মাইকে ঘোষণাটা শুরু হয়েছে সকাল সকাল। মাঝে মাঝে যে কোথাও এমন ঘোষণা হয় না তা নয়। কোন বড় লোক যদি দুনিয়াদারি থেকে চোখ বুজে ফেলেন তাহলেও এমন ঘোষণা অনেকে কান খাড়া করে শোনেন। তবে আজকের ঘোষণাটা বুকে ধাক্কা লাগার মতো কোন দুর্ঘটনা জাতীয় কিছু নয়। ঘোষণার শেষের দিকে এক টুকরো খুশির সংবাদও আছে। পুরস্কার। ভালো পুরস্কার।
অভি আজ চোখ কচলে কচলে ঘর থেকে বের হয়ে পড়লো। অথচ এই ছেলেটা কতোই না আলসেতে ভরা। সকাল বেলা কেউ টান মেরে কাঁথাটা কেড়ে না নিলে সে ঘুম থেকেই উঠেনা। উঠলেও চোখ মুখ থাকে মার-খাওয়া বক্সারের মতো ফোলা ফোলা।
আলহাজব এয়াকুব আলী মুন্সী এলাকার আকাশ সম বিত্তবান মানুষ। মানুষকে সাহায্যও করেন দু’হাতে। মাইকে তাঁরই বাড়ির ঠিকানা। পুরস্কারটা নিশ্চয়ই সুঁই-পিঁপড়ার মতো হবে না। যেমন মানুষ তেমন পুরস্কার।
ঘোষণায় মোরগের একটা ছোট খাটো বর্ণনা দিয়েছে ঘোষক। মোরগের পেছনের অংশটুক লাল। গলাটা সাদা। ওজনটা সাড়ে সাতশ গ্রাম।
অভি অনেক কষ্টে একবার চারপাশটা দেখে নিলো। সূর্যটা এখনো পৃথিবীতে ফিরে আসেনি। পাখ-পাখালির কিচির মিচির শব্দটা কোথাও কোথাও শোনা যাচ্ছে। কুয়াশার ভারে ঘাসগুলো এখনো মাটির কাছে নুয়ে আছে। কুয়াশা ভেজা পায়ে অভি পৌঁছলো হাসমত আলী মুন্সীর বাড়িতে। এখানে সারাদিন মোরগ-মুরগীর উৎসব চলে। দেড় ডজন বলদ চক্কর খেতে খেতে ধান ভানে। ডজন দুয়েক মহিলা ধান ঝাড়ে আর বস্তা বস্তা করে।
অভি চারপাশের মোরগগুলোকে চুক চুক করে দেখলো কয়েকবার। মোরগের সাইজ মিললে রঙ মেলে না। রঙ মেললে সাইজ মেলে না। কী আশ্চর্য কান্ড।
ফের পা বাড়ালো ও দখিনা বিলের দিকে। বিলটি এলাকার দখিন পাশে বলে বিলের নামটিও হয়ে গেছে দখিনা বিল। সারা বিল জুড়ে এখন পাকা ফসলের হাসি। দলে দলে কৃষক ফসল কাটছে গান গেয়ে গেয়ে। কৃষকরা যে এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে তা অভির কোন দিন জানা ছিলো না।
পেছন থেকে কারুর পায়ের শব্দ পেলো অভি। ঘাড় বাঁকাতেই রিয়াদকে চোখে পড়লো তার। মিটমিটে চোখে অভি বললো- তুই? তুই এখানে কেন?
রিয়াদ বললো- আমি-আমি-এমনি এমনি….।
-মিথ্যা ছুঁতে চাচ্ছিস। ফায়দা নেই। আমিও তোর মতো চারপাশ চষে যাচ্ছি।
অভি একটু হোঁচট খেলো। তাইলে প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে নেমেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী নামলে কি আর মনে শান্তি থাকে?
রিয়াদ বললো- রবিনেরা আলী রেজার বাড়ির দিকে গেছে।
-রবিনেরা মানে?
-সোহেল রুবেল ইমুও আছে।
-ইমুও? যে মোরগের ডাক শুনলেই কাঁদে!
-কারুর সাহস বাড়লে হঠাৎ বেড়ে যায়। এমনও হতে পারে পুরস্কারটা ইমুই পেয়ে গেলো।
-ধ্যাৎ, এটা হয় নাকি? নিজের ওপর বিশ্বাস না থাকলেই সেই কেবল অমন কথা বলতে পারে।
রবিনের দলকে খালি হাতে আসতে দেখে অভি রিয়াদ চুপ হয়ে গেলো। স্বপ্নের আশার ওপর যেন কালো মেঘ নেমে এলো। কিন্তু রবিনের মুখে সাদা মেঘ খেলা করতে দেখে তাজ্জব বনে গেলো অভি আর রিয়াদ।
রবিন সবার উদ্দেশে বললো- এসো, কাছে এসো।
সবাই কাছাকাছি এসে রবিনকে ঘিরে ধরলো। রবিন উপস্থিত সবার থেকে এক ক্লাস দুই ক্লাস ওপরে পড়ে বলে তার ওজনও আজ একটু বেশি। সে তার মাথায় গজানো বুদ্ধির কথা পরিষ্কার করে বললো।
ইমু একটু একটু তোতলায়। তোতলা মুখে সে বললো- এমন মোরগ বাজারে পাওয়া যাবে তো?
রবিন বললো- পাওয়া যাবে মানে? একশ একটি পাওয়া যাবে। আরে মানুষের মতো মানুষ জন্মাচ্ছে আজকাল। আম গাছের আম কি এক রকম হয় না? দু’টি চড়ুই কি দেখতে এক রকম নয়? দুই কাকের চেহারা কি পরখ করা যায়? যায় না।
সবাই ভাবলো আসলে এমন বুদ্ধি শুধু রবিনের মাথায় আসতে পারে। তারপরেও বছরের শেষে ও কেন যে ঠেলে ঠেলে পাশ দেয়!
পয়সার সমস্যাটা বড় হয়ে দেখা দিলো সবার কাছে। বর্তমানে মোরগের অনেক দাম যাচ্ছে। এক কেজি সত্তর টাকায়ও পাওয়া যায় না। সাড়ে সাতশ গ্রামের দাম পঞ্চাশ টাকারও বেশি হবে। তাহলে?
তাহলেটার সমাধান রবিনই করে দিলো পটাপট। তার কাছে একটা মাটির ব্যাংক আছে। সেই ব্যাংকে নির্ঘাত বিশ টাকার কাছাকাছি হয়ে যাবে। আল্লাহ্ চাইলে বেশিও হতে পারে। তারপর বাকি টাকাটা সবার মাথা প্রতি হয়ে গেলো। প্রতি মাথায় এতো কম টাকা পড়াতে সবাই খুশিতে টইটম্বুরে অবস্থান করতে থাকল।
মোরগটা কেনা হলো বটে তবে এর ওজন সাড়ে সাতশ গ্রাম হয়নি। পাঁচ গ্রাম বেশি হয়ে সাতশ পঞ্চান্নতে গিয়ে ঠেকেছে। ওজন নিয়ে সবার মনে একটু খটকা লেগে গেলো। অবশ্য হাঁটতে হাঁটতে ইমুই তার সমাধান আবিষ্কার করে দিয়েছে। ইমু বলেছে সকাল থেকে মোরগটা মুখে তালা লাগিয়ে বসে থাকেনি। মোরগ গরু-মহিষ নয় যে ওর মুখে খোঁয়াড় থাকবে। সকাল থেকে কিছু না কিছু খেয়েছে নিশ্চয়। একটা মোরগ পাঁচ মিনিটেই পাঁচ গ্রামের বেশি খেতে পারে। সবাই তার স্বরে ইমুর অভূতপূর্ব আবিষ্কার সমর্থন করলো। এবং এক সাথেই স্লোগান ধরলো- ইমুর মগজ জিন্দাবাদ।
দারোয়ান আবদুস সোবহান চেয়ারে বসে ঠ্যাং দু’টো লম্বালম্বি করে দিয়ে অঘোরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আহা, বেচারার ওপর কতো ধকলই না গিয়েছে সারা রাত। টর্চ জ্বেলে জ্বেলে নিশ্চয় চষে বেড়িয়েছে গোটা তল্লাট।
আলহাজব এয়াকুব আলী মুন্সী সটান হয়ে সোফাসেটে বসে আছেন। বয়স এখনো তাঁর শরীরের ওপর কামড় বসাতে পারেনি। অথচ তাঁর বয়সের চাক্কা কিছুদিন আগে সাড়ে তিন কুড়ি অতিক্রম করে ফেলেছে।
এক দঙ্গল ছেলে পিলে দেখে মুন্সী সাহেবের চোখ দু’টো চকচক করে ওঠলো। মানুষটা মরচে রঙের হলেও চেহারাটা অন্য রকম মায়াবী মায়াবী বলে মনে হলো।
মুন্সী সাহেব বললেন- চাঁদা চাই নাকি? ফুটবল ফেটে গেছে নিশ্চয়?
রবিন মোরগটা মুন্সী সাহেবের হাতে দিয়ে বললো- নিন জনাব, আপনাদের মোরগ। মোরগের জন্য আজ সবাই স্কুল মাটি করেছি। কী যে ঝাকুনিটা গেলো সবার ওপর!
মুন্সী সাহেব মোরগটা হাতে নিলেন। আস্তে আস্তে তার বাঁধনটা খুলে দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিলেন। মোরগটা স্বাধীনতা পেয়ে দু’লাফেতের মিটার চলে গেলো।
রবিন চোখ দু’টো আকাশে তুলে বললো- জ্বী জনাব, মোরগটা বাইরে ছেড়ে দিলেন?
মুন্সী সাহেব বললেন- কিছুক্ষণ আগেই সুমনার মোরগটা পাওয়া গেছে। মোরগটার জন্য সুমনা কাঁদছিলো বলে মাইকে জানান দিয়েছিলাম।
ইমু বললো- কিন্তু……..।
কিন্তুর পরে ইমুর গলা থেকে আর কোন শব্দ বের হয়নি। কারণ রবিনের চিমটিতে বড়ই জোর ছিলো।