কৃষ্ণ বিবর—- হাসান জাহিদ

পানশালার এককোণে আসীন দুই সঙ্গী মুরগির ডানা ভাজা সহযোগে পান পর্বে মত্ত হয়। শিরাজ গোত্রের রেড ওয়াইনের কারসাজিতে বিদ্বিষ্ট হয়ে বদরুল বলল, ‘এতদিন শুধু টিভিতেই দেখেছি ঠাণ্ডার দেশের মানুষদের জীবনযাত্রা, এখন বাস্তবে আমরা সেই জীবনের অংশীদার।’
বদরুলের মন্তব্যে গ্লাসে চুমুক বসিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিল আতা। অনেকটা সময় নীরবতা। বোধহয় দু’জনেই অতি ঠাণ্ডা ও লাল মদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজল।
‘আপনার না দেশে যাওয়ার কথা ছিল?’ বদরুলের অকস্মাৎ প্রশ্নে আতার কালো চিকচিকে চেহারাটা ভাঁড়ের রূপ ধারণ করল।
সে বলল, ‘যেতে তো চাই কিন্তু দেশটায় যে হারে রাজনৈতিক আতশবাজি চলছে, তাতে ভরসা পাই না।’
‘আতশবাজি!’ বদরুল শাঁক-আলুর মতো সবকটি দাঁত বের করল: ‘ভালো বলেছেন তো, আতশবাজিই তো। পোলাপানদের এলোমেলো আতশ ছুড়ে মারার মতো। এ এখান থেকে মারে তো, ও মারে অন্য দিক থেকে।’
বছরখানেক আগে ড্যানফোর্থে এক বিকেলে গ্রসারি সেরে ফেরার পথে দুই বন্ধুর দেখা হয়। কেন, কবে আর কীভাবে ক্যানাডার বৃহত্তম শহর টরোন্টোর দরিদ্র এলাকায় তারা অস্তিত্বমান দু’জনের মাথাতেই প্রশ্নগুলো কিলবিল করছিল।
কয়েকদিন নতুনভাবে জানাজানির পালা চালিয়ে দুই বন্ধু আবিষ্কার করল যে, বলার মতো কথা আর তাদের ঝুলিতে নেই। এ রকম আবহ অলক্ষণে, একঘেয়েমি আসে আর হতাশা ভর করে। তাই ওরা ছলনার আশ্রয় নেয়। পেটে লাল তরল পদার্থ ঢাললে কথার তুবড়ি ছোটে। সুতরাং তারা নিয়মিত বিরতিতে মিলিত হয় পানশালায়।
সময় তখন থমকে দাঁড়ায়, ব্যস্ত জীবনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে হঠাৎ হঠাৎ এ রকম থমকানো সময়টাকে তারা উপভোগ করে।
দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ হয় মূলত মদ্যপান ঘিরেই। জড়তা মিশ্রিত অনিশ্চিত জীবনের বিবরে জোয়াল টানা গোরুর মতো দিনমান শ্রম দিয়ে দিন শেষে ঘাস-বিচালি চিবোনোর মতো বিলাসিতা।
পানশালা থেকে বেরিয়ে অনিয়মিত পদক্ষেপে চলল দু’জন, নিজ বাসভূমে থাকতে নিরুদ্দিষ্ট চলার মতো। মদের প্রভাবে আতা বেসামাল হয়ে পড়েছিল। সে হাস্যকর ভঙ্গিতে ডেন্টোনিয়া মাঠের প্রান্তে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে গেল আর বদরুল বিস্রস্ত ভঙ্গিতে ফিরে এলো তার খুপড়িতে।


খদ্দেরদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা জিনিসগুলো তুলে ট্রলিতে টেনে আইলে তুলে রাখছিল বদরুল। এই সময় জাকির এগিয়ে এসে বলল, ‘শুনেছেন নাকি বড় একটা স্নো স্টর্ম হবে?’
‘না তো, কবে!’
‘শুনেননি! আজ মধ্যরাতে… বেশ বড়সড় স্টর্ম।’
জাকির একগাল হেসে বলল, ‘ভাগ্যিস আমাদের ফ্লাইট আগামীকাল।’
কথাটা বলে সে সারি সারি আইলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ট্রলির হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে বদরুল। ভ্যালু ভিলেজের এন্ট্রান্সের বিশাল কাচ গলে বাইরে তাকায় সে। মানস চোখে দেখতে পায় একটি চিরপরিচিত শহরের দৃশ্যাবলি–যে শহরটাকে সে নিজ হাতের তালুর মতো চেনে।
প্রতি বছর জানুয়ারিতে সপরিবারে বাংলাদেশে যায় জাকির। এ রকম সময় তার কবে আসবে? জাকিরের মতো বাড়ি-গাড়ি থাকবে আর বাংলাদেশে পাড়ি দেওয়ার মতো অর্থ থাকবে?
দুপুর একটায় বিদেয় নিয়ে চলে গেল জাকির। এক মাস পরে আসবে। জাকিরের শূন্যতা পূরণে ফ্লোর থেকে সরিয়ে আরেকজনকে ক্যাশে দেওয়া হয়েছে। ফ্লোরের ঘাটতি পূরণের জন্য বদরুলকে দুই ঘণ্টা বেশি কাজ করতে হবে। তার জন্য সে বাড়তি ডলার পাবে। কিন্তু সে পুলকিত হতে পারল না।
জাকিরের নিষ্ক্রমণ মনের পটে বিষণ্ণ আদিম এক গুহাচিত্রের জন্ম দিল।
ভারি ট্রলি স্টোরের অন্যপ্রান্তে ঠেলে নিয়ে যায় বদরুল। চাকরিতে নেওয়ার সময় বলেই নেওয়া হয়েছিল ন্যূনতম চল্লিশ কেজি মাল হ্যান্ডল করার সামর্থ্য থাকতে হবে আর ট্রলি ঠেলার যোগ্যতা থাকতে হবে। বাংলাদেশে কুলিমজুরেরও এত যোগ্যতা আছে কিনা বদরুলের জানা নেই। কিন্তু বদরুলের নিজের আছে! সেটা আগে ওর জানা ছিলনা!
স্টোরটা ল্যান্সডাউন স্ট্রিটে। সাবওয়ে ট্রেনে ল্যান্সডাউন স্টেশনে নেমে সামান্য হাঁটাপথের পর তার রুজি-রোজগারের ক্ষেত্র। সপ্তাহে পাঁচ দিন ডিউটি করে। শিফটিং ডিউটি, রাতেও ডিউটি থাকে। গাড়িতে করে মালপত্র আসে স্টোরে, সেসব নামাতে হয়। দোকানের পেছনের স্টোর থেকে ট্রলিতে জিনিস টেনে আনা, জিনিসপত্র তাকে তুলে রাখা, কাস্টমারদের ঘাঁটাঘাঁটির পর পণ্যসামগ্রী ঠিক করে রাখার কাজ।
ভ্যালু ভিলেজ ব্যবহৃত ও ডোনেশন থেকে প্রাপ্ত জিনিসপত্তর বিক্রি করে।


বদরুল ট্রলি ঠেলে সারি সারি তাকের দিকে অগ্রসর হয়। ঝড় হবে, একটা দুর্বিনীত তুষার ঝড় হবে মধ্যরাতে, তার আগে কি বাসায় পৌঁছাতে পারবে?
পুরো ঝড়টা ওর ওপর দিয়ে যায়নি। ঝড়ের তীব্রতা ছড়িয়ে দেওয়ার আগে প্রকৃতি তুষার ঝরানোর মহরত করছিল। সেই সময়টাতেই বদরুল প্রকৃতির সাথে দ্বৈতযুদ্ধ চালিয়ে কোনোক্রমে বাসায় সেঁধল। বউকে না জাগিয়ে সটান শুয়ে পড়ে বদরুল। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে একটা অতৃপ্ত-অস্থির মুখ ভাসে মানসপটে–সেই মুখ ছবির।
ছবি খিটখিটে হয়ে গেছে। সন্তানাদি থাকলে হয়তো ছবি এমন তিরিক্ষে হতো না। যখন সন্তান নেবে ভাবছিল ওরা, তখন এই দেশে আগমনের সুযোগ ঘটে। আগমনের পর দু’জনেরই কাজে যোগ দেওয়া ও গোছাতে গিয়ে বাচ্চা নেওয়ার বিষয়টি পেছিয়ে গেছে।
একেক সময় মনে হয়, সে কি কোনো ভুল করল? দিব্যি চলে যাচ্ছিল দিনগুলো! ছবি কখনো কোনোকিছুর জন্য গোস্বা করেনি বা ওর ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি। তবে কেন বিভুঁইয়ে পাড়ি দেওয়ার দুর্মতি তার জাগল? ভাড়া করা ফ্ল্যাটে আনন্দে আবেশে দিনগুলো তরতর করে বয়ে চলছিল…।
বাস্তব ও কল্পনার সংঘাতে এখানে আগমনের শুরুতেই ছবি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। বলেছিল‒‘এ রকম নির্মম জীবন!’ ছবি কেঁদে ফেলে বলেছিল‒‘কেন তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে?’
বদরুল বলেছিল: ‘দুই তিন বছর এ রকমই কাটবে, তারপর সুখের মুখ দেখতে পাবে।
‘দরকার নেই আমার এ রকম সুখের। আমি চলে যাব বাংলাদেশে।’
কিন্তু যায়নি ছবি। বরং যখন দেখল, বদরুলের সামান্য রোজগারে সংসার চলছে না তখন নিজেই কাজ নেওয়ার মনস্থ করল এবং জোগাড় করে নিল সাধারণ লেবারের কাজ।

…রাতের তাণ্ডবের পর সকালে ধার কমল তুষারপাতের। তাপমাত্রা মাইনাস সতেরো। সকালে ছবি জানাল, সারা রাত বদরুল নাকি মড়ার মতো ঘুমিয়েছে। ছবি জিজ্ঞেস করল, ‘কালরাতে কী হয়েছিল তোমার?’
‘কেন!’ বদরুল সপ্রশ্ন চোখে তাকায়।
‘তুষার ঝড় হচ্ছিল, কেমন ভয়-ভয় করছিল। তোমাকে জাগাতে চেষ্টা করলাম, তুমি জাগোনি। রাতে ডিউটি থেকে ফিরে এসে কিছু খাওনি।’
‘গত রাতে কাজ শেষে বের হয়ে চমকে গেলাম,’ বদরুল বর্ণনা করে চলল, ‘তীরের ফলার মতো এসে আঘাত করছিল ঠাণ্ডা বাতাস। তুষার জমে সবকিছু সাদা হয়ে গেছে। পা ডুবে গেল তুষারের ভেতর। কোনোক্রমে টেনে টেনে ল্যান্সডাউন স্টেশনে এলাম। ঠাণ্ডায় চোখের পাতাসুদ্ধ অবশ হয়ে গেল। রাস্তায় অনেক গাড়ি আটকা পড়ে ছিল।’
‘খিচুড়ি রান্না করেছি। খেয়ে ডিউটিতে যাও। নাকি ডিউটি নেই আজ?’
‘আছে। তবে খিচুড়ি খেয়ে একটু বিশ্রাম করে রওনা দিতে পারব। আজ হঠাৎ খিচুড়ি রাঁধলে যে!’
‘খেতে মন চাইল, তাই।’
‘তোমার মন যেন সব সময় এ রকমটি চায়।’
‘আর তোমার মন কেমন চাইবে বলে আমি আশা করব?’
‘আমার মন যেন চায় আমি যেন আরও বেশি ডলার রোজগার করতে পারি।’
‘ডলার বেশি রোজগার করতে সবাই-ই চায়। কিন্তু তোমার মন আর কিছু চায় না?’
‘চায়, ছবি। মনটা চায় একটু ঘুরে আসি কোথাও। বাইরে গিয়ে খাই অথবা ইটন সেন্টারে গিয়ে কেনাকাটা করি। কিন্তু তোমার আমার টাইম তো মেলে না। রবিবারে তোমার বন্ধ। কিন্তু আমার ডিউটি থাকে।’
‘হুম।’ বলে ছবি কিচেনের দিকে গেল।
ছবি থালায় করে খিচুড়ি আর গোরুর গোশতের তরকারি নিয়ে এলো। বদরুল তৃপ্তির সাথে খিচুড়ি খেতে খেতে ভাবল‒আজ বউয়ের মনটা ভালো। কিন্তু কেন ভালো, সেটা ভেবে পেল না।
দুপুরের পর ডিউটিতে রওনা হয়ে সাবওয়েতে পা দিয়েই মনে পড়ল ছবির মনটা কেন ভালো ছিল। আজ ওর জন্মদিন। সাধারণত জন্মদিনে স্বামী উইশ না করলে স্ত্রীর মন খারাপ থাকে। অভিমানও থাকে স্বামী কেন স্ত্রীর জন্মদিন মনে রাখতে পারে না। কিন্তু ছবির মন উইশ না করার পরও কেন ভালো ছিল, কেন সে খিচুড়ি রান্না করল‒বিষয়টা বদরুলকে ভাবিয়ে তুলল। সেলফোনও নেই যে, ফোন করে উইশ করবে।
সেলফোন নিয়েছিল সে, অত্যধিক বিলের কারণে বন্ধ করে দিয়েছে। হোমফোন ও ইন্টারনেটের বিল মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে সে।
ল্যান্সডাউন সাবওয়েতে নেমে বেল কোম্পানির বুথ থেকে বাসায় ফোন করল বদরুল। ছবি ফোন ধরল।
বদরুল বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে। তোমার জন্য কী গিফট আনব?’
‘কোনো গিফট লাগবে না।’
‘রাগ করেছ?’
‘না।’


কনকনে ঠাণ্ডা থাকলেও সেই দিনটা ছিল রৌদ্র করোজ্জ্বল। বদরুল রাতে ডিউটি সেরে এসে যথারীতি বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছিল। সে ছবির ফিরে আসবার অপেক্ষায় ছিল আর সেই রাতটার কথা ভাবছিল, ঝড়ের পরের রাতটা–যেরাতে বদরুল ডিউটি থেকে ফিরে এসেছিল হাতে এলিজাবেথ আর্ডেনের পারফিউম নিয়ে।
ছবি বলেছিল, ‘কী দরকার ছিল, কেন এত দাম দিয়ে কিনতে গেলে?’
ছবির বলার মধ্যে ছিল তাচ্ছিল্য ও কৌতুক। মুখের মধ্যে ছিল না ন্যূনতম হাসি। বদরুল খেপে গিয়ে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে সব সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছো।’ ব্যস, তারপর উভয়ের পক্ষ থেকে চলেছিল অগ্নিঝরা বাক্য বর্ষণ।
এমন সুন্দর দিন! বদরুল মুগ্ধচিত্তে তাকিয়ে দেখল স্বর্ণালি দিনটাকে এবং স্থির করল আজ বাইরে খাবে। ডে অফ তার। ছবি ডিউটি থেকে ফিরে আসবে বিকেল তিনটায়। দিনটা গান শুনে ও ইন্টারনেট ঘেঁটে কাটিয়ে দিল বদরুল। বেইসমেন্টের ফোকর দিয়ে একটু দূরের পার্কিংলটে বারবার নজর দিতে লাগল– ওদিক দিয়েই আসবে ছবি। একটা আজদাহা কালো গাড়িকে থামতে দেখল সে। গাড়িটা থেকে নামল ছবি।
‘রিজিয়া আপার গাড়ি বুঝি?’ বদরুল জিজ্ঞেস করল।
‘না,’ ছবি ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে আয়নার কাছে এসে কানের দুল খুলতে খুলতে বলল, ‘গাড়িটা এদিকেই আসছিল, সুপারভাইজর আমাকে একটা রাইড দিল।’
‘তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আজ আমরা বাইরে ডিনার সারব। ডাউন-টাউনে। স্যালাড কিংয়ের খাবারগুলো খুব মজার। থাই রেস্তোরাঁ–অনেক রকমের স্পাইসি খাবার। হট থাই নুডলস, বিফ স্যাটে, সোর শ্রিম্প, সুপ–এসব।’
‘অন্যদিন। সারাদিন খাটাখুটি করে এখন এসব খেতে যাবার রুচি নেই।’
‘এখন কেন, আমরা ছ’টায় রওনা হব। তুমি যথেষ্ট সময় পাবে রেস্ট করার।’
‘ভীষণ ক্লান্ত আমি। যেতে চাচ্ছি না।’
বদরুল হোঁচট খেল। সাবওয়েতে চড়ে তারপর পায়ে হেঁটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার মতো দম আর রুচি নেই ছবির। বদরুলের ভঙ্গপ্রবণ মন দলিত হলো–ছবি কি মজে গেছে কোনো কুহকী বেড়াজালে?
বদরুল লক্ষ করেছে, ওর অসম বান্ধবী প্রৌঢ়া রিজিয়া আপা ফোন করলে ছবি এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে যায়। ছবিকে ছাড়া নাকি তার শপিং পরিপূর্ণ হয় না। রিজিয়া আপা একটা উপকার করেছেন এটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে রিজিয়া আপা ডাকলে দৌড়ে যাবে আর সে একটা শখ করলে, তা পূরণ করার ইচ্ছে ও সময় ছবির হয় না! বিধবা রিজিয়া আপা স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে বহুবছর যাবৎ টরোন্টোয় থিতু। তার পরিচয়ের গণ্ডি বিস্তৃত। এক পরিচিতজনকে
ধরে তিনি ছবিকে কারখানার কাজটা ম্যানেজ করে দিয়েছেন। বদরুল আর ছবি যখন চোখে অন্ধকার দেখছিল, সেই সময় ছবি প্রতিবেশিনী আপার কাছে মনের কথাটা খুলে বলেছিল।
সে যখন বাইরে খাওয়ার কথা বলল, ছবি তখন রহস্যময়ী ক্লান্ত! ছবির অবজ্ঞা আর উদাসীনতায় বদরুল নিজকে কোথাও খুঁজে পায় না; দুটি সত্তার অম্ল-মধুর ক্ষুদ্র গণ্ডিটাকে বিরূপ ও অচেনা লাগে।
ছবি কোন্ অন্ধকার বিবরে প্রবেশ করছে! কেন সে অচেনা হয়ে যাচ্ছে! তাহলে কি ফিরে যাওয়া উচিৎ? কদম ফুলের দেশে, আম-কাঁঠালের দেশে? স্বজন ও জীবনানন্দের দেশে?
বদরুলের মনে হয়, সে যেন কৃষ্ণ বিবরের টানে ক্রমেই নিপতিত হচ্ছে গহিন আঁধারে, এমন এক আঁধার যা থেকে কোনো কিছু, এমনকি আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না। হয়তো সে-ও তলিয়ে যাবে, আর ফিরে আসতে পারবে না…।


ভারী জ্যাকেট গায়ে দিয়ে, গ্লাভসে হাত গলিয়ে বদরুল একাই বাইরে বেরুল। ভাবছিল, হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় বিশাল কালো গাড়ির ভেতরকার উষ্ণতার তুলনায় তার প্রস্তাবটা ছিল নিতান্তই আটপৌঢ়ে ছিল। ঠাণ্ডায় কেঁপে সাবওয়ে পর্যন্ত হেঁটে তারপর আবার পথ চলে রেস্তোরাঁয় খেতে যেতে কার মন আকুলিবিকুলি করবে!
এখানে ‘হাই-হ্যালো’ বলার মতো দুয়েকজনের সাথে পরিচয় আছে। কিন্তু রোদ্দুরমাখা একটি দিনের আবেশ নিয়ে কথা বলার মতো কেউ নেই বদরুলের। শেষবার মদ্যপানের পর কোনো রকম জানান না দিয়েই আতা লাপাত্তা হয়ে গেল। সেলফোনে কল দিয়েও সাড়া না পেয়ে বদরুল ধন্ধে পড়ল। কোথায় গা ঢাকা দিল লোকটা!
দেশে ফিরে গিয়ে ‘আতশবাজি’র পাল্লাতে পড়ার কথাও নয়। কারণ ক’দিন আগে জাকিরের সাথে আতার দেখা হয়েছিল এগলিংটন স্কোয়ারে।

অকৃতদার আতা আগে কাছাকাছি এলডন অ্যাভেনিউতে আরও দু’জনের সাথে শেয়ারে থাকত। সম্প্রতি সে বাসা বদলে চলে গেছে তার কর্মক্ষেত্রের কাছে একটা ব্যাচেলরস রুমে। ঠিকানাটা বদরুল জানে না।
বদরুল ডেন্টোনিয়া মাঠের কিনারে রাস্তা ঘেঁষা গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের আইস ছোড়াছুড়ির খেলা দেখছিল। সে অতীত ভূমিতে চারণ করতে থাকে। দেশে কনস্ট্রাকশন ফার্মের দিনগুলোতে আতা আর সে একসাথে অফিসের কাজে বেরিয়ে যেত, লাঞ্চ সারত রেস্তোরাঁয় আর সরকারি দপ্তরের চক্রজাল ভেদ করে কঠিন কাজগুলো সমাধা করে নিয়ে আসত। দু’জনই ছিল তরুণ ও অবিবাহিত। আতা দু’বছর ওর সাথে চাকরি করে পরে বিদেশে পাড়ি দেয়। তারপর আর যোগাযোগ হয়নি।
যোগাযোগ হলো এই দেশে এসে।

ঘড়ি দেখে বদরুল সাড়ে চারটা। একটু পরেই স্বর্ণালি আভা হারিয়ে গিয়ে অন্ধকার নামবে। তখন সে যাবে নিষিদ্ধ স্থানে; অন্ধকারেই নাকি ড্রিংক জমে ভালো। কেন জমে, বদরুলের জানা নেই। জগতের সব রকম অশুভ কাজ রাতেই সংঘটিত হয় বলে কি? ড্রিংকস করাটা যেহেতু তার মজ্জায় নেই আর তদুপরি আছে ধর্মীয় অনুশাসন‒তাই ড্রিংকস করাটা অশুভ কাজ বৈকি। পকেট হাতড়ে পার্স বের করে ডলারগুলো দেখে নিল বদরুল।
রোদ নিস্তেজ হচ্ছিল। খুব জমত আতা সাথে থাকলে। বদরুলের ভেতরে খেলে যাচ্ছিল বিকৃষ্টির ঢেউ। সবকিছু–বউ, সংসার, ঘর ছেড়ে সে যদি নিরুদ্দিষ্ট হতে পারত!

***
ধবল বরফের বুকে ছায়ার নড়াচড়া দেখে ছায়াটাকে অনুসরণ করে চমকে উঠল বদরুল– আতা! বদরুলকে দেখে দন্ত বিকশিত করল আতা। বদরুলও হাসি উপহার দিল। বলল, ‘কী ব্যাপার, কোনো পাত্তা নেই, ফোনেও পাইনা!
‘সেটটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, ওইটাতে আপনার নাম্বার ছিল। আরেকটা ফোন নিয়েছি। কিন্তু আপনার নাম্বার নেই বলে কল দিতে পারিনি। খুব আফসোস হচ্ছিল আপনার সাথে দেখা না হওয়ায়। আপনার বাসাটাও চিনি না যে, গিয়ে যোগাযোগ করব।’
‘আসলে দুইজনের দেখা হলে তো মগ্ন থাকতাম গপ্পোগুজবে, তাই কেউ কারুর বাসা চেনার মতো প্রয়োজন অনুভব করিনি। অথচ চেনাটা জরুরি ছিল। চলুন, একদিন আমার খুপড়িতে আসবেন।’ বদরুল একটানা কথা বলে থামল।
‘বাসা চেনাচেনির পর্ব থাকুক, কোন্ দিন কোথায় থাকি, তার কি ঠিক আছে?’ এই তো ক’দিন আগেও আপনার কাছাকাছি থাকতাম, আর এখন কতদূরে। সেই লরেন্স ইস্টে।’ হাসল আতা।
বদরুল সামান্য কেশে বলল, ‘শুনলাম, চাকরিতে প্রমোশন হয়েছে, নতুন গাড়িও কিনেছেন।’
‘কোথায় শুনলেন এসব!’
‘জাকির ভাইয়ের কাছে, ভ্যালু ভিলেজে আমার কলিগ।’
‘ও জাকির ভাই, তার না বাংলাদেশে যাওয়ার কথা?’
‘চলে গেছে। ভালোই আছেন মনে হচ্ছে?’ আতার সুখি-সুখি মুখের দিকে তাকিয়ে বলল বদরুল।

‘এই আর কী, চাকরিক্ষেত্রে সামান্য পদোন্নতি হয়েছে।’ আতার চোখে-মুখে তৃপ্তির ছটা।
বদরুল আন্তরিক হাসি দিয়ে বলল, ‘খুশি হলাম।’ পরক্ষণেই নিজের দুর্দশায় ম্রিয়মাণ হয়ে বলল, ‘আমি স্বর্ণমৃগের পেছনে ছুটছি, হয়তো দেখা পাব না এই জনমে।’
‘মন খারাপ করবেন না। ভালো একটা কিছু নিশ্চয়ই হবে। চলুন আপনার মন ভালো করে দিই। আজ গ্রিক রেস্তোরাঁয় চলুন, জম্পেশ খানা আর লালপানি সাঁটব।’
‘ভালোই তো হয়।’ বদরুল দেঁতো হেসে বলল, ‘গ্রিক রেস্তোরাঁতেই যাওয়া যাক। কোথায় সেটা?’
‘ডাউন-টাউনে। একটানে চলে যাব।’

আতাকে অনুসরণ করে মাঠের পাশের পার্কিংয়ে চোখ যেতেই বদরুলের মুখ পাংশু হয়ে গেল। ঢোক গিলল সে। একটা কালো রঙের ডজ ক্যারাভানের কাছে গিয়ে রিমোট কন্ট্রোল কি’র বাটন টিপে দিল আতা। বদরুল তার বেইসমেন্টের ফোকর দিয়ে কয়েকদিন ছবিকে জুতোর কালির মতো এই কালো গাড়িটা থেকে নামতে দেখেছে।
চরকির মতো ঘুরে দাঁড়ায় বদরুল। তারপর ঝড়ের বেগে ছুটে চলল। অস্থি সন্ধি লাট খায়, তবু সে ছুটে চলে মিশমিশে কৃষ্ণ বিবরের পানে।

গল্পটি পাঠিয়েছেন—হাসান জাহিদ ( 515-7 Crescent Place, Toronto, ON M4C 5L7 Canada.) থেকে।

দুঃখিত!