প্রচন্ড শীত। মাঘ মাসের শৈত্য প্রবাহ চলছে। লঞ্চ চলছে ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর উদ্দেশে।
ঘ্যা… ঘ্যা… ঘ্যা। বুড়িগঙ্গা থেকে পটুয়াখালী এক দীর্ঘ যাত্রা। নদীর পর নদী পার হতে হয় লঞ্চকে রাতের অাঁধারে। রাতে বলেই লোকজন বুঝতে পারে না ভয়াবহ সেই দৃশ্য। উত্তাল নদী পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে একটা লঞ্চ। কী সাহস মানুষের।
শীতের কুয়াশা নদীকে ঢেকে দিয়েছে। দেখা যায় না নদীর পানি। পাঞ্জেরী দিয়ে দেখে দেখে লঞ্চ চলছে। শীত বেশি বলে একটু রাত হতে না হতেই ডেকের যাত্রীরা গায়ে কম্বল কাঁথা যে যা পেয়েছে মুড়ি দিয়ে ঘুমের চেষ্টা করছে। কিন্তু হাড় কাঁপানো শীতে ঘুমটাও জেঁকে বসতে পারছে না। কেবিনের যাত্রীরা অবশ্য আরামেই ঘুমাচ্ছে। দরোজা-জানালা বন্ধ করে দিলে শীত খুব একটা ঢুকতে পারে না। সাহেব-বিবিরা বেশ আরামেই দুলুনি খেতে খেতে নদী পার হন।
রাতের খাবার খাওয়ানোর পর মীরাজের তেমন কোন কাজ থাকে না। মাঝে মধ্যে কেবিনের সাহেবদের কেউ কেউ ডাকেন সিগারেট এনে দেবার জন্য। কিন্তু আজ সেই ডাকও না পড়ার সম্ভাবনা। শীত বেশি বলে।
মীরাজ কেবিন-বয়। এতো বড় বিশাল লঞ্চে তার কোন স্থান নেই ঘুমাবার। তাই তাকে কেবিনের সামনে যে লনটুকু আছে তাতেই শুয়ে রাত কাটাতে হবে। শীতের সময় না হলে এই লনটায় শুয়ে ঘুমালে তার মন্দ লাগে না। নদীর মিষ্টি বাতাস এসে তার শরীরে পরশ বুলায়। সারা দিনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে নিয়ে যায় নদীর বাতাস। ঘুম হয় তার খুব। রাজার ঘুম। ভোরের আলো চোখে মুখে এসে হামলে না পড়া পর্যন্ত মীরাজ ঘুমায়।
মীরাজ এই লঞ্চে কেবিন বয় হিসেবে চাকুরি নিয়েছে মাস তিনেক হলো। মাসে পাঁচশ টাকা মাইনা। থাকা-খাওয়া লঞ্চ কোম্পানীর। তবে তার চাকুরি এখনো পাকাপোক্ত হয়নি। মানে স্টাফ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি। তার জন্য সে শোয়ার কোন কেবিন এখনো পায়নি। মাস্টার (লঞ্চ চালক) বলেছে, ছয় মাস গেলে একটা ব্যবস্থা করে দেবে। মাস্টার তার দেশের লোক। তার প্রতি একটু রহম আছে। কিন্তু মেজাজ বিগড়ালে একদম বাঘ। হ্যাঁ, সব কেবিন বয় মাস্টারকে বাঘের মতো ভয় পায়। লঞ্চের ম্যানেজার তার চেয়ে কড়া- যেনো সিংহ। এই বাঘ ও সিংহের রাজত্বে মীরাজরা খুব ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়। পান থেকে চুন খসলেই মা-বাপ তুলে গালি, চড় থাপ্পর, কিল ঘুষি লাথি আরো অনেক কিছু। এসব অত্যাচার ওদের নুন-ভাত।
এসব কথা ভাবতে থাকে মীরাজ কেবিন এবং মাস্টার কেবিনের মাঝে এক চিলতে চলাচলের পথে গুটি সুটি শুয়ে। প্রচন্ড শীতে তার শরীর কোনভাবেই গরম হতে চায় না। মরার শীতে তো বাঁচন গেল না। সুঁইয়ের মতো বিন্ধে খালি।
কাঁথা তার দুটো। একটা নিচে পেতে শোয়। আরেকটা গায়ে মুড়ি দেয়। শীতের চোটে দুটোই গায়ে দেয়। তাতে আবার লঞ্চের বডির ঠান্ডা গায়ে লাগে। সমস্ত শরীর হাত মুখ ঢেকে গুটি সুটি হয়েও শীতের হাত হতে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। এমুন বজ্জাইত্যা শীত!
মীরাজ আর সহ্য করতে পারছে না। ধীরে ধীরে জমে উঠছে যেনো। এখন সে কী করবে! মাস্টারের কেবিনে যাবে? মাস্টার কি তারে জায়গা দেবে? হে আবার সিট বেছছে না তো? গেলে হয়তো ঢুকতেও দেবে না।
মুখের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে মীরাজ দেখল কেবিনের লনে এখানে সেখানে যারা তার মতো শুয়ে ছিল তাদের কেউ নাই। তার মানে শীত সহ্য করতে না পেরে এখানে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। শুধু তার কোন আশ্রয় নেই! নাহ্। আজ তার মরণই। এই শীতেই সে মারা যাবে। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে তার পুরো শরীর। হাত-পা আর নাড়তে পারছে না।
রাইত কতো অইবো? মনে মনে প্রশ্ন করে মীরাজ। অবশ্য লঞ্চের অবস্থান দেখে বলতে পারে সময়। কিন্তু কাঁথা সরিয়ে লঞ্চের অবস্থান দেখার মতো সাহস তার হয় না। তবু, সময় জানার ইচ্ছেটা প্রবল হয়। আর কতো দীর্ঘ এই রাত জানাটা দরকার। এমন সময় আরেকটা লঞ্চ তাদের লঞ্চের কাছাকাছি এসে পড়ে। দ্রুত অতিক্রম করার শব্দও শোনা যাচ্ছে।
ঘ্যা…….. ঘ্যা…….. ঘ্যা……… ঘ্যা………
মীরাজ একটু কাঁথা সরিয়ে অতিক্রমকারী লঞ্চের দিকে তাকায়। দেখতে পায় জল ময়ূরীকে। তাদের লঞ্চের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। অন্য সময় হলে এই পাল্লাপাল্লি দেখতে তার মজা লাগতো। কিন্তু প্রচন্ড শীতে তার সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে। তাই, লঞ্চের এই পাল্লা দেওয়ার দৃশ্য তার তেমন ভাল লাগলো না। কাঁথা আরো সাপটে কুকরি মুকরি হয়ে শুয়ে থাকে। ঘুমের চেষ্টা করে।
২
বাথরুম ধরায় শেষতক আরামের ঘুম রেখে উঠতে হলো আরমানের। শত ভয়-ভীতি নিয়ে রওনা দিয়েছে পটুয়াখালীর উদ্দেশে সে। নতুন চাকরি, বদলি ঠেকাতে বেশি ধরাধরি না করে মেনে নেয়ে এই অসময়ের বদলি। সে জানে এই অচেনা অজানা সাগর তীরের দেশে তাকে কঠিন জীবনে প্রবেশ করতে হচ্ছে। কিন্তু উপায় কি!
কেবিনের দরোজা খুলতেই এক ঝটকা হিম বাতাস তার গায়ে এসে লাগে। মনে হল এক খন্ড বরফ তার গায়ে কেউ ছুঁড়ে মারল। কম্বল গায়ে দিয়ে গরম হয়ে ওঠা শরীর মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে গেল। শীতে ঠক্ ঠক্ কেঁপে উঠলো শরীর। বাথরুম বেশ দূরে। বাথরুমে যেতে হলে ডেকের লন ধরে খানিকটা যেতে হবে। কিন্তু যে হিম তাতে মনে হয় বাথরুম পর্যন্ত যেতে গেলে জমেই যাবে। একটু দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কি করবে। মনে আল্লাহ আল্লাহ জপতে থাকে। হে আল্লাহ! তুমি আমায় শক্তি দাও। যাতে আমি বাথরুম পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারি। অবশেষে আরমান প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মনের সব ভয় এবং শীতের দাপট উপেক্ষা করে কেবিনের দরোজায় তালা দিয়ে রওনা হয়। কিছুদূর হেঁটে যেতেই টের পায় তার সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে। তবু হাঁটতে থাকে। একপা দু’পা করে এগোতে থাকে। অবশেষে মাস্টার কেবিনের কাছে এসে মোড় নেয়। মাস্টার কেবিন এবং প্যাসেঞ্জার কেবিনের মাঝামাঝি এক টুকরো লন যেখানে সরাসরি হিমেল বাতাস ঢুকতে পারে না। তাই হিমেল বায়ুর ধাক্কাটা এখানে কম।
এখানে এসে থমকে যায় আরমান। গুটি সুটি হয়ে শুয়ে আছে কে যেনো। হালকা আলোতে দেখা যায় শুয়ে থাকা আদম সন্তানটি ঘুমিয়ে পড়েনি। বেশ নড়াচড়া করছে।
-কে রে? আরমান শুয়ে থাকা আদম সন্তানের উদ্দেশে হাঁক দেয়।
-কে রে এখানে শুয়ে? আরমান আবার হাঁক দেয়।
কাঁথা মুখের ওপর থেকে একটু সরিয়ে জবাব দেয়, স্যার আমি মীরাজ…।
-মীরাজ! কি রে তোর আর কোন জায়গা নেই শোওয়ার?
-জে না, স্যার।
-এই শীতে তুই এখানে কীভাবে শুয়ে! রাখ আমি বাথরুম থেকে আসি।
রাতের বেলা এই ছেলেটি আরমানকে ভাত খাইয়েছিল। তখনই দু’চার কথায় জানতে পেরেছিল তার দুঃখের কাহিনী। কেমন মায়া হয়েছিল। মনে মনে ঠিক করে তার কেবিনের ভেতর নিয়ে শুতে দেবে। কেবিনের ভেতর না নিয়ে গেলে নির্ঘাৎ শীতে জমে মারা যাবে ছেলেটি। তাই, বাথরুম সেরে ফেরার পথে মীরাজের কাছে দাঁড়িয়ে বলে,
-চল আমার কেবিনে শুবি। শীতে তো জমে যাবি এখানে!
-না স্যার জম্মু না হেনে- আফনে কেবিনে গিয়া হুইয়া থাকেন।
-না চল্। উঠ্, উঠ্ বলছি!
ধমক খেয়ে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসে মীরাজ। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে তার নিচে পাতা কাঁথা এবং গায়ে দেওয়া কাঁথা গুটিয়ে আরমানের সঙ্গে চলে আসে কেবিনে। আরমান উঠে গিয়ে শুয়ে পড়লো খাটে। নিচে সে বিছানা করে শুয়ে পড়লো।
-আইজ্জা স্যার বরফের লাহান শীত। আফনে এইহানে জায়গা না দিলে মইরাই যাইতাম।
-তোর ভাগ্য ভাল। আমার বাথরুম লেগেছিল, তা না হলে…।
– মইরাই যাইতাম স্যার।
-যাক, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আরমানের মনে হতে থাকল একটা ভাল কাজ করা হলো। এ রকম ছোটখাট ভাল কাজ আমরা সবাই যদি করতে পারতাম। তহলে সমাজ অনেক সুন্দর হতে পারতো।
-মীরাজ, তোর বাড়ি কোথায়?
-পোট্টাহালি স্যার।
-কোন থানায়?
-বাউফল।
-দেশে তোর কে কে আছে?
-বাবা, ভাই-বোন, সৎ মা আর দাদী।
-তোর বাবা কী করে?
-গিরস্তি। নিজের জমিন নাই। বর্গা চষে।
-তুই লেখাপড়া করেছিস কদ্দুর?
-ফাইব পাস গেছলাম। হেনে বাবা আমারে পড়াইতে চায় না। সৎ মা মারে, খাওন দেয় না। একদিন বাড়ি থাইক্যা বাইর অইয়া গেলাম।
-তারপর?
-তারপর আমাগো দেশের এক মাস্টারে আমারে এই লঞ্চে চাহরি দেয়।
-বেতন কত?
-এহনো বেতন ধাইরজ অয় নাই স্যার। ছয় মাস গেলে পাঁচশ কইরা দিবো- আর একটা কেবিন দিবো।
-মাত্র পাঁচশ! আরমান অবাক হয়। অবাক হবারই কথা। এতো দীর্ঘ ডিউটি, এতো কষ্টের মজুরী মাসে মাত্র পাঁচশ।
-এই টাকায় তোর চলবে!
-খরচ তো নাই স্যার। খাওয়া ফিরি, থাহা ফিরি, আর স্যাররা কিছু বকশিস দেয়। বেতনডা আনামই থাকবো।
-বাড়িতে দিবি না?
-জে। আমার একটা ছোড বইন আছে, তার লাইগা বড় পেট পুড়ায়, তার জন্যি কিছু টাহা পাডাইতে অইব।
-বাবার জন্য…?
-হে তো পাডাইতে অইবোই।
-শোন্ মীরাজ, আমি তো পটুয়াখালী থাকবো, তোর লঞ্চেও যাওয়া-আসা করবো। তুই ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারিস। তোর জন্য অন্য কোন কাজ আমি জুটিয়ে দেব।
-জেনা স্যার, এই লঞ্চের চাহরীই আমার বালা।
-বুঝেছি নদীর সঙ্গে তোর ভাব হয়েছে।
– জে স্যার।
-আরমান, আর কথা বলা সমীচিন মনে করল না। এমনিতে রাত অনেক গভীর। পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। কম্বলটা আরো টেনে মাথা ঢেকে শোয়। মীরাজও পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। শীতের দাপট না থাকায় শরীর গরম হয়ে উঠে। ঘুম এসে ভর করে তার চোখে।
মীরাজ একটা বড়-সড় লঞ্চ চালাতে থাকে। তার মাথায় ক্যাপ, সুন্দর ড্রেস। ঠিক বড়সড় জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো। ছবিতে দেখেছে। তার লঞ্চ চলেছে অথৈ বিশাল নদীর উপর দিয়ে। কূল নাই। কিনারা নাই। শুধু পানি আর পানি।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।