“গাজী কাওকাব আফরোজ, কাউ আর কাফ, গরু আর বাছুর একসাথে একই নামের মধ্যে, আজিব ব্যাপার!”
সালাম বিনিময়ের পরপরই বসের মুখে এ কথা শুনলে যে-কারোরই চমকে ওঠার কথা, আশফাকেরও তাই হলো। লাঞ্চের পর সে গিয়েছিল একটা তহশিল ভিজিটে, ফিরে এসে অফিসের সামনে বসের গাড়ি দেখে যথেষ্ট অবাক হয়েছে। ফিল্ড লেভেলে সিনিয়র অফিসার খবর না দিয়ে হঠাৎ করে চলে আসতেই পারেন, জুনিয়রের চেয়ারে বসে কাজকর্মের খোঁজখবর নেয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু তাই বলে এভাবে জুনিয়র অফিসারের ড্রয়ার হাতড়ে ব্যক্তিগত কাগজপত্র বের করে পড়বেন ব্যাপারটা অভাবিত! আজই মায়ের চিঠি এসেছে, চিঠির সঙ্গে তার হবু স্ত্রী হিসেবে প্রস্তাবাধীন একটি মেয়ের বায়োডাটা যার নাম গাজী কাওকাব আফরোজ।
খামটা যদি আবু ইউনুস ভুল করেও খুলে থাকেন, এবং কৌতূহলবশত ভেতরের কাগজটা পড়েও দেখেন, স্বাভাবিক আচরণ হতো সেটা নিয়ে কোন কথা না তোলা। অথচ এই লোক দিব্যি জানিয়ে দিলেন তিনি কাজটা করেছেন, এবং সেটা নিয়ে অম্লানবদনে একটা অস্বস্তিকর মন্তব্যও করে ফেলেছেন।
“স্যার আপনি কখন এলেন, চা-টা দিয়েছে তো এরা”- এরকম কিছু বলা দরকার, কিন্তু আশফাকের জিভ অসাড় হয়ে গেছে। মানুষের প্রাইভেসিজ্ঞান এত নীচে নেমে গেছে, বিশেষ করে যে-লোকটা সিভিল সার্ভিসের একটা দায়িত্বশীল পদে আছে, তার! আশফাকের মনের কথা মনেই রয়ে গেল; আবু ইউনুস আগের তালেই কথা চালিয়ে গেলেন- “বিয়েশাদি করার আগে পাত্রীর নামটা ভালমতো স্টাডি করা দরকার। মেয়েদের নামের গোড়ায় কাজী, মুন্সি, চৌধুরী এই সমস্ত দেখতে ভাল লাগে না। উম্মে, সুলতানা, কানিজ- এইগুলা থাকলে অবশ্য চলে। কী যে দিনকাল আসছে, কালকে দেখি টিভিতে খবর পড়ল একজন- নাম কেকা ইসলাম। কই ময়ূরের ডাক, আর কই ইসলাম! বল দেখি এইটা খাটলো? তাও যদি কেকা পঙ্খী হইত, বুঝতাম একটা কিছু অর্থ আছে!”
প্রাথমিক শকটা কাটিয়ে উঠে মুখে একটুখানি সৌজন্যের হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে আশফাক। এসি ল্যান্ড হিসেবে এই উপজেলায় সে এসেছে মাত্র আটদিন আগে। প্রথম দুদিন দায়িত্ব বুঝে নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে গিয়েছিল। তখন অবশ্য ইউএনও আবু ইউনুসের ব্যস্ত সময় যাচ্ছিল- এমপি সাহেব এলাকায় এসেছিলেন অনেকদিন পর। এর পর একদিন বিকেলে বসের বাসাতেও গিয়েছিল সে, অভিজ্ঞতাটা খুব ভাল হয় নি। আট আর পাঁচ বছর বয়সী দুটো বিচ্ছু ছেলেমেয়ে আছে আবু ইউনুসের- গালিগালাজের ডিপো! ইউএনও-র বাসার ড্রইংরুমে চা-নাশতার ট্রে সামনে নিয়ে বসের অপেক্ষায় বসে ছিল আশফাক, ওইটুকু বাচ্চা ছেলে যখন এগিয়ে এসে একথাবা চানাচুর তুলে নিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলেছে, “ওই হালার হালা কী চাস?”- নিজের কানকে বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হয়েছে।
অস্বস্তিগুলো চেপে রেখে দাপ্তরিক বিষয়ে বসের সঙ্গে কিছু জরুরি আলাপ সেরে নিল আশফাক। তহশিলগুলোতে দাখিলা বইয়ের স্টক শেষ হয়ে গেছে, থানার ওসি একটা প্রায়-অসম্ভব কাজের তদবিরে আছেন, অফিসে কর্মচারী সংকট ইত্যাদি ইত্যাদি। আবু ইউনুস মন দিয়ে শুনলেন, পরামর্শও দিলেন। বায়োডাটা বা বিয়ের প্রসঙ্গটা চাপা দিতে পেরে আশফাক একটু স্বস্তি বোধ করে, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকবার বিব্রত হতে হয় তাকে। দাখিলা বইয়ের অভাবে এলাকায় জমিজমার বেচাকেনা আটকে আছে, তাই বিয়েশাদির দাওয়াত আজকাল কম পাওয়া যায়- এমন উপসংহার টেনে বিদায় নেয়ার আগে চোখেমুখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে আবু ইউনুস বললেন, “কতদিন আনম্যারেড থাকবা? এমনিতে বামহাতের রেখা বেটামানুষের বেশিদিন থাকে না, তার উপর যে চাকরিতে আসছো জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর কইয়া হাত কচলাইতে কচলাইতে দুই হাতের রেখাই যাইব গা। আয়ুরেখা ক্ষয় গেলে যাক, বিবাহরেখা গায়েব হওয়াটা কোনো কাজের কথা না!”
দুই.
উপজেলায় অফিসারদের অবসর বিনোদনের জন্য একটা ক্লাব আছে। ইউএনও-র বক্তব্য অনুযায়ী মাঝেমধ্যে সেখানে হাজিরা দিয়ে হেলথ, ইঞ্জিনিয়ারিং, এডুকেশন, স্ট্যাটিসটিক্স, এগ্রিকালচারের মতো হাবিজাবি ডিপার্টমেন্টের লোকজনের উপর বাহাদুরি ফলানোটা প্রশাসনের লোকের প্রায় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই কর্তব্য এতদিন তিনি একাই পালন করেছেন, এখন আশফাক এসে পড়ায় তার ঘাড়েও কিছু চাপিয়ে দিয়েছেন। দিনকয়েকের মধ্যে এক সন্ধ্যায় ক্লাব থেকে ফেরার পথে আশফাকের বাসাতেও ঢুঁ দিলেন বস।
“হুমম, ব্যাচেলারের বাসা দেখলেই বুঝা যায়”- আবু ইউনুস মাথা নাড়েন। কথাটা খুব সত্যি, আশফাকের সংসারে আসবাব বলতে এক ফোল্ডিং খাট আর ছোট টেবিল-চেয়ার। রান্নার জন্য মাদারীপুর থেকে মা একটা ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে- সেই লোকমানের দৌড় ভাত-ডাল থেকে পানসে নুডলস পর্যন্ত। “কথা বলারও তো মানুষ নাই তোমার! খাড়াও, ক্লাবে টিভি দিতেছে শুটকির আড়তের হারাধনবাবু, তখন এতো খারাপ লাগব না। তাছাড়া ক্লাব তো আছেই, সবার সাথে আলাপ হইছে না?”
সরাসরি উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ে আশফাক। ক্লাবে যেতে অবশ্য আশফাকের ভাল লাগে না, সেখানে সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য সে, দেখলেই কেউ না কেউ ঘটকালির চেষ্টা করে। লাইভস্টক অফিসারের স্ত্রীর- ক্লাবে যার ডাকনাম ‘পশুভাবী’- গায়ে পড়ে কথা বলাটাও ভাল লাগে না। বাসায় বসে থাকলে সন্ধ্যাটুকু কাটায় গিটারে টুংটাং করে। তার প্রথম পোস্টিং ছিল ময়মনসিংহে, সেখানে ডিসি অফিসেই ব্যস্ত থাকার অনেক সুযোগ আর উপকরণ ছিল। অবসরে ঘুরে বেড়ানোর জায়গাও ছিল। উপজেলায় এসে নিজের একটা অফিস পেয়েছে ঠিকই, তবে সেই অফিসের করুণ হালের কারণে মনটা ছোট হয়ে থাকে। দেয়াল-ছাদের অতি জীর্ণ দশা, তার সঙ্গে মানানসই হালতের চেয়ারটেবিল। ঢাউস চেহারার একটা পুরনো কম্পিউটার, সেটাও বহুদিন ধরে নষ্ট হয়ে আছে ততোধিক তোবড়ান প্রিন্টারসহ। জরুরি চিঠিপত্র করাতে ইউএনও অফিসে যেতে হয়। ইন্টারনেট-আসক্ত না হলেও জেলাসদরে থাকার সময় মাঝেমধ্যে ফেইসবুক খুলে বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর নিত, এখানে তারও উপায় নেই। একটা ভাল মোবাইল ফোনসেট কেনা ফরজ হয়ে গেছে। সেকেন্ডহ্যান্ড ল্যাপটপটা পটল তোলার পর নতুন একটা কিনবে বলে চাকরির শুরু থেকেই টাকা জমাতে শুরু করেছিল, যদিও কিছুদিন আগে মা আভাসে-ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছে, সেই সঞ্চয়ে এখন হাত দেয়া চলবে না। সোনার দাম খুব বেশি, এদিকে বিয়ের সময় ভদ্রগোছের একসেট গয়না নাকি না হলেই নয়।
“খাইছে, অ্যাত্তো বড় পেপারওয়েট লাগে তোমার!” টেবিলের ওপর একটা শো-পিস, প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি ভেনাসের মূর্তি- সেটা দেখে আবু ইউনুসের চোখ কপালে। “এই জিনিস কি দিয়া বানাইছে, শ্বেতপাথর না কষ্টিপাথর? বেডির হাতটা ভাঙাই ছিল নাকি তুমি ভাঙছ?” আশফাক বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। উত্তরের অপেক্ষা না করেই তার বস বলে চললেন- “আর্টিস্ট লোকজনের কাজকর্ম আসলেই পিকিউলিয়ার! আমার মেজ শালার বউ ছবি আঁকে, তাদের সাথে একবার ছবির হাট না ছবির বাজার কী নাম জানি জায়গাটার, ঐখানে গেলাম। আজিব কারবার বুঝলা, আস্ত তরমুজ আঁকা আছে একটা ছবিতে, ঐটার থেকে আধখান তরমুজ আঁকা ছবিটার দাম বেশি! পয়সা দিয়া মানুষ আবার কিনছেও সেই জিনিস।”
“এইটার নাম কী, সেতার না বেতার?” বসের দৃষ্টি এবার টেবিলের পাশে।
“গিটার, স্যার।”
“কও কী! গিটার দেখছি হাতে লটকায়া নাচাকুদা করতে করতে বাজায়। তোমার এই জিনিস তো চেয়ারে জিম খাইটা বইসা বাজাইতে হইব।”
“স্যার এটা হাওয়াইয়ান, আপনি যেগুলোর কথা বলছেন ওসব স্প্যানিশ গিটার”
“ওহহো বুঝছি! টিভিতে একবার দেখাইছিল নাক দিয়া গিটার বাজায় একটা মেয়ে, ট্যাংট্যাং শব্দ হয়, এইরাম গিটারের আওয়াজ!”
“নাক দিয়ে গিটার!”
“হ, টিভিতে দেখছিলাম। বহুত আগের কথা, তখন হলে থাকি… বাই দ্য ওয়ে, আমার সয়েল সাইন্স, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, তুমি কোনখানের?”
“আমি স্যার, জাহাঙ্গীরনগর, বোটানি ডিপার্টমেন্ট”
“জাহাঙ্গীরনগর নট ব্যাড, তবে আল্লার শোকর যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের না। এক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী আর সমাজবিজ্ঞানীতে দেশ ভইরা গেল, প্রাইমারি ইস্কুলের অ্যাসিস্টেন্ট টিচারের পোস্টে ভাইভা দিতে আসে, একটা রেফারেন্স বইয়ের নাম জানে না, জিগাইলে কয় সাকসেস ডিগ্রি গাইড!”
.
তিন.
নাসিরনগরে আশফাকের কয়েকমাস কেটে গেল। দুর্গম কিংবা একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান না হলেও এখানে ঘটনার ঘনঘটা নেই, বাইরের পৃথিবীর উত্তাল ঢেউয়ের যেন এখানে আছড়ে পড়তে মানা, এমনই এক সাদামাটা নীরব নিস্তরঙ্গ এলাকা। সরকারি চিঠিপত্র আর প্রতিদিনকার খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সেরকমই মনে হয় আশফাকের। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে টেলিফোনের যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে, পর পর দুটো পাত্রীপক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে তার বিয়ের ব্যাপারে মায়ের উৎসাহেও কেমন যেন ভাটা পড়ে গেছে। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় থেকেই মুখচোরা ছিল আশফাক, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠিয়ে মেয়েদের সঙ্গে সেভাবে বন্ধুত্ব করে উঠতে পারে নি। আজকাল তার মনে হয়, একটু আউটগোয়িং হতে পারলে এই মরা জায়গায় এমন নিঃসঙ্গতায় ভুগতে হতো না।
অনেকদিন পর অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল পাওয়া গেল।
“আমি সাবেরা ইয়াসমিন, এসিল্যান্ড দেলদুয়ার। চিনতে পারছ?”
“চিনব না মানে! হঠাৎ কী খবর?”
“জরুরি দরকার ভাই। বাঞ্ছারামপুরে কে আছে ল্যান্ডে, আমাদের ব্যাচের কেউ?”
“ল্যান্ডে কেউ নাই, ইউএনও-র চার্জে সবকিছু, কেন, ওখানে কী?”
“ওখানে আমার শ্বশুরবাড়ি। ওদের একটা জমি কেনা নিয়ে ব্যাপার, মিউটেশনে কিছু ঝামেলা হচ্ছিল।”
“আরে বল কী, ভাইসাহেবের বাড়ি বিবাড়িয়ায়! আসো না বেড়াতে, দাওয়াত-টাওয়াত দাও একবার!”
“তোমার বিয়ের দাওয়াত কিন্তু পাই নাই!”
“বিয়ে হলেই তো দাওয়াত পাবা, সেই ব্যবস্থা তো করলা না…”
“হুঁহ, ব্যবস্থা! তোমাদেরকে খুব ভালমতো চেনা আছে, বুঝলা। অ্যাডমিনের আবিয়াইত্যা পোলাপান, বিয়ে করবা সতের-র নামতা ফলো করে। সতের একে সতের, সতের দুগুণে চৌতিরিশ। তোমার বয়স চৌত্রিশ হোক, তখন অর্ধেক বয়সের পাত্রী খুঁজবা।”
“বিশ্বাস কর, এখনই করতে চাই, রাইট বিফোর ক্রসিং থার্টি!”
“শোন ভাই, গেছ ল্যান্ডে, মানে পুরা ক্ষ্যাতের জীবন! তহশিলদারের মোটর সাইকেলের পিছে বসে ল্যান্ডের টেককেয়ার কর, খামোখা একটা স্মার্ট ইয়াং মেয়েকে কষ্ট দিতে ওখানে নিও না। আগে ক্ষেত থেকে উঠে আস কিছু মালপানি নিয়ে, তারপর দেখা যাক কী করা যায়। আচ্ছা, খালাম্মা কোথায় এখন? মাদারীপুরে বাড়ি না তোমাদের, ওখানেই?”
সাবেরার সঙ্গে একই ব্যাচে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একাডেমির ট্রেনিং করেছিল আশফাক। বিশাল পেট নিয়ে ক্লাসে আসত, ক্লাসের মধ্যে কয়েকবার বাথরুমে দৌড়াত বমি করতে। ট্রেনিং শেষ হতেই মেটারনিটি লিভে চলে গিয়েছিল। মনে মনে সাবেরাকে বড়সড় একটা ধন্যবাদ দিল সে। ইউএনও আবু ইউনুসের জন্য পারফেক্ট ট্যাগ পাওয়া গেছে- ‘ক্ষ্যাত’।
চাকরিতে জব স্যাটিসফ্যাকশন বলে একটা ব্যাপার থাকে, যেখানে বসের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করে প্রশাসন ক্যাডারে ঢোকার আগে সে কিছুদিন ঢাকায় একটা বেসরকারি কলেজে চাকরি করেছিল, সেখানকার প্রিন্সিপাল- ভাইস প্রিন্সিপালরা যথেষ্ট স্মার্ট। ময়মনসিংহে যাদের ডিসি-এডিসি হিসেবে পেয়েছিল তাদের সবারই কথাবার্তা মার্জিত, দুএকজনের আবার বাড়তি কিছু গুণও ছিল- একজন শৌখিন কম্পিউটার প্রোগ্রামার, একজন ভায়োলিন বাজান চমৎকার। এদের সঙ্গে থেকে নিজের পেশাগত অবস্থান নিয়ে কখনো হীনমন্যতায় ভুগতে হয় নি তাকে। কিন্তু উপজেলায় এসে মাথার উপর যাকে পেল- সেই আবু ইউনুসের কথা মনে হলেই কেমন যেন হাতপা গুটিয়ে যায়, অস্পষ্ট এক হতাশায় ভেতরে-ভেতরে দমে যায় সে।
আজকাল মাঝে-মাঝে তার সন্দেহ হয় এই লোক আসলেই ঢাকা ইউনির প্রোডাক্ট কি না। গল্পে গল্পে আবু ইউনুস জানিয়েছেন তিনি কয়েক বছর ক্যাডারের বাইরে দুর্নীতি দমন বিভাগে ডেপুটেশনে কাটিয়ে এসেছেন। হবিগঞ্জ না সুনামগঞ্জ কোথায় যেন জেলা দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা ছিলেন। তারও আগে, আশফাকের মতোই এসিল্যান্ড ছিলেন (‘এসি ছিলাম ক্ষ্যাতলালে, জয়পুরহাট জেলায়। বাড়তি দায়িত্ব ছিল কালাইয়ের। কালাই চিনছ তো, ওই যে গ্রামসুদ্ধা মানুষ গিলা-কলিজা সব বেইচা ভূত, সেই উপজেলা!’)।
নিজেদের কাজের ধরনধারণ নিয়ে প্রায়ই গজগজ করেন- “বুঝলা, আগের দিনের সিও-রাই আরামে ছিল। আদতে তো ক্যাটেল অফিসার, কিন্তু পাবলিকে গোমর না বুঝলে যা হয়, কী দাপট তাদের! একশহাতের ভিতর কেউ আসত না, কেউ মুখ খুলত না। এখন পেপারের ভিতরের পাতা খুললেই দেখবা নিউজ- গাঙনীতে ইউপি চেয়ারম্যানের হাতে ইউএনও লাঞ্ছিত, ইউএনওর অপসারণের দাবিতে বাগমারায় বিক্ষোভ- যত্তসব!”
পত্রিকার ভেতরের পাতার এককোণে নিজের নাম দেখতে অবশ্য আবু ইউনুসের আগ্রহের কমতি নেই। কোন এক কাগজের স্থানীয় প্রতিনিধিকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনেন নানা অনুষ্ঠানে। ‘বিদ্যালয়ে বসে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত ৫০ ছাত্রছাত্রী’,‘ইউএনও-র হস্তক্ষেপে বন্ধ হলো শিশু আমিনার বিয়ে’ টাইপের বিভিন্ন রিপোর্টের কাটিং সাঁটা আছে উপজেলা পরিষদের মিটিংরুমের বোর্ডে। জাতীয় কৃমিনিরোধ সপ্তাহের স্থানীয় উদ্বোধক হিসেবে ইউএনও-র বক্তব্য রাখার খবরটা দেখে কে বুঝবে এই লোক সেখানে কী বলেছিল! ‘টিএইচও সাহেব, এইটা কিন্তু ঠিক হইল না। স্কুলের পুলাপানরে ওপেনলি লাইন ধইরা কির্মির ওষুধ খাওয়ানির বিপদ আছে। এইসব বিখাউজ ওষুদবিষুধ খাওয়ান লাগে বাসাবাড়িতে, গোপনে। ওষুধটা কীসের, জানলেই তো বমি কইরা ভাসায় দিব।’
কয়েকদিন আগে আরেকটা অনুষ্ঠানে আশফাককে নিয়ে গেছেন আবু ইউনুস- সেটা ছিল মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের আলোচনা। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের আরএমও মূল বক্তা; হাতে খবরের কাগজের স্বাস্থ্যবিধি পাতার একটা কাটিং। মঞ্চে বসা ইউএনও আশফাকের কানে কানে বিড়বিড় করলেন, “দেখছ, পুরাই চোথা ছাড়ল, একটা ওয়ার্ড নিজের থেকে এক্সটেমপোর কইতে পারল না। আর ডাক্তারের দাঁতের ছাতাডি দেখছ, মেডিকেলে পড়ার সময় শিউর গাঞ্জাড়ু আছিল।” মহিলা ডাক্তার অবশ্য কাগজপত্র না দেখেই বক্তব্য দিলেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা যখন কথা বলে, সবাইকে তা শুনে যেতে হয়। আবু ইউনুসও শুনলেন। তারপর সভাপতির বক্তৃতায় আগের বক্তাকে কোট করে বললেন- “মায়ের দুধ সংরক্ষণ করার যে উপায় ডাঃ কানিজ ফাতেমা আমাদের জানালেন, তাতে আমি আশাবাদী যে ভবিষ্যতে দেশের বাইরেও মাতৃদুগ্ধ রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা আমাদের আছে।”
মুখ নীচু করে কোলের উপর রাখা মুঠোফোনের বাটনে উদ্দেশ্যহীনভাবে টেপাটেপি করতে করতে সেদিন আশফাক ভেবেছে, এই লোক কি ক্ষেতলালে পোস্টিং পেয়ে এমন ক্ষ্যাত হয়ে গিয়েছিল, নাকি আরও আগে থেকেই এমন অবস্থা? এই চাকরি করতে করতে সে নিজেও কি এরকম আনস্মার্ট হয়ে যাবে, নাকি অলরেডি হয়ে গেছে?
.
চার.
তাহিয়াকে ফোন করবে কি করবে না- দিন সাতেক এই দোটানায় ভুগল আশফাক। তাহিয়ার মোবাইলের নাম্বারটা পাওয়া গেছে ক্যাডেটবন্ধু মামুনের সুবাদে, যে এখন কাজ করে ঢাকায় একটা বড় কর্পোরেট হাউজে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বিবিএ শেষ সেমিস্টারের ছাত্রী তাহিয়ার সঙ্গে মামুনের পরিচয় কতদিনের বা কীভাবে- সেসবের বিস্তারিত তার জানা নেই, বন্ধুও ভেঙে বলে নি। যেহেতু মামুনের স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে, এবং তাদের বিয়েটা শুধু সময়ের ব্যাপার, তাই তার ভাষ্যমতে অভাগা বন্ধুর একটা গতি করার মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই কাজটি করেছে সে। ‘গুডলুকিং অ্যান্ড স্মার্ট মেয়ে দোস্ত, বাট প্রাইভেট ইউনি হিসাবে সেইরকম ফাস্ট না’- বন্ধুর কথায় আগ্রহী ও আশ্বস্ত বোধ করেছে আশফাক। শুরুতে অস্বস্তি হলেও অপরিচয়ের বেড়া ডিঙিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে কথা গুছিয়ে আনতে পারল সে; তাহিয়ার কাছ থেকে ‘তুমি’ সম্বোধনের অনুরোধেও সাড়া দিয়ে ফেলল।
– আমার পোস্টিং আপাতত নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটা উপজেলা। তিতাসের পাড়ে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’- পড়েছ?
– ওহ, তাই নাকি? আমি তো জানতাম তিতাস একটা গ্যাসের নাম- তিতাস গ্যাস।
আশফাক একটু দমে যায়। উপন্যাস দূরে থাক, সিনেমাটার নামও শোনে নি তাহিয়া! এই মেয়ের জেনারেল নলেজের ডেপথ মোটেই সুবিধার না, কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসলে চাকরি পেতে মুশকিল হবে। ফোনের ওপাশ থেকে হাসির শব্দ তার দুশ্চিন্তার বেড়িবাঁধে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো ভেসে আসে।
– আমাকে অশিক্ষিত ভাবছেন, না? আরে বাবা, জাস্ট ঠাট্টা করলাম। ক্যারি অন প্লিজ!
– ওহো তাই বল। জানো, আমাদের এখানে তিতাসের তীরে অনেক পুরনো একটা জমিদারবাড়ি আছে। সবাই বলে বড়বাড়ি।
– বালিয়াটির রাজবাড়ি না প্রাসাদ কী যেন, ওটার মতো?
– আরও বড়। দেয়ালে পোড়ামাটির নকশা, একশটা রুম, বিশাল নাচঘর।
– ওয়াও, গ্রেট! আমার ফ্রেন্ডরা বালিয়াটি গিয়ে ছবি তুলে ফেইসবুক ফ্লাড করে দিচ্ছে, কী দারুণ জায়গা! উইশ আই কুড গো উইথ দেম।
– গেলে না কেন? ঢাকা থেকে কাছেই তো।
– আম্মু দিলেই তো! এখনও খুব প্রিমিটিভ এসব ব্যাপারে।
– প্রিমিটিভ না, বল প্রোটেকটিভ। প্র্যাকটিকালও। কতরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
– প্রোটেকটিভ কেন হবে? আমার ফ্রেন্ডরা কি ফালতু?
– একদম না! তবে আমার মনে হয়, ডিপেন্ডেবল কেউ সঙ্গে থাকলে উনি হয়ত আপত্তি করতেন না।
– ডিপেন্ডেবল মানে?
– সেটা তুমিই ভেবে দেখ, অচেনা জায়গায় বেড়াতে গিয়ে কোন বিপদ হল, এই ধর ছিনতাই… অথবা লোকাল লেভেলে কোন গণ্ডগোল, পলিটিকাল পার্টি অর হোয়াটএভার, ফেরার পথে দেখলে রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড। তখন হেল্প করতে পারবে এমন কেউ যদি সঙ্গে থাকে, সেটা অনেক রিল্যাক্সিং হবে না? ভেবে দেখ, তোমার চেনাজানাদের মধ্যে সেরকম কেউ আছে কি না।
– আমার কাছে ডিপেন্ডেবলের ডেফিনিশন কী জানেন?
– না বললে জানব কী করে? বল, প্লিজ।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর তাহিয়ার গাঢ় স্বর শোনা যায়- আ শোল্ডার টু ক্রাই অন…
আশফাকের বুকের ভেতর খুশির ঢেউ ফুঁসে ওঠে, তবে বাড়তি উচ্ছ্বাসটুকু চেপে রাখে তখনকার মতো। দেখা হওয়ার আগেই সিরিয়াস কমিটমেন্টে যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। তবে কোন একদিন তাহিয়াকে তিতাসের পাড়ে নির্জন জমিদারবাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেয়। নৌকায় চড়ে জলভ্রমণ হবে, সেখান থেকেই বড়বাড়ির ছবি তুলবে ওরা। তাহিয়া জানিয়েছে তার পছন্দ পালতোলা ছইওয়ালা নৌকা। বেড়ানোর বিষয়ে তাহিয়ার সব পরিকল্পনাতেই সায় দিয়ে যায় আশফাক। তিতাসপাড়ের বড়বাড়ি যে চল্লিশটি পরিবারের বেআইনি দখলে চলে গিয়ে যত্রতত্র সিমেন্টবালুর আস্তরণ আর টিনের বেড়ায় হতশ্রী একটা বস্তি হয়ে গেছে- সেই তথ্যটা তাহিয়াকে আপাতত না জানালেও চলবে।
হাইকোর্টে জলমহাল ইজারা নিয়ে একটা মামলার তারিখ পড়েছে। ক্যালেন্ডার বলছে সেদিন বুধবার। কাজ সেরে বৃহস্পতিবারেই স্টেশনে ফেরার কথা আশফাকের। মায়ের সঙ্গে দেখা করে শনিবার ফিরবে বলে বসকে বোঝাল সে। যদিও ভেতরে-ভেতরে অন্য পরিকল্পনা গুছিয়ে নিয়েছে- বৃহস্পতিবারে তাহিয়ার সঙ্গে দেখা করতেই হবে! শুক্রবারটাও হাতে রইল- গাজীপুর-মানিকগঞ্জ না হোক, দুজনে মিলে এয়ারপোর্ট বা সাভারের ধারেকাছে কোথাও বেড়িয়ে আসা যেতে পারে। তার মন বলছে, তাহিয়া রাজি হবে।
.
পাঁচ.
বুধবার দুপুরের মধ্যেই হাইকোর্টের কাজ ফুরিয়ে যাবে- ভাবাই যায় নি। নামমাত্র একটা শুনানি হয়ে আরেকটা তারিখ পড়তেই খুশি মনে সরকারি উকিলকে সঙ্গে নিয়ে ইস্কাটনের বিয়াম হোস্টেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে নিল আশফাক। হাইকোর্টের সামনে থেকে তাহিয়াকে একবার কল করেছিল, এখন নতুন কেনা মোবাইল সেটটা থেকে আরেকবার কথা বলে দেখা করার ব্যাপারটা নিশ্চিত করে ফেলল। তাহিয়ার ক্লাস শেষ হবে সাড়ে চারটায়, ওর সুবিধামতোই একটা লোকেশন বেছে নেয়া হলো, পাটভাঙা সরু স্ট্রাইপের শার্টটা বের করল আশফাক।
রেস্টুরেন্টের সামনে ফুটপাথে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ধবধবে সাদা সালোয়ার-কামিজ আর ফুরফুরে ওড়নার তাহিয়াকে চিনতে কোন অসুবিধা হলো না। হ্যান্ডব্যাগের স্ট্র্যাপটা আনমনে বাঁ হাতের কবজিতে প্যাঁচাচ্ছে, ফুটফুটে মুখের চারপাশ ছেয়ে যাচ্ছে গোছা গোছা গাঢ় বাদামী চুলে। চুলের রংটা ভীষণ মানিয়েছে ওকে, কুচকুচে কাল হলে যেন ফর্সা মুখটা এত সুন্দরভাবে ফুটত না! শেষ বিকেলের সোনালি রোদ লুকোচুরি খেলছে ওর চোখেমুখে, বাদামী চুলে।
দোতলা রেস্টুরেন্টের নীচতলায় বেভারেজ অ্যান্ড জুস বার। মেলন, পাপায়া আর পাইনঅ্যাপেল ক্রাশ থেকে আশফাক নিজের পছন্দে অর্ডার করল। নীচতলায় স্কুলকলেজের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের হৈ-হুল্লোড় বেশি, ওরা উঠে এল দোতলায়। আশফাক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল খাবার পছন্দের দায়িত্ব দেবে তাহিয়াকে- ও বেছে নিল পাস্তা আর স্টেক। এতে ভালই হলো- জানা গেল খাবার দিতে একটু সময় লাগবে।
একপাশের একটা নিরিবিলি টেবিল বেছে নিয়ে ওরা বসে। প্রথমে কিছুক্ষণ মুখোমুখি, তারপর তাহিয়া নিজে থেকেই চেয়ারটা উঠিয়ে আনে আশফাকের সমকোণে। ওয়েটার ছেলেটা বেতের ট্রেতে জুসের গ্লাস নিয়ে আসে। গ্লাসের মুখে ফুলকাটা লেবু, স্ট্র-র পাশে ঝুমকোলতার ফুলের মতো ছোট্ট একরত্তি জাপানি ছাতা। মুগ্ধ চোখে একনজর দেখে ‘সো কিউট!’- বলে তাতে ফুঁ দেয় তাহিয়া। ফুঁয়ের ভঙ্গিটা কেমন আদুরে! একটু লজ্জা পায় আশফাক। দেখা হলে তাহিয়াকে কী বলবে, কী নিয়ে গল্প করবে- এসব ভাবনাতেই কাটিয়েছে শেষ কয়েকটা দিন। আবু ইউনুসের কাণ্ডকীর্তির গল্প বলে তাহিয়াকে হাসাবে কিনা, সেটা নিয়ে বেশ খানিকটা ভেবে অবশেষে পরিকল্পনাটা বাদ দিয়েছে। মেয়েটা হয়ত ধরে নিতে পারে তার চাকরিটা ওরকম ক্ষ্যাতমার্কা লোকজনদের জন্যই। প্রথম দেখার পর তাহিয়া তাকে কী বলতে পারে, তার জবাব সে কীভাবে দেবে- এমন কিছু দৃশ্যও কল্পনা করেছে। তবে বাস্তবে যা ঘটে চলেছে তা কল্পনাকেও ছাপিয়ে অনেক বেশি সুন্দর। এইসব ছোটখাট অনুষঙ্গের মাধুর্যের সম্ভাবনা তার মাথাতেই আসে নি। আশফাকের ভাবনা থমকে দিয়ে হাতব্যাগটা খুলে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তাহিয়া।
– ইয়াল্লা, সেলফোনাটা ফেলে আসছি। হায় হায় এখন…
– ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন, কোথায় রেখে এসেছ, বাসায়?
– না না, ইউনিতে, ক্লাসের ডেস্কে মনে হয়। আমার ফ্রেন্ডরা এখনো ক্যাম্পাসে আছে, ওদের বললে সামলে রাখবে। বাট প্রবলেম হবে যদি আম্মু কল দিয়ে না পায়। কী যে করি এখন!
– এটা কোন সমস্যা হলো, ফ্রেন্ডদের কারো নাম্বার মনে করে দেখ! আর বাসায় আম্মুকে একটা কল দিয়ে জানাও ব্যাপারটা, আম্মু মাস্ট বি ওরিড। নাও, আহা তুমি হেজিটেট করছ কেন, নাও তো শিগগির!
– সো নাইস অফ ইউ… এক মিনিট, আমি এক্ষুণি আসছি!
সাদা জামা-ওড়নায় একটা ঘূর্ণি তুলে, থাকথাক করে কাটা চুল ঝাঁকিয়ে, তাহিয়া ঝটপট সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। একটা সাদা পরী উড়ে গেল যেন। এইমাত্র শেষ হওয়া কথোপকথনে নিজের সংলাপের পারফরম্যান্সে আশফাক সন্তুষ্ট বোধ করে। তাহিয়ার আম্মুকে ‘আন্টি’ না বলে ‘আম্মু’ই বলেছে। এইসব খুঁটিনাটি আন্তরিকতা মেয়েরা খুব টের পায়। তাহিয়া মেয়েটা বেশ স্মার্ট, ছটফটেও; কিন্তু কোথাও যেন একটা সরলতা আলতোভাবে ছুঁয়ে থাকে ওকে। টেনশন লুকিয়ে রাখতে পারে না একদম, মোবাইল ফেলে এসেছে বুঝতে পেরে নীচের ঠোঁটটা কামড়াচ্ছিল বারবার।
তাহিয়া কি নাম্বার মনে করতে পারছে না? নাকি কল করে কাউকে পাচ্ছে না? একবার নীচতলায় নেমে গিয়ে দেখবে কি না- ভাবতেই দেখে কাউন্টারের ওপরের ডিসপ্লেতে ওর টোকেন নাম্বার জ্বলজ্বল করছে। খাবার রেডি হয়ে গেছে, নিয়ে আসতে হবে। ট্রে-টা এনে টেবিলে রাখতেই তাহিয়ার ছোট ব্যাগটা চোখে পড়ে আশফাকের। আলগোছে একবার স্পর্শ করে সেটাকে। খুব ইচ্ছে করে একবার খুলে দেখে ব্যাগের ভেতর কী আছে। নিজেকে দমায় আশফাক- ধরা পড়ে গেলে খুব বাজে ব্যাপার হবে। এসব ব্যাপারে মেয়েরা ভীষণ সেনসিটিভ।
তাহিয়া ফিরে আসার আগেই ওয়েটার ছেলেটা জুসের গ্লাস ফেরত নিতে আসে। আশফাক দু-তিন চুমুক দিলেও তাহিয়ার গ্লাসটা এখনও ধরা হয় নি। এখনই নিতে মানা করবে, নাকি এই রেস্টুরেন্টে খাবার চলে আসার পর ড্রিঙ্কসের গ্লাস সরিয়ে নেয়ার কোন নিয়ম আছে- বুঝে উঠতে পারে না আশফাক। ছেলেটাই বরং প্রশ্ন করে তাকে।
– স্যার, খাবারটা কি প্যাক করে দেব?
– না না তা কেন, আমার সঙ্গে আরেকজন আছে, নীচতলায় গেছে।
– ম্যাডাম তো নীচের ফ্লোরে নেই, উনি তখনই চলে গেছেন।
– তখনই চলে গেছে মানে? নীচে একটা কল করতে গেছে, এই যে ওর ব্যাগ, এক্ষুণি চলে আসবে!
– আসলে ম্যাডাম নীচের ফ্লোরে নেমেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেছেন, একটা সিএনজি নিয়ে চলে গেছেন। আমি ঠিকই দেখেছি, সাদা ড্রেস পরা, হাতে শুধু একটা মোবাইল ফোন ছিল… … কিছু মনে করবেন না স্যার, মোবাইলটার দাম কত ছিল? না মানে আমরা এমন ঘটনা আগেও দেখেছি… ফুড ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, আপনি বরং খেয়ে নেন স্যার…
তাহিয়ার হ্যান্ডব্যাগে ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ছোট্ট একটুকরো ক্যাশমেমো ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না।
দুজনের জুসের গ্লাস আর খাবারের ট্রের সামনে বসে আশফাক মাহমুদের মনে হলো- তার বস আবু ইউনুস না, সে নিজেই আসলে একটা ক্ষ্যাত। জলজ্যান্ত চরম ক্ষ্যাত!