গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করন।
আগন্তুক চায়ের কাপে শেষ চুকুম দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখতেই ঘরে আরেকজন পুরুষ এসে ঢুকলেন। ইনি মোহিতের অন্তরঙ্গ বন্ধু বাণীকান্ত সেন। আরো দুজন আসার কথা আছে, তারপর তাসের আড্ডা বসবে। এটা রোজকার ঘটনা। বাণীকান্ত ঘরে ঢুকেই যে আগন্তুকের দিকে একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিলেন সেটা মোহিতের দৃষ্টি এড়াল না। আগন্তুকের সঙ্গে বন্ধুর পরিচয়ের ব্যাপারটা মোহিত অম্লান বদনে এড়িয়ে গেলেন।
‘আচ্ছা, তাহলে আসি…’ আগন্তুক উঠে দাঁড়িয়েছেন। ‘তুই এই উপকারটা করলে সত্যিই গ্রেটফুল থাকব ভাই, সত্যিই।’
ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার পর মুহূর্তেই বাণীকান্ত বন্ধুর দিকে ফিরে ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, ‘এই লোক তোমাকে তুই করে বলছে— ব্যাপারটা কী?’
‘এতক্ষণ তুমি বলছিল, শেষে তোমাকে শুনিয়ে হঠাৎ তুই বলল।’
‘লোকটা কে?’
মোহিত উত্তর না দিয়ে বুকশেল্ফ থেকে একটা পুরনো ফোটো অ্যালবাম বার করে তার একটা পাতা খুলে বাণীকান্তর দিকে এগিয়ে দিল।
‘একি তোমার ইস্কুলের গ্রুপ নাকি?’
‘বোট্যানিক্সে পিকনিকে গিয়েছিলাম,’ বললেন মোহিত সরকার।
‘কারা এই পাঁচজন?’
‘আমাকে চিনতে পারছ না?’
‘দাঁড়াও, দেখি।’
অ্যালবামের পাতাটাকে চোখের কাছে নিয়ে বাণীকান্ত সহজেই তাঁর বন্ধুকে চিনে ফেললেন।
‘এবার আমার ডানপাশের ছেলেটিকে দেখ তো ভালো করে।’
ছবিটাকে আরো চোখের কাছে এনে বাণীকান্ত বললেন, ‘দেখলাম।’
মোহিত বললেন, ‘ইনি হচ্ছেন যিনি এইমাত্র উঠে গেলেন।’
‘ইস্কুল থেকেই কি জুয়া ধরেছিলেন নাকি?’—অ্যালবামটা সশব্দে বন্ধ করে পাশের সোফায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করলেন বাণীকান্ত। —’ভদ্রলোককে অন্তত বত্রিশবার দেখেছি রেসের মাঠে।’
‘সেটাই স্বাভাবিক’, বললেন মোহিত সরকার। তারপর আগন্তুকের সঙ্গে কী কথা হলো সেটা সংক্ষেপে বললেন।
‘পুলিশে খবর দে’, বললেন বাণীকান্ত, ‘চোর জোচ্চোর জালিয়াতের ডিপো হয়েছে কলকাতা শহর। এই ছবির ছেলে আর ওই জুয়াড়ি এক লোক হওয়া ইম্পসিবল।’
মোহিত হালকা হাসি হেসে বললেন, ‘রোববার এসে আমাকে না পেলেই ব্যাপারটা বুঝবে। তারপর আর উৎপাত করবে বলে মনে হয় না।’
বারুইপুরে বন্ধুর পুকুরের মাছ, পোলট্রির মুরগির ডিম, আর গাছের আম জাম ডাব পেয়ারা খেয়ে, বুকল গাছের ছায়ায় সতরঞ্চি পেতে বুকে বালিশ নিয়ে তাস খেলে শরীর ও মনের অবসাদ দূর করে রবিবার রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে মোহিত সরকার বিপিন বেয়ারার কাছে শুনছেন যে সেদিন যে ভদ্রলোকটি এসেছিলেন তিনি আজ সকালে আবার এসেছিলেন।—’যাবার সময় কিছু বলে গেছেন কি?’
‘আজ্ঞে না,’ বলল বিপিন।
যাক্, নিশ্চিন্ত! একটা সামান্য কৌশল, কিন্তু তাতে কাজ দিয়েছে অনেক। আর আসবে না। আপদ গেছে।
কিন্তু না। আপদ সেদিনের জন্য গেলেও পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ মোহিত যখন বৈঠকখানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, তখন বিপিন আবার একটি ভাঁজ করা চিরকুট এনে দিল তাঁকে। মোহিত খুলে দেখলেন তিন লাইনের একটি চিঠি।
ভাই মোহিত,
আমার ডান পা-টা মচকেছে, তাই ছেলেকে পাঠাচ্ছি। সাহায্যস্বরূপ সামান্য কিছুও এর হাতে দিলে অশেষ উপকার হবে। আশা করি হতাশ করবে না।—
ইতি জয়
মোহিত বুঝলেন এবার আর রেহাই নেই। তবে সামান্য মানে সামান্যই, এই স্থির করে তিনি বেয়ারাকে বললেন, ‘ডাক ছেলেটিকে।’
মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি তেরো-চোদ্দ বছর বয়সের ছেলে দরজা দিয়ে ঢুকে মোহিতের দিকে এগিয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করে আবার কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মোহিত তার দিকে মিনিট খানেক চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘বোস।’
ছেলেটি একটু ইতস্তত ভাব করে একটি সোফার এক কোণে হাত দুটোকে কোলের ওপর জড়ো করে বসল।
‘আমি আসছি এক্ষুনি।’
মোহিত দোতলায় গিয়ে স্ত্রীর আঁচল থেকে চাবির গোছাটা খুলে নিয়ে আলমারি খুলে দেরাজ থেকে চারটে পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে একটা খামে পুরে আলমারি বন্ধ করে আবার নিচের বৈঠকখানায় ফিরে এলেন।
‘কী নাম তোমার?’
‘শ্রী সঞ্জয়কুমার বোস।’
‘এতে টাকা আছে। সাবধানে নিতে পারবে?’
ছেলেটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
‘কোথায় নেবে?’
‘বুক পকেটে।’
‘ট্রামে ফিরবে, না বাসে?’
‘হেঁটে।’
‘হেঁটে? কোথায় বাড়ি তোমার?’
‘মির্জাপুর স্ট্রিট।’
‘এত দূর হাঁটবে?’
‘বাবা বলেছেন হেঁটে ফিরতে।’
‘তার চেয়ে এক কাজ করো। ঘণ্টাখানেক বোস, চা-মিষ্টি খাও, অনেক বইটই আছে, দেখো—আমি নটায় অফিসে যাব, আমায় নামিয়ে দিয়ে আমার গাড়ি তোমার বাড়ি পৌঁছে দেবে। তুমি বাড়ি চিনিয়ে দিতে পারবে তো?’
ছেলেটি আবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
মোহিত বিপিনকে ডেকে ছেলেটির জন্য চা দিতে বলে আপিসে যাবার জন্য তৈরি হতে দোতলায় রওনা হলেন।
ভারি হালকা বোধ করছেন তিনি, ভারি প্রসন্ন।
জয়কে দেখে না চিনলেও তিনি তার ছেলে সঞ্জয়ের মধ্যে তাঁর ত্রিশ বছর আগের ক্লাস ফ্রেন্ডটিকে ফিরে পেয়েছেন।