খকন চিনের কন্যা

ফার্সি ভাষার লোক বা ফোক-গল্পগুলোর মধ্যে কিছু আছে বেশ বড়ো। যারা গল্প বলতো, তারা হাট-বাজারের খোলা জায়গায় বিভিন্ন কৌশলে আসর জমিয়ে গল্প বলতো। প্রতিদিনই তারা একটু একটু করে গল্প বলে দর্শক-শ্রোতাদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে রাখতো, যাতে পরদিনও সবাই বাকি গল্প শুনতে আসে—এবং তাই হতো। সবাই গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো এবং জমায়েতে এসে হাজির হতো।

সাফাভি আমল থেকে এইসব আখ্যানকারী বা গল্প বলার লোকেরা বাজারের খোলা জায়গার পরিবর্তে কফিহাউজে তাদের আড্ডা জমাতে শুরু করল। আরেকটি পরিবর্তন এলো তখন। আগে যেমন মুখে মুখে গল্প বলা হতো, তার তো লিখিত রূপ ছিল না। এখন গল্প বলার সাথে সাথে একদল লেখক সেগুলোকে লিখিতভাবে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। এভাবে বহু গল্প সংগৃহীত হয়ে গেল।

অবশ্য লোকগল্পগুলোর বেশিরভাগই সাফাভি শাসনামল কিংবা তার পরবর্তী সময়ের হলেও, প্রাচীন লোকগল্প সাফাভি যুগের আগেও লিখিতরূপ পেয়েছিল। প্রাচীন এই লোককাহিনীগুলোর পাঁচটি সমৃদ্ধ সংগ্রহ এখনো আছে। এই পাঁচটি বই হলো— ‘সামাক আইয়্যার, এস্কান্দারনামা, দারাবনামা, ফিরোজশাহনামা এবং কেস্‌সিয়ে হামযা।’

এই পাঁচটি বই গদ্যে লেখা, তবে গল্পগুলোতে মহাকাব্যের স্বাদ ও গন্ধ আছে। ফেরদৌসির মতো কালজয়ী মহাকবি যে বিখ্যাত সাহিত্য সম্ভার রেখে গেছেন, তার মৌলিক অনেক উপাদান এই সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য থেকেও নিয়েছেন। যদিও তাঁর প্রয়োগ কৌশল ভিন্ন, ভাষাভঙ্গি ভিন্ন, এমনকি উপস্থাপনাও নতুন। ইতিহাস আর রূপকথার সংমিশ্রণে যে নতুন রূপটি দিয়েছেন ফেরদৌসি, তা আজও অনন্য এবং অপূর্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।

যাই হোক, শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা নিশ্চয়ই গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তাই সাহিত্যিক আলোচনা আজ নয়, সে বিষয়ে আবারো আলোচনা করা যাবে পরবর্তী আসরে। এবারে চলুন, গল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক।

মুহাম্মাদ নামের এক যুবক তার মায়ের সাথে বাস করতো। মুহাম্মাদের পেশা ছিল শিকার করা। এক রাতে সে বড়ো একটা জানোয়ার দেখতে পেল, যার চামড়া ছিল বেশ জ্বলজ্বলে। মুহাম্মাদ পশুটাকে শিকার করে চামড়াটা তুলে নিয়ে ভাবলো— বাদশাকে এই সুন্দর চামড়াটা উপহার দিলে নিশ্চয়ই ভালো পুরস্কার পাওয়া যাবে। এই ভেবে সে চামড়াটা নিয়ে রওনা হলো বাদশার দরবারের দিকে।

পথিমধ্যে বাদশার এক উজির (মন্ত্রী) তাকে দেখে ফেলল। উজির মুহাম্মাদের কাছ থেকে চামড়াটা কিনতে চাইলো, কিন্তু মুহাম্মাদ রাজি হলো না। এতে উজির তার ওপর ক্ষেপে গেল।

মুহাম্মাদ উজিরকে চামড়াটি না দিয়ে সরাসরি বাদশার কাছে নিয়ে গেল। বাদশা চমৎকার চামড়াটি দেখে খুশি হলো এবং মুহাম্মাদকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য উজিরকে আদেশ দিল। কিন্তু উজির মুহাম্মাদকে একটা নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে পুরস্কার দেওয়ার বদলে উল্টো মারধর করল।

তাতেও তার ক্ষোভ কমলো না। এবার বাদশার কাছে গিয়ে বলল—

“মুহাম্মাদকে বলুন, আপনার জন্য হাতির হাড় দিয়ে একটি প্রাসাদ বানাতে!”

বাদশা তাই করল। মুহাম্মাদকে ডেকে বলল—

“হাতির হাড় দিয়ে আমার জন্য একটি প্রাসাদ বানাও!”

বাদশার এই আদেশ শুনে মুহাম্মাদ ভীষণ কষ্ট পেল। কী আর করবে সে! মন খারাপ করে ঘরে ফিরে এলো।

মা তার ছেলের মন খারাপের কারণ জানতে পেরে উপদেশ দিল। বলল—

“বাজারে গিয়ে অজ্ঞান করার কিছু ওষুধ কিনে আনবে। অমুক জায়গায় একটা পানির ঝর্ণা আছে, যেখানে প্রতিদিন শেষ বিকেলে হাতিরা পানি খেতে আসে। ওষুধটা সেই পানিতে ঢেলে দেবে। হাতিগুলো তখন ওষুধের গন্ধ পেলে আর পানি খাবে না। তবে একটা পঙ্গু হাতি আছে, সে সবার শেষে পানি খেতে আসে। ও এসে পানি খেলে অন্য হাতিগুলোও তাকে দেখে পানি খাবে। যে হাতিই পানি খাবে, সে-ই অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখন তুমি সকল হাতির মাথা কাটতে পারবে।”

মায়ের কথামতো মুহাম্মাদ তাই করল এবং যথার্থই সফল হলো। প্রাসাদ বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ হাড় সংগ্রহ করল এবং প্রাসাদ বানালো।

কিন্তু এত কষ্টের পরও মুহাম্মাদ পুরস্কার পাওয়ার বদলে সেই মন্ত্রীর হাতে আবারো মার খেল! এবার মন্ত্রী বাদশাকে বলল—

“মুহাম্মাদকে বলুন, চীনে গিয়ে সম্রাটের কন্যাকে নিয়ে আসতে!”

মুহাম্মাদের মা এবার আর ছেলেকে কোনো সাহায্য করতে পারল না। তবু মুহাম্মাদ চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

যেতে যেতে এক রাখালের সাথে দেখা হলো। রাখাল মুহাম্মাদের কাহিনী শুনে তার সফরসঙ্গী হলো। কয়েকদিন পথ চলার পর তারা এক বিশালদেহী মানুষের সাথে দেখা পেল, যে অদ্ভুতভাবে ঠাণ্ডায় শুয়ে ছিল।

রাখাল তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। জেগে উঠে লোকটা মুহাম্মাদের বিপদের কথা শুনে সাহায্য করতে রাজি হলো। সে মুহাম্মাদ আর রাখালকে দুই কাঁধে বসিয়ে হাওয়ার বেগে উড়িয়ে নিল এক শহরে। সেখানে তারা এক মহিলার আতিথ্য পেল।

মহিলা বলল—

“যে মেয়েকে তুমি খুঁজছ, সে আমার বোনের মেয়ে। তোমরা তার বাবার প্রাসাদে যাবে এবং এক বিশাল পাথরের ওপর বসবে। রাজা তোমাদের শর্ত দেবে, তা পূরণ করতে হবে। এরপর তোমাদের মেয়ের প্রাসাদে পাঠানো হবে, যা যাদুমন্ত্রে ঘেরা।”

মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীরা সেই পরামর্শ মেনে কাজ করল। রাজা তিনটি কঠিন শর্ত দিল, কিন্তু বিশালদেহী লোকটার সাহায্যে মুহাম্মাদ সব শর্তই পূরণ করল।

শেষ পর্যন্ত রাজকন্যাকে সাথে নিয়ে মুহাম্মাদ দেশে ফিরল। কিন্তু মন্ত্রী এবারও বাদশাকে প্ররোচিত করল—

“মুহাম্মাদকে বলুন, আমাদের পূর্বপুরুষদের খবরাখবর নিয়ে আসতে!”

রাজকন্যা এবার মুহাম্মাদকে বুদ্ধি দিল। মুহাম্মাদ কৌশলে বাদশা ও মন্ত্রীকে একটি গোপন গর্তে ফেলে দিল এবং তাদের জীবন শেষ করে দিল!

এরপর মুহাম্মাদ তার মা ও রাজকন্যাকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেল। চল্লিশ দিন ধরে বিয়ের উৎসব করল, তারপর থেকে তারাই দেশ শাসন করতে লাগল।

বুড়ি ও ব্যবসায়ীর গল্প

অস্বাভাবিক তথ্য-ভূত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *