খবরের গল্প

সন্ধ্যেবেলার দিকটায় ট্রেনে বেশ ভালই ভিড় থাকে। দিনটা শনিবার হলেও তার ব্যতিক্রম নয়। মেট্রো সাবওয়ে থেকে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে বেরিয়েই ‘দাদা এটা কোন ট্রেন?’ জিজ্ঞেস করে উত্তরের প্রায় শুরুটা কোনওরকমে শুনে বাকিটা একেবারে সঠিক আন্দাজ করে নিজেকে যে কোনও একটা গেটের সামনে ধস্তাধস্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে কয়েকজন ট্রেনে উঠে পড়লেন। এত ভিড় এবং ব্যস্ততার ভেতরে ঘটনাটা চোখ এড়িয়ে যেতেই পারত, কিন্তু দমদম স্টেশনে এই রকম একটা ঘটনা কারও চোখে পড়বে না এ আবার হয় নাকি? অতএব প্রাথমিক ভাবে দুয়েকজনের প্রশ্নবাণ এড়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হল না। বিশেষ করে যখন লেডিস কম্পার্টমেন্টের সামনে ‘কার মোবাইল পড়ে গেল’ এই জাতীয় একটি ছোটখাটো হল্লার উত্তরে কারও কোনও হেলদোল দেখা গেল না, এবং পেছন থেকে একটি ছেলে এসে প্রায় ছোঁ মেরে দু’খন্ড হয়ে যাওয়া মোবাইলটা তুলে নিল। – ওটা জি আর পি-তে জমা করে দিন কথাটা ছেলেটি গায়ে মাখল না।

এমনকি খেয়াল করল না ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের ল্যাজটা অদৃশ্য হওয়ার আগেই তার আশেপাশে একটা জমায়েত গড়ে উঠল। ‘কি ব্যাপার রে? জামাকাপড় দেখে তো মনে হয় ভদ্রলোকের বাচ্চা’ মুখ সামলে কথা বলবেন, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ভদ্রলোকের বাচ্চা – কথাটা বলেই ছেলেটি মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল। শালা পকেটমার আবার ইংরিজি মাড়াচ্ছিস – ষণ্ডামত লোকটা ওর কলার চেপে ধরল – ভাবছিস কিছু দেখিনি? একজন বলল জি আর পি-তে দিয়ে দিতে সেটাও তোর কানে ঢোকেনি কি হয়েছে দাদা – একটা সমবেত প্রশ্ন ছুটে এল। এবং ঠিক কি হয়েছে সেটা বোঝানোর দায়িত্ব ওই কলার চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই নিয়ে নিল।
– পুলিসের হাতে তুলে দিন – আরে না, না ওরা কিছু মাল খিঁচে ছেড়ে দেবে, আবার যে কে সেই, তার চেয়ে এখানেই গল্প শেষ করে দিন – ক্যালা ক্যালা ভিড়ের মধ্যে থেকে তার প্রতি উড়ে আসা এইসব মন্তব্য এবং অনুষঙ্গ হিসেবে ছুটে আসা কাঁচা খিস্তির অবিশ্রান্ত প্রবাহকে কাউন্টার করবে না ভয়ে আধমরা হয়ে যাবে ভাবতে ভাবতেই কিল, চড়, ঘুঁষি এবং লাথির মাঝখান থেকে কেউ বা কেউ কেউ শেষ অবধি তাকেই সত্যি সত্যি জি আর পি-তে জমা করে দিল। এরপরে বেশ খানিকক্ষণ সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে বিবিধ খাদ্যসামগ্রীর দোকানগুলি সমাজতত্ত্ববিদদের আলোচনায় সমৃদ্ধ হল এবং রাত যথেষ্ট বাড়ার আগেই ট্রেনের আগমন নির্গমনে ধীরে ধীরে থিতিয়ে গেল।

পরের দিন রবিবার একটিমাত্র খবরের কাগজের ভেতরের পাতায়, খুব সম্ভবত পাতা ভরানোর তাগিদ থেকেই ‘পকেটমার সন্দেহে দমদম স্টেশনে গণপিটুনিতে হত ছাত্র’ এই শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হল। খবরটি থেকে যা জানা গেল তার সারার্থ অনেকটা এই রকম। মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়ে স্থানীয় এক কৃতী কলেজছাত্র দমদম ষ্টেশনে গণপিটুনি খায় এবং তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। (২) যদিও কুষ্ঠিতে লেখা ছিল যে জাতকের লেখকতার দ্বারা অর্থোপার্জনের যোগ আছে তবু পর্ব সেনগুপ্ত জানে এসব আসলে ছেঁদো কথাবার্তা। ব্লগ এবং ফেসবুকে ইনিয়ে বিনিয়ে এটা ওটা লিখে যতই হাততালি কুড়োক না কেন তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহের মত অর্থ তো বহুদূর, এমনকি সামান্য নামও উপার্জন করা যায় না। তবু যদি লেখা থাকত শুধুমাত্র অন্যের লেখা পড়ে অর্থোপার্জনের যোগ আছে সেটা অনেক বাস্তবসম্মত হত, যদিও জানা নেই প্রুফরিডার, কম্পোজার এবং সম্পাদক ছাড়া আর কারও পক্ষে বিশেষ করে তার মত একটি বেসরকারি কোম্পানির একজন সিনিয়র অ্যাকাউন্টটেন্টের পক্ষে ব্যাপারটা আদৌ সম্ভব কিনা। তবে অন্যের লেখা পড়ে না হোক, অন্যের লেখা সম্বলিত অজস্র বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে তাকে টাকা রোজগার করতে হয়। তা যে সমস্ত বইয়ের গন্ধের মধ্যে দিনের অধিকাংশ সময় সে ব্যয় করে, সেগুলির একটিরও পাতা উলটে দেখার দরকার তার পরে না।

কি করেই বা পড়বে? সে ডাক্তার নয়, আইনজ্ঞ নয়, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নয়। ঘটনাচক্রে পর্ব শুধুমাত্র একটি নামী প্রকাশনা সংস্থার কর্মী। বিয়েচুড়ো করেনি, বাড়িতে বাবা-মা, নেশা বলতে গল্পের বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শোনা এবং ক্যারম খেলা। কোন সময়ে কোন নেশাটাকে অ্যাকোমোডেট করতে হয়, সে বিষয়ে পর্বকে একজন ছোটখাটো বিশেষজ্ঞ ধরা যায়। কাজেই যখন অফিস কলকাতার উত্তর দিক থেকে একেবারে বিপরীত মেরুতে স্থানান্তরিত হল, তখন তার খারাপ লাগেনি। সত্যি কথা বলতে কি, দুই দফায় আধ ঘণ্টা করে মোট একঘণ্টা দমদম এবং রবীন্দ্রসরোবরের মধ্যে মোবাইলবিহীন পাতালপথকে মনে হয় স্বর্গের কাছাকাছি কোনও একটা আশ্রয়। ওই একটি ঘণ্টাকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পড়াশোনাকে উৎসর্গ করে পর্ব বরং মনে মনে বেশ আনন্দই পেয়েছিল। তৃতীয় শনিবারে পুরো অফিস থাকে। অন্যান্য দিনের মতই সাড়ে ছ’টা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে মেট্রোতে উঠেই ওর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা অর্থাৎ দরজার ধারে বসার সিট পেয়ে গেল। আবার এসি। যদিও নন-এসি রেকের প্রচন্ড আওয়াজকে উপেক্ষা করে মনঃসংযোগ বজায় রাখা তার আয়ত্ত্বাধীন, তবু এসি পেলে কার না ভাল লাগে। ‘তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস’ আকস্মিক একটু উচ্চ নারীকণ্ঠ শুনে চমকে বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে পর্ব দেখল ট্রেন বেলগাছিয়া ছেড়ে বেরোচ্ছে। এদিক ওদিক তাকাল, বুঝতে পারল না কে কথাটা বলল। বইয়ের একটি অধ্যায় শেষ, নতুন আরেকটি শুরু না করে ওটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকাল। ট্রেন অনেকটাই খালি হয়ে এসেছে, তবু বসার জায়গাগুলি এখনও সব ভর্তি।

 

পর্ব দেখল পাশেই একটি মেয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সামনেই তার সঙ্গী। একবার দেখেই বুঝল দুজনের সামাজিক অবস্থান এক নয়, মেয়েটির পরনে একটু সস্তা দামের সালোয়ার কামিজ, কিন্তু তার সঙ্গী ব্রান্ডেড পোশাকে বেশ ট্রেন্ডি। তবে এই মুহূর্তে এই ট্রেন্ডি ছেলেটির বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বলছে সে একটু ব্যাকফুটে, সঙ্গিনী যে কোনও কারণেই হোক তার ওপরে রুষ্ট। পর্বর মনে মনে হেসে ফেলল। এই অবজার্ভেশন বোধহয় তার ব্যাগের ভিতরে থাকা ডিটেকটিভ বইটার অবদান। ছেলেটি একটু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল – তুইই বা এটা নিতে চাইছিস না কেন? ট্রেন সুড়ঙ্গের বাইরে বেরোনোর উপক্রম করতেই সবাই যে যার জায়গা ছেড়ে উঠে এগোল। মেয়েটি জবাব না দিয়ে দরজার দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াল। ছেলেটিও এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারল বেশ কয়েক জোড়া অনুসন্ধিৎসু চোখ তাদের অনুসরণ করছে। ট্রেন থেকে নেমে কার্ড পাঞ্চ করার সময় পর্ব পাশের গেটে আবার সেই যুগলকে লক্ষ্য করল। মেয়েটি কার্ড পাঞ্চ করে বেরিয়ে সোজা এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে গেল। ছেলেটিও পেছনে। প্ল্যাটফর্মে একটি ট্রেন ঢুকছে। ডিসপ্লে খারাপ, অতএব পর্বও দৌড়ল। যদি মেন লাইনের কোনও ট্রেন থাকে। কিন্তু না, ডানকুনি লোকাল। পিছিয়ে আসতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পর্ব খেয়াল করল সেই মেয়েটি। সামনে পেয়ে তাকেই জিজ্ঞেস করে সে দৌড়াল লেডিস কম্পার্টমেন্টের দিকে।

ছেলেটিও পেছন থেকে এসে তার জামার ভেতরে কি একটা গুঁজে দিতেই মেয়েটি একটু থমকে, সেটাকে বের করে সোজা ছুঁড়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর ফেলে দিয়ে ট্রেনের ভেতর অন্তর্হিত হয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভোঁ বাজল। ছেলেটি সাময়িক হতভম্ব হয়েও তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল ছুঁড়ে ফেলা জিনিসটিকে পদপিষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য। পর্ব লক্ষ্য করল সেটি একটি মোবাইল ফোন। (৩) ট্রেনটা কি আজ একটু বেশি লেট করছে? ঘড়ি দেখে পর্ব। ‘অনুগ্রহ করে শুনবেন, আপ গ্যালোপিং শিয়ালদহ কল্যাণী সীমান্ত লোকাল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে’। পর্বকে স্বস্তি দেয় রেকর্ডেড মহিলা কণ্ঠ। ভিড় হবেই। অবশ্য টার্গেট করে দাঁড়িয়ে কোনক্রমে ভেতরে একবার নিজেকে গুঁজে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। একেবারে সোদপুর। সামনে ভিড় হবে, হাতের ব্যাগটা ঠিকঠাক করে নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে সে এগিয়ে যায় একটু পিছনের দিকে, গেটটা ধরা দরকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…