শুধুমাত্র দু’জন আমেরিকান হোটেলটিতে ঠাঁই নিয়েছিল। নিজেদের কক্ষে আসা-যাওয়ার সময় সিঁড়িতে যত লোকজনের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটছিলো তাদের কাউকেই তারা এর আগে দেখেনি। কক্ষটি ছিল দ্বিতীয় তলায়- সমুদ্রমুখী। অন্য এক মুখ ছিল সাধারণ বাগান ও যুদ্ধভাস্কর্যের দিকে। বাগানজুড়ে ছিল লম্বা লম্বা পামগাছ আর সবুজ রঙের বেঞ্চ।
আবহাওয়া ভাল থাকলে ওখানে সবসময় একজন শিল্পীকে আঁকার জিনিসপত্র নিয়ে দেখা যায়। শিল্পীরা পছন্দ করত সমুদ্রমুখী এই রঙচঙে হোটেল আর যেভাবে পামগাছগুলো বড় হয়ে উঠছিল তার দৃশ্য। ইটালিয়ানরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যুদ্ধভাস্কর্যটি দেখতে আসতো। এটা ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি, ফলে বৃষ্টির দিনে চকচক করত।
তখন বৃষ্টি হচ্ছিলো। পামগাছ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছিল বৃষ্টি। কাঁকর বিছানো পথের গর্তগুলো ভরে উঠেছিল জলে। বৃষ্টির দিনে সমুদ্রের স্রোত বেশ খানিকটা ডাঙায় উঠে আসে, আবার ফিরে যায় আপনমনে। স্মৃতিস্তম্ভের কাছের স্কয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো চলে গিয়েছিল। স্কয়ারের ওপাশে ক্যাফের দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে একজন ওয়েটার খালি স্কয়ারের দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমেরিকান মহিলা জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাইরে, ঠিক তাদের জানালার নিচে, বৃষ্টি চুঁইয়ে পড়া এক টেবিলের নিচে জড়সড় হয়ে বসে ছিল একটি বেড়াল। বেড়ালটি নিজেকে গুটিয়ে কোনো রকমে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিল।
‘আমি নিচে যাচ্ছি, বেড়ালটিকে আনতে।’ আমেরিকান মহিলা বললো।
‘আমি যাবো।’ বিছানায় থেকে তার স্বামী প্রস্তাব করলো।
‘না। আমিই আনছি। বেচারা টেবিলের তলে আশ্রয় নিয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।’
স্বামী বিছানায় আরামে পা ছড়িয়ে তার বইপড়া চালিয়ে যেতে লাগলো।
‘ভিজে যেওনা যেন।’ সে বলল।
মহিলা নিচতলায় নেমে গেল। তাকে দেখে হোটেলমালিক মাথাটা নিচু করে ভদ্রতা প্রকাশ করলো। অফিসের বেশ খানিকটা দূরের এক কোণায় ছিল তার বসার টেবিল। সে ছিল বেশ লম্বা-বয়স্ক লোক।
‘বৃষ্টি হচ্ছে।’ মহিলা বলল। হোটেলমালিককে তার বেশ মনে ধরেছিল।
‘হ্যাঁ। বেশ বাজে আবহাওয়া আজ।’
হালকা আলোকময় কক্ষে সে তার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। মহিলা তাকে পছন্দ করেছিল। পছন্দ করেছিল তার সিরিয়াসলি প্রতিটা অভিযোগ শোনার স্বভাবকে। সে তার আত্মসম্মানবোধকে পছন্দ করেছিল। পছন্দ করেছিল সে তাকে যেভাবে সাহায্য করতে আসত তার ধরনকে। সে পছন্দ করেছিল হোটেলকিপার হয়ে তার উপস্থাপন ভঙ্গিমাকে। সে পছন্দ করেছিল তার বয়স্ক-পরিপক্ক মুখমণ্ডল ও বড় বড় পুরুষালি হাত দুটোকে।
মহিলা দরজা খুলে বাইরে তাকালো। বৃষ্টি আরো বেড়ে চলেছে। রাবারটুপি পরিহিত একজন লোক খালি স্কয়ার পেরিয়ে ক্যাফের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিড়ালটি হয়ত বাম দিকে আছে। সে দরজার মুখে পা রাখা মাত্র পেছন থেকে কে যেন মাথায় ছাতা খুলে দাঁড়াল। সে ছিল তাদের কক্ষের দেখভালের দায়িত্বে থাকা বালিকাটি।
‘আপনার বৃষ্টিতে যাওয়া উচিত হবে না।’ মৃদু হেসে ইটালি ভাষায় বলল সে। অবশ্যই হোটেলকিপার তাকে পাঠিয়েছে।
বালিকাটি মাথার ওপর ছাতা ধরা অবস্থায় আমেরিকার মহিলা কাঁকর বিছানো পথ ধরে ঐ জানালার নিচে গেল। টেবিলটি সেখানেই ছিল- বৃষ্টিতে ধুয়ে আরো সবুজ-সতেজ লাগছিল। তবে বিড়ালটিকে আর সেখানে দেখা গেল না। সহসা সে খুব বিষণ্ন হয়ে পড়লো। সেবায় নিয়োজিত মেয়েটি তার দিকে তাকালো।
‘আপনি কি কিছু হারিয়েছেন, ম্যাডাম?’
‘এখানে একটি বেড়াল ছিল।’ ঐ আমেরিকান তরুণী বলল।
‘বিড়াল?’ বালিকাটি হেসে ফেলল। ‘বৃষ্টির মাঝে বিড়াল?’
‘হ্যাঁ।’ সে বলল। ‘ঐ টেবিলের নিচে। আমি খুব করে ওটা চেয়েছিলাম। আমি একটা কিটি (বেড়ালছানার আদুরে নাম) চেয়েছিলাম।’ সে যখন ইংরেজিতে এসব কথা বলছিল, তখন ঐ বালিকার মুখ শক্ত হয়ে এঁটে এলো।
‘আসুন ম্যাডাম।’ সে বলল। ‘আমাদের অবশ্যই ভেতরে ফিরে যাওয়া উচিত। আপনি ভিজে যাবেন।’
‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।’ আমেরিকান নারী বলল।
কাঁকরবিছানো পথ ধরে তারা ফিরে এলো। সে ভেতরে চলে গেলো; সেবাই নিয়োজিত বালিকাটি দরজার বাইরে দাঁড়ালো ছাতাটা বন্ধ করার জন্য। আমেরিকান মেয়েটি অফিসের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দেখে হোটেল-কিপার ডেস্ক থেকে আবারো মাথা ঝাঁকালো। আমেরিকান মেয়েটির ভেতরে কি জন্যে যেন খুব সামান্য এবং টনটনে অনুভূতি হল। হোটেলকিপারের এমন আচরণে তার নিজেকে খুব ছোট আবার একইসাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল। ক্ষণিক সময়ের জন্য তার নিজের কাছে নিজেকে খুব বিশেষ কিছু মনে হল। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। কক্ষের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। জর্জ বিছানায় পড়ে ছিল- পড়ছিল।
‘বিড়ালটি পেলে?’ সে বইটি নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘না। চলে গেছে।’
‘এত তাড়াতাড়ি গেল কোথায়!’ পড়া থেকে চোখকে আরাম দিয়ে সে বলল।
‘আমি ওটা খুব করে চেয়েছিলাম।’ সে বলল। ‘জানি না কেন ওমন করে চেয়েছিলাম। আমি ঐ বেচারা কিটিকে চাই। বৃষ্টির ভেতর ওভাবে ভেজাটা তার জন্যে মজার কিছু ছিল না নিশ্চয়!’
জর্জ আবারও পড়ছিল। সে উঠে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। হাত আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো। সে নিজের চেহারা পড়ছিল- একবার ডান দিক থেকে, একবার বামদিক থেকে। এরপর সে তার কাঁধ ও কাঁধের ওপাশ পরখ করে দেখছিল।
‘তোমার কি মনে হয়? এটা খুব ভাল হবে না, যদি আমি আমার চুলগুলো বেড়ে উঠতে দিই?’ সে জিজ্ঞেস করলো এবং নিজেকে আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো।
জর্জ মুখ তুলে দেখলো এবং তার কাঁধের দিকে তাকাল। তাকে ছেলেদের মতো দেখাচ্ছিল।
‘যেমন আছে তেমনই আমার পছন্দ।’
‘আমি এভাবে খুব হাঁপিয়ে উঠেছি।’ সে বলল। ‘এভাবে নিজেকে ছেলেদের মতো দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’
জর্জ বিছানায় উল্টো দিকে ঘুরলো।
‘তোমাকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে।’ সে বলল।
সে তার হাতের আয়না ড্রেসিংটেবিলে রেখে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরের দিকে তাকালো। বাইরে তখন দ্রুত আঁধার নেমে আসছিল।
‘আমি আমার চুল বড় করে তুলতে চাই। পেছনে বড় ঝুঁটি বাঁধবো যাতে আমি সেটা অনুভব করতে পারি।’ সে বলে চলেছিল। ‘আমি একটা কিটি চাই। সে আমার কোলে বসে থাকবে; আমি যখন তাকে থাবা দেবো সে তখন আরামে বাচ্চাদের মতো মি-মি করবে।’
‘তাই?’ জর্জ বিছানা থেকে বলল।
‘আমি টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জিত করে খেতে চাই। আমি চাই শরৎ আসুক। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে চাই। আমি একটি বেড়ালছানা চাই। আর কিছু নতুন পোশাক চাই।’
‘কি লাগালে- থামবে তুমি? আমাকে একটু পড়তে দাও।’ জর্জ চেঁচিয়ে ওঠে। সে আবারও পড়তে শুরু করলো।
তার স্ত্রী জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। এখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। পামবনে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল।
‘যাই বলো, আমি একটি বিড়াল চাই।’ সে বলল। ‘আমি একটি বেড়াল চাই। আমি একটি বেড়াল চাই, এক্ষুণিই। যদি আমি আমার চুল বড় করতে না পারি, আর কোনো মজা না করতে পারি, তাহলে আমি অন্তত একটা বেড়াল তো পেতে পারি।’
জর্জ আর শুনছিল না। সে তার বইয়ের মধ্যেই বুঁদ হয়ে পড়ে ছিল। তার স্ত্রী জানালায় দাঁড়িয়ে খালি স্কয়ার আলোকিত হয়ে ওঠার দৃশ্যটি দেখছিল।
কেউ একজন দরজায় টোকা দিল।
‘আসছি।’ জর্জ তার বই থেকে মুখ তুলে বলল।
দরজার গোড়ায় ঐ বালিকা দাঁড়িয়ে ছিল। সে তার হাতে বড়সড় এক বেড়াল ধরেছিল।
‘কিছু মনে করবেন না।’ সে বলল। ‘মালিক এটা ম্যাডামের জন্য পাঠিয়েছেন।’
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।