এগুলোই হচ্ছে মূল বিষয়। বাকী সব দ্বিতীয় স্তরের গুণাবলী।
বাহলুল পাগলের এমন যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে জুনাইদ অবাক হয়ে গেলেন। মানুষ এত ছোটখাট বিষয় নিয়ে এত গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে দেখে বাহলুলের প্রতি জুনাইদের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালবাসা অনেক বেড়ে গেল।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।