১।
মন্দিরের এই দিকটা অর্নির ভীষণ প্রিয়। কিছুটা নিরিবিলি আবার গাছ পালারও কমতি নেই। তবে সমস্যাটা হয় বিকেলের দিকে। ছোট ছেলেরা খেলতে আসে পাশের মাঠটাতে, ভীষণ হৈ চৈ করে। অবশ্য নিশু বলে এই হৈ চৈ দেখতে ভীষণ ভাল লাগে তার। অর্নির যে খুব খারাপ লাগে তাও কিন্তু না। তবে নিশুর সাথে একা সময় কাটাতে ভালবাসে অর্নি।
আচ্ছা, নিশু আজ কোন জামাটা পড়বে? তার সুন্দর চোখে কাজল মাখাবে?
নিশুর কাজল দেয়া চোখ দুটো দেখলে অর্নির কেন যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এত সুন্দর চোখ কারো হয় কিভাবে?
তবে নিশুর একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। নিশুর কেন যেন ধারণা ওর চোখ গুলো আসলে কাকের চোখ। অর্নি ভেবে পায় না, এই অদ্ভুত ধারণা নিশুর মাথায় এল কিভাবে?
অবশ্য অর্নি খেয়াল করেছে, নিশুর মাঝে কাক নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা আছে। যদিও অর্নির ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ না।
“কি ভাবছো এত?”, নিশুর কথায় চমকে তাকায় অর্নি। মেয়েটাকে কালো শাড়িতে কি ভীষণ সুন্দর লাগছে। ঠিক যেন পরী, অর্নির পরী।
>কি হলো? এভাবে কি দেখছ?
>আচ্ছা নিশু তুমি কি জানো, কালো শাড়ি তে তোমাকে ঠিক কতটা সুন্দর লাগে?
>হু…জানি।
>তা আর কি কি জানো?
>আমি আরো জানি কেন আমায় কাল শাড়িতে এত ভাল মানায়, বলব?
“বলুন মহারাণী…”বলে অর্নি নিজেই হেসে ফেলে।
>কারণ কাকের রং কালো!
>এটা আবার কেমন কথা?
“সত্যি বলছি…”,নিশু কথাটা শেষ করতে পারে না। অর্নি বিরক্ত স্বরে বলেয় বসে, “দেখো নিশু, তোমার এই উল্টা পাল্টা কথা গুলো শুনতে মাঝে মাঝে সত্যিই বিরক্ত লাগে।”
>না অর্নি! বিশ্বাস করো সত্যি বলছি।
>নিশু আমার ভাল লাগছে না, চলো উঠি।
>তুমি আমাকে বিশ্বাস না করলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় অর্নি।
>প্লীজ নিশু, আমি গেলাম….
বলে অর্নি চলে যায় নিশুকে একা ফেলে। আসলে নিশু মেয়েটা এমনিতে খুব লক্ষ্মী। কেমন যেন শান্ত, একটু বেশিই স্নিগ্ধ। যান্ত্রিক শহরের রুক্ষতায় ঠিক যেন মানায় না ওকে। কিন্তু কোথায় যেন এক ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে ওর মাঝে। অর্নি যদিও ভীষণ ভালবাসে নিশুকে কিন্তু কিছুতেই মানতে পারে না ব্যপারটা।
২।
ফোনটা বাজছে অনেকক্ষন, নিশু ফোন করছে। কিন্তু অর্নির ভীষণ রাগ হচ্ছে, সাথে মায়াও হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রিসিভ করল,
>হ্যালো
>অর্নি, তুমি কি রাগ করেছো?
>প্লীজ নিশু, আমার ভাল লাগছে না।
>আচ্ছা থাক। আমি বরং তোমাকে একটা গল্প বলি।
>সত্যি বলছি, আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে করছে না।
>গল্পটা একবার শোন। কথা দিচ্ছি, আর কখনো এমন কিছু করব না যেটা তে তুমি বিরক্ত হও।
>ঠিকাছে বলো।
>আমি জানি গল্পটা শোনলে তোমার সব রাগ চলে যাবে।
>আচ্ছা, বলো…
>গল্পটা ক্রুভিয়াসের।
>এটা আবার কেমন নাম!
>আগে শোনে তো দেখো?
নিশু গল্প বলছে….
ক্রুভিয়াস, কাক দেবতার একমাত্র ছেলে। স্বর্গে বাস তার। কিন্তু স্বর্গ থেকে পৃথিবী তাকে মুগ্ধ করতো বেশি। সে প্রায়ই পৃথিবীতে চলে আসতো কাকের বেশে। যদিও কাকের দেবতা এক মাত্র সন্তান ক্রুভিয়াসের এই সব খাম খেয়ালিপনা পছন্দ করতেন না একদম ই। কিন্তু ক্রুভিয়াসের এই বাধা ধরা জীবন অসহ্য লাগত।
একদিনের কথা, ক্রুভিয়াস লুকিয়ে পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছে।
সে দেখল এক মেয়ে বসে আছে মাঠের এক প্রান্তে। কি মনে করে ক্রুভিয়াস গেল তার কাছে। কাছে এসে সে বুঝতে পারল মেয়েটা কাঁদছে।
ক্রুভিয়াসের কেন যেন মায়া হয় মেয়েটার জন্যে। সে তার রূপ পাল্টে মেয়েটার কাছে যায়। কথা বলে তার সাথে। বন্ধুত্ব হয় তাদের।
আসলে মেয়েটা ছিল জন্মান্ধ। অন্ধ ছিল বলে তার কোন বন্ধু ছিল না। একাকিত্ব, একই সাথে এই অন্ধত্ব; ভীষণ কষ্ট দিত তাকে। তাই সে একা এই মাঠের প্রান্তে বসে কাঁদত।
তারপর একদিনকার কথা, ক্রুভিয়াস এবং অন্ধ মেয়েটির তখন ভীষণ বন্ধুত্ব। হঠাত্ কাকের দেবতা এই বন্ধুত্বের কথা জানতে পারলেন এবং ক্রুভিয়াস কে এই কাজের জন্য শাস্তিদন্ড দিলেন। বিধান হল, ক্রুভিয়াস বাকি জীবন বন্দি দশায় কাটাবে। ঘোষনা শুনে ক্রুভিয়াস শেষ বারের মত প্রাণের বন্ধুর সাথে দেখা করতে এলো। বলল, “আমাদের হয়তো আর কখনোই কথা হবে না। আমি তাই তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। বলো কি চাও?”
মেয়েটি বলল, “আমি শুধু একটাবার তোমায় দেখতে চাই। আর কিছু না।”
ক্রুভিয়াস বলল, “তবে তাই হোক।”
ক্রুভিয়াস অন্ধ মেয়েটাকে তার চোখ দুটো দান করে নিজে অন্ধত্ব বরণ করল সারাজীবনের জন্য।
কিন্তু কাক দেবতা ছেলের এমন কাজে রেগে নতুন দন্ড দিলেন। ক্রুভিয়াসকে স্বর্গ হতে বিতাড়িত করা হল।
স্বর্গ বিতাড়িত অসহায় অন্ধ ক্রুভিয়াস আবার ফিরে এল সেই চিরচেনা বন্ধুর কাছে। মেয়েটি বন্ধু ক্রুভিয়াসকে তাদের বাড়ির পাশে এক গাছে ঘর বেধে দিল। এরপর থেকে দুই বন্ধু এক সাথে থাকে। জানো অর্নি?
ক্রুভিয়াস এখনো বেঁচে আছে। আর মেয়েটার চোখ দুটো বংশানুক্রমে এখনো সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে তাদের অসাধারণ বন্ধুত্বের।
>গল্পটা সুন্দর কিন্তু শেষের কথা গুলো মানতে পারছি না।
>কোন কথা?
>এই যে বললে, ক্রুভিয়াস এখনো বেঁচে আছে। তার চোখ গুলো এখনো বংশানুক্রমে তাদের বন্ধুত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই সব….
>এক দিন তুমিও বিশ্বাস করবে।
>নিশু, তুমি আবার শুরু করেছো।
>ঠিক আছে, আমি আর কিছু বলছি না। খুশি?
>খুশি, অনেক খুশি….
৩।
অর্নির সংসারটা ভীষণ গোছানো আর ছিমছাম। হবে নাই বা কেন?
সংসারে মাত্র ২ জন মানুষ। অর্নি এবং রথি; যদিও আরেক জনের থাকার কথা ছিল এই সংসারে! মানুষটা আর কেউ না; নিশু, অর্নির পরী।
নিশু মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। আর অর্নির কাছে রেখে গেছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার রথি, অর্নির ছোট পরীটা।
>রথি, কি করছ মামণি?
>এই তো বাবা, ছবি আঁকছি।
>আগে নাশতাটা শেষ করে নাও মা, স্কুলের দেরি হয়ে যাবে তো।
>আচ্ছা বাবা।
নিশু এবং অর্নির এক মাত্র মেয়ে রথি। দেখতে অবিকল মায়ের মত হয়েছে মেয়েটা, বিশেষ করে চোখ দুটো। এত অদ্ভুত মিল কিভাবে সম্ভব অর্নি মাঝে মাঝে ভেবে পায় না।
নিশুর কথা মনে হতেই চোখে জল চলে আসে অর্নির। কেমন আছো নিশু ঐ দূর অজানায়?
“বাবা,” রথির ডাকে হুশ ফেরে অর্নির।
>বলো মামণি,
“আমার বন্ধুর ছবি দেখবে?”,বলতে বলতে রথি ছবিটা এগিয়ে দেয় অর্নিকে। ছবিতে অর্নি দেখে একটা কাক আঁকা।
>এটা তো একটা কাকের ছবি!
>ও ক্রুভিয়াস, আমার বন্ধু। জানালার পাশে ঐ গাছটা আছে না? ওটাতে থাকে সে।
হঠাত্ অর্নির কি যেন মনে পড়ে যায়, নিশুর বলা শেষ গল্পটা…