কে আগে শূলে যাইবে

গুরু-শিষ্য নানা দেশে ঘুরিয়া বেড়ায়।ঘুরিতে ঘুরিতে তাহারা এক নূতন দেশে আসিল।গুরু শিষ্যকে চার খানা পয়সা দিয়া বাজার করিতে পাঠাইল।

কিছুক্ষণ পরে মুটের মাথায় এক প্রকাণ্ড বোঝা চাপাইয়া
শিষ্য আসিয়া উপতিত।সেই বোঝার মধ্যে চাল, দাল,ঘি,তেল,মাছ, মাংশ,সন্দেশ,রসগোল্লা আরও কত কি?
গুরু আশ্চয হইয়া শিষ্য কে জিজ্ঞাসা করিল।“মাত্র চার আনার বাজার করিতে দিয়াছিলাম,এত জিনিস কি করিয়া কিনিলে,
শিষ্য উত্তর করিল,“গুরু ঠাকুর!বলিব কি?এদেশের সব জিনিসের দাম দু’পয়সা সের,আবার ঘি,মাখন সন্দেশ,রসগোল্লার দামও দু’পয়সা সের।সঙ্গে যে মুটে আনিলাম মাত্র দু’পয়সা দিতে হইবে,”
গুরু বলিল শিগগির রান্না কর।রান্না হইলে খাইয়া-দাইয়া গুরু শিষ্যকে হুকুম করিল,“তাড়াতাড়ি কাপড়-বোকচা বাঁধ।এখন এদেশ ছাড়িয়া যাইতে হবে।”শিষ্য অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,কেন গুরু ঠাকুর?”গুরু ঠাকুর বলিল।“যে দেশে সব জিনিসের এক এক দর সেখানে পণ্ডিত-মূর্খের কোন তফাত নাই।চল, এ দেশ ছাড়িয়া এখনি চলিয়া যাই।
শিষ্য উত্তর করিল “এমন সোনার দেশ আর কোথাও পাওয়া যাবে না।সব জিনিসের দাম এত সস্তা।আপনি যাইবেন তো যান।আমি এদেশ ছাড়িয়া কোথাও যাইব না।
এখানে কিছুদিন সন্দেশ রসগোল্লা খাইয়া শরীর তাজা করিয়া লই।আপনার কাপড় বোকচা বহিতে বহিতে শরীর আমার কাহিল হইয়া গিয়াছে।আর আমি আপনার সঙ্গে থাকিব না।”
গুরু কত করিয়া বুঝাইল।কিন্তু গুরুর সঙ্গে গেলে শিষ্যর কি লাভ।এমন সস্তা সন্দেশ,রসগোল্লাড় দেশ ছাড়িয়া সে স্বর্গেও যাইবে না।
অগত্যা গুরু একাই চলিয়া গেল।শিষ্য রোজ বাজার করিয়া ঘি,দুধ,মাছ,মাংশ,সন্দেশ,রসগোল্লা খাই।অল্প দিনেই তাহার শরীর বেশ নাদুস-নুদুস হইয়া উঠিল।
এদিকে হইয়াছে কি? সেই দেশের এক চোর গেরস্ত বাড়িতে চুরি করিতে যাইয়া দেয়াল চাপা পড়িয়া মারা ফেল।চোরের বউ রাজার কাছেযাইয়া নালিশ করিল,“ রাজা মহাশয়!অমুকের বাড়ি দেয়াল চাপা পড়িয়া আমার স্বামী মারাগিয়াছে।আপনি ইহার বিচার করুন।”
রাজা তখন সেই গেরস্ত কে ডাকিয়া পাঠাইলেন।গেরস্ত আসিলে রাজা বলিলেন,“তোমার দেয়াল চাপা পড়িয়া চোর মারা গিয়াছে।আমি তোমাকে শূলে যাওয়ার হুকুম দিলাম।সূল হইতে চোখা একটি লহার দাঙ্গা।তাহার উপর যাইয়া গেরস্ত কে বসিতে হইবে।
রজার হুকুম শুনিয়া গেরস্ত তো কাঁপিয়া অস্থির।সে জোর হাত করিয়া বলিল,“মহারাজ!দেয়াল চাপা পড়িয়া যে চোর মরিয়াছেয়।এতে আমার দোশ নয়।যে রাজমিস্ত্রি আমার দেয়াল গড়িয়াছে তারই অপরাধ।কারন শক্ত করিয়া দেয়াল গড়ে নাই।”

রাজা বলিলেন,“এ কথা সত্য।তবে ডাক দাও সেই রাজ- রাজমিস্ত্রিকে।”
রাজমিস্ত্রি আসিলে রাজা রাগিয়া মাগিয়া তাহাকে বলিলেন,“দেখ রে রাজমিস্ত্রি!তুমি বড়ই অপরাধ করিয়াছ।এই গেরস্তের দেয়াল তুমি শক্ত করিয়া গাঁথ নাই।তাই গেরস্তের বাড়ি চুরি করিতে আসিয়া চোর দেয়াল চাপা পড়িয়া মারা গিয়াছে।তুমি একটি লোকের মৃত্যর কারণ হইয়াছ আমি তোমাকে শূলে চড়িয়া মরার হুকুম দিলাম।”

ভঁয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে রাজমিস্ত্র উত্তর করিল,মহারাজ আমার কোন কসুর নাই।যে জোগালদার আমার কাঁদা ছানিয়া ছিল তার অপরাধ, সে ঠিক মত কাদা ছেনিয়া দেই নাই বলিয়া দেয়াল শক্ত হয় নাই।”
রাজা বলিল,ডাক সেই জোগালদার কে।”রাজার হুকুমে জোগালদার আসিয়া রাজার সামনে খাড়াইল।রাজা তখন বলিলেন,“দেখ রে জোগালদার!তুমি মস্ত অপরাধ করছো।ভালমতো কাদা ছেনিয়া দেও নাই বলিয়া রাজমিস্ত্র শক্ত করিয়া দেয়াল গাঁথিতে পারে নাই।সে দেয়াল চাপা পড়িয়া চোর মারা গিয়াছে। আমি তোমাকে শূলে চড়িয়া মরার হুকুম দিলাম।ভয়ে তো জোগালদার কাঁপিতে লাগিল।বেচারি জোগালদার কাজ করিয়া সামন্যিই বেতন পাই।তাহা দিয়ে নিজেই বা খাইবে কি আর ছেলেমেয়েদেরই কি বা খাওয়াইবে কি।না খাইয়া তাহার শরীর কাঠের মত শুকনা ঠন ঠনে।
তাহাকে দেখিয়া মন্ত্রি বলিলেন,“মহারাজ এই লোকটির শরীর শুকনো লোহার মতো।একে শুলের উপর বসাইয়া দিলে শুলের মাথাটাই আটকাইয়া থাকিবে।”
রাজা তখন বলিলেন,“হাকিম নড়ে তবুও হুকুম নড়ে না।আমি যখন আদেশ দিয়েছি টা পালন করিতেই হইবে!দেখ,রাজ্যের কোথায় বেশ মোটা-সোটা লোক আছে।তাহাকে আনিয়া শুলে দাও।”
রাজার সেপাইরা এ-পাড়া ও পাড়া ঘুরিতে ঘুরিতে সেই শিষ্যকে খুঁজিয়া পাইল।মাসখানেক ইচ্ছামত ঘি,দুধ,মাখন,খাইয়া তাহার শরীর তেল চকচকে হইয়াছে।রাজার পাইকেরা তাহাকে ধরিয়া আনিয়া শুলের কাছে লইয়া গেল।সেখানে হাজার হাজার লোক জমা হইয়াছে।রাজা,রাজার মন্ত্রি, কোটাল,কোটাল-পুত্র সকলেই আসিয়াছেন।

কিছুদিন এদিক ওদিক ঘুরিয়া ঘুরু ভাবিল,শিষ্যটিকে ফেলিয়া আসিলাম।যাই দেখেআসি সে কি হালে আছে।এক জায়গায় বহুলোক জড় হইয়াছে দেখিয়া গুরুও সেখানে আসিয়া হাজির হলেন।দেখিয়া গুরু অবাক হইলেন,তাঁর শিষ্যকে শূলে চড়াইবার বন্দোবস্ত হইতেছে।তিন চারজন লোক শুলের চোখা লোহার কাঠির উপর সবরী কলা,ঘি আর মাখন মাখাইতেছে।শিষ্যকে শুলের উপর বসাইয়া দিলেই চড়াত করিয়া সেই চোখা লোহার কাটি তাহার নাড়ীভুঁড়ি ছিদ্র করিয়া শিরীরের মধ্যে বিধিয়া জাইবে।গুরু ভাবিতে লাগিলেন,“আহা!এই শিষ্য টি বহু দিন তাঁর কাপড় বোকচা বহিয়া বেড়াইয়েছে।আজ বিপদের কালে তাহাকে কোন সাহায্য করিতে পারিব না?”

মনে মনে একটি ফন্দি আটিয়া গুরু ঠাকুর সমস্ত লোকের ভিড় ঠেলিয়া সেই শুলের কাছে যাইয়া উপস্তিত হইল।
“তোমরা শর!শর!এই লোকটির বদলে আমি শূলে চড়িব।”
রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি শূলে চড়িবে কেন?
গুরু ঠাকুর বলিল,আজ বসু পর্বে।চান সুরুজ রাজা হইয়া জন্মগ্রহন করিবে।মহারাজ!দয়া করুন!এই লোকটির বদলে আমাকে শূলে যাইতে দিন।”
রাজা বলিলেন,আমি রাজা বেঁচে থাকিতে তুমি শূলে চড়িয়া মরিয়া আবার এদেশের রাজা হইয়া জন্মাবে?তা কখনো হইবে না।
আমি শূলে চড়িব।”

তখন মন্ত্রি বলিলেন,মহারাজ আমি শূলে চড়িব।”
গুরু ঠাকুর বলেন,“না না,আমি শূলে চড়িব।”
তারপর রাজা বলেন,আমি,মন্ত্রি বলেন,আমি,গুরু ঠাকুর বলেন আমি।প্রায় আধাঘণ্টাতক লোকেরা শুধু আমি,আমি শুনিতে লাগিল।তখন রাজা ধমক দিয়া সকল কে সরাইয়া দিয়া নিজেই যাইয়া শুলের উপর চড়িয়া বসিলেন।
গুরু ঠাকুর শিষ্যকে সঙ্গে করিয়া তাড়াতাড়ি সে দেশ ছাড়িয়া নিজের দেশে ফিরিয়া আসিল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!