কেন পান্থ এই চঞ্চলতা–অবনী চারিতা

ভাইয়া এই ফুলের নাম কি? এই বলে বেনু নৌকার এক পাশে গেল। নৌকাটি তড়িৎ বেগে নড়ে উঠল একই সঙ্গে সকলে চিৎকার করে উঠল, বেনুর বাবা বেনুর দিকে অসম্ভব রাগী চোখে তাকালো, অন্য কোন সময় হলে, বেনু অভিমান করে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যেত, কিন্তু আজকে যেন তার কি হয়েছে কিছুতেই তার রাগ হচ্ছে না। তার বাবা এই নিয়ে আরো দু’-দু’বার রাগ করে কথা বলেছে; বেনুর তাতে কিছুই হয়নি। আজকে যেন তার বাবা রাগ করলেই ভাল লাগছে।

ঢাকা থেকে বেনু যখন লঞ্চে চড়ে তখন তার তেমন ভাল লাগেনি। লঞ্চ চালুর পরে তার ভাল লাগা ক্রমেই বেড়েছে। লঞ্চ থেকে নেমে নৌকায় তাদের গ্রামের বাড়ি যেতে আরো ভাল লাগছে। তার বাবা-মা-ভাই-বোনের সঙ্গে আরো আছে তার ভাইয়ের বন্ধু রুপিন। সকলে নৌকার ভিতর পাথরের মত বসে আছে, পানি দেখে তাদের ভয় লাগছে, কারণ তারা কেউই সাঁতার জানে না। কিন্তু বেনুকে কিছুতেই তারা এই ভয় দেখাতে পারছে না।

বেনু এর আগেও গ্রামের বাড়িতে এসেছে। কিন্তু সে অনেক আগের কথা। তখন তার বয়স ছিল চার বছর; এখন তার বয়স চৌদ্দ। সে যা দেখছে তাই ভাল লাগছে; যেন সে ভাল লাগার ঔষধ খেয়েছে। লঞ্চে বসে উড়ে যাওয়া বকপাখি দেখে অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করেছে। অনেক লোকের সামনে চিৎকার-চেঁচামেচি করাতে তার মা লঞ্চের কেবিনে নিয়ে গিয়ে তাকে অনেক ধমকা-ধামকি করেছে।
– বেনু তুমি এখন অনেক বড় হয়েছে তোমার চিৎকার-চেঁচামেচি সাজে না।
– আমার কিছু দেখে ভাল লাগলে আমি কি করব!
– ভাল লাগলেই চিৎকার-চেঁচামেচি করতে হবে একথা তোমাকে কে বলল।
সন্ধা বেলা আকাশে উড়ে যাওয়া বকপাখি তুমি ঢাকায় বসেও অনেকবার দেখেছো, আমার বিশ্বাস তুমি চিৎকার-চেঁচামেচি করেছ অন্য কোন কারণে।
– অন্য কি কারণে আমি চিৎকার করব?
– বেনু তুমি অনেক বড় হয়েছো!
– বড় হয়েছি তো কি হয়েছে, ফিস-ফিস করে কথা বলব?
– লঞ্চের ছাদে বসে তুমি রুপিনের হাত ধরে হাঁটছিলে কেন?
– ও তাই বল! এতক্ষণ এত কথা না বলে সরাসরি এই কথা জিজ্ঞেস করলেই পারতে।
– ভনিতা না করে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।
– রুপিন ভাইয়ার হাত না ধরলে তো আমি ছাদের উপর থেকে পড়েই যেতাম। লঞ্চ কি দুলছিল! আচ্ছা মা ভাইয়ার সব বন্ধুদের তো আগে দেখেছি রুপিন ভাইয়াকে তো আগে কখনো দেখিনি।
– ও চট্টগ্রামে থাকে। তুমি অনিমের সব বন্ধুদের হাত ধরে কথা বল হেসে হেসে কথা বল, ঠিক না। তুমি অনেক বড় হয়েছ।
– আচ্ছা এখন থেকে মুখ কালো করে কথা বলব।
– বেনু তুমি আমার মুখে মুখে কথা বলছ! তুমি এখন বড় হয়েছ তোমার হিসেব করে পথ চলা উচিত।
– আচ্ছা পা গুণে গুণে পথ চলব, এক দুই তিন চার এভাবে।

বেনু মায়ের রাগারাগিতে সামান্য থেমে থাকেনি, সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সবকিছু দেখায় মেতেছে। কচুরি পানার উপর একটি পাখি দেখেছিল। পাখিটি সবসময় নাচছিল। সে পাখিটির ছবি তুলতে চেয়েছিল ভীষণভাবে। কিন্তু সে ক্যামেরা নিয়ে আসেনি, ক্যামেরা এনেছে তার বড় বোন দ্বিপিকা। সে দ্বিপিকাকে খুব ভয় করে। তারপরও সাহস করে গিয়ে বলল
– আপু তোমার ক্যামেরাটা দিবে?

ক্যামেরা সে পেলেও পাখি সে পায়নি। কিন্তু যা পেয়েছে তার ছবিই সে তুলেছে।

বেনু নৌকায় বসে লঞ্চের মত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে পারছে না। অনেক ছোট নৌকা। সে একটু এপাশ থেকে ওপাশ গেলেই – সকলে চিৎকার করে।

বাবা বলেছে বাড়িতে একমাস থাকবে। নৌকার এত আনন্দে বেনু বলল, বাবা আমরা নৌকায়ই এক মাস থাকব।
বাবা বলল, আচ্ছা।

তার ভাইয়া অনিম বলল, ঐ যে তোর ফুল আবার এসেছে। প্রথমে ছিল একটি দুটি, এবারে অসংখ্য। বেনু নৌকায় ছই দিয়ে মাথা বের করে লাফ দিয়ে দাঁড়ায় কাউকে পরোয়া না করে। বকপাখি দেখে যেরকম চিৎকার দিয়েছিল সেরকম চিৎকার দিতে থাকল।

বেনু চিৎকারে নদীর পাড়ের কিছু রাখাল ছেলে কৌতূহলী চোখে তাকাল। নদীর পাড়ের এরকম ফুল দেখে চিৎকার করতে হবে কেন তাদের মাথায় কিছুতেই তা ঢুকছে না। তারা নৌকার পাশে পাশে হাঁটতে থাকল।

এমন সময় নদীতে তীব্র বেগে ঘূর্ণিঝড় শুরু হল। মাঝি নূর মিঞা চিৎকার করে সবাইকে সাবধান হতে বলল। মুহূর্তের ভিতর নৌকা নদীর মাঝখানে চলে গেল, বেনুর মার শুধুই আল্লাগো বলে চিৎকার শোনা গেল। তারপর সবাই কোথায় গেল বেনুর বাবার খেয়াল নেই। নৌকাটি তার সামনে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল একথাই শুধু তার মনে পড়ে। সাঁতার জানে বলে সেই শুধু বেঁচে আছে। তার কাছে মনে হল সাঁতার না জানাই ভাল ছিল। সে নদীর চরে বসে আছে। নদীর সব পানি তার কাছে রক্তের মত লাগছে।

প্রকৃতি লাল হয়েছে। সাঁঝের মায়ায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে বকপাখি। বেনু দেখতে পাচ্ছে না সেই পাখি। তার শুধু লাল ফ্রক দেখা যাচ্ছে মুখমণ্ডল পানির নীচের দিকে। ঢেউ উছলে পড়ছে তার গায়।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!