কুটুস ও ভিখারী

কুটুস ছোট্ট একটা ছেলে.কতই বা বয়স হবে–পাঁচ কিম্বা ছয়!
ক্লাস ওয়ান স্ট্যান্‌ডারডে উঠলো এবার.খুব চঞ্চল,কারো কথা শুনতে চায় না। সব সময়, ঘরময় দাপিয়ে চলেছে.মা কুটুর,কুটুস ডাকতেই থাকেন–কে কার কথা শোনে!পাড়া পড়শী আশ পাশের সব ঘরেই তার অবাধ গতি,এমন ছটফট সুন্দর বাচ্চা সবারই ভালো লাগে.

মা বাবার একমাত্র ছেলে,আবদারে আবদারে সব সময় তটস্থ করে রাখে মা  বাবাকে। যতটা পারেন তাঁরা ওর আব্দার রক্ষা করে চলেন. সবার সঙ্গে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মিলে মিশে যায় কুটুস।পাড়ার কে না তাকে ভালবাসে– লোকুদা থেকে শুরু করে নীলেশ,পাখী,চয়ন,তরুণ এমনি অনেক অনেক দাদা দিদিরা আর তেমনি আঙ্কেল আন্টির দলের শেষ নেই।

সকাল বেলা থেকেই বায়না ধরেছে ক্রিকেটের ব্যাট বল চাই, এবং তা আজই্‌, এখনি। অনেক বোঝানোর পর ঠিক হলো এখনি তো আনতে যাওয়া সম্ভব নয়,আজ বিকেলে অবশ্যই ব্যাট বল এসে যাবে কুটুসের জন্য। সময়মত ব্যাট বল এলো এবং খেলা শুরু হয়ে গেলো । বাবা আর ছেলেতে। মাকেও খেলায় যোগ দানের জন্য অনেক বলেছিল কুটুস।ঘরের অনেক কাজের অজুহাতে মা খেলার হাত থেকে পার পেয়ে যান। অগত্যা বাবার সঙ্গে কিছু সময় খেলে পারার দাদা দিদিদের জুটিয়ে মাঠে নামে কুটুস।

এমনি ভাবে দু তিন দিন চলতে থাকে খেলার দৌড়.কত দিন আর এক খেলা ভালো লাগে!ক্রিকেটের পরে ওর পিংপং বল ব্যাট চাই,কখনো ছবি আঁকার ঝোঁক এলো তো চাই রং পেন্সিল,তুলি  রং সব কিছু।

এমনি দিনে পরিচিত বিশু ভিখারী দরজায় এসে দাঁড়ালো। বিশু ভিখারীকে এখানকার সবাই চেনে। তিন চার মাস ধরে ও এ পাড়ায় ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। হাসি খুশি মুখ.একটা  পা একটু টেনে চলে.বাচ্চাদের সাথে খুব ভাব তার.ছোট বড় নানা রকম গল্প ফেঁদে বাচ্চাদের খুব জমিয়ে রাখে.কোনো ঘর থেকেই সে খালি হাতে ফেরে না।পয়সা,খাবার,কাপড় চোপর, সবই সে বাড়ি বাড়ি থেকে পেয়ে যায় ।প্রয়োজনে বাঁকা পা টেনেই দু চার মিনিট কুটুসের সঙ্গে খেলতে নেমে পড়ে।

বিশু ভিখারীর হাতে সর্বদা একটা লাঠি থাকে। পা সোজা করে চলতে পারে না,লাঠির সাহায্য নিতে হয়।ও থাকে দু কিলোমিটার দুরে–বিলহারী গ্রামে। এ দু কিলোমিটার ও ভিক্ষা করতে  করতে এসে যায়।ভিক্ষা করে যা পায় ওর মত একজন লোকের ভালো ভাবে চলে যায়.বিশুর  বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে.তবু বাচ্চা সুলভ ব্যবহারের জন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খুব ভাব।

সে  দিন সকাল বেলা,ঘড়ির কাঁটায় বেলা বারটা। কুটুসের মা কুটুসের স্নান করান এ সময়, কুটুস ওরা মাঠে খেলছিল,সঙ্গে দাদা,দিদিদের দল–ওই নীলেশ,চয়ন,পাখীদের সঙ্গেই খেলছিল,বিশু ভিখারীও বাচ্চাদের খেলায় কিছু ক্ষনের জন্য যোগ দিয়ে ছিলো। মাঠে এসে কুটুসের মা কুটুসকে দেখতে পেলেন না.নীলেশ,চয়ন,পাখী ওরা কুটুসের ব্যাট বল নিয়ে খেলে চলেছে,কিন্তু যার ব্যাট বল সেই অনুপস্থিত।

 

কুটুস কই রে নীলেশ?কুটুসের মার প্রশ্নে নীলেশ এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে বলে,আমাদের সঙ্গেই তো খেলছিল ও,গেছে হয়ত আশেপাশে,বলে আবার খেলতে লেগে গেল।

কুটুসের মা,কুটুস,কুটুস,ডাকতে ডাকতে আশপাশে বাড়িতে খুঁজতে বের হলেন। স্নানের সময় হয়ে গেল,কোথায় যে গেল ছেলেটা!দিন ভর খেলা,খেলা,আর খেলা– একটুক্ষণ যদি ঘরে থাকে,মনে মনে কথাগুলি আওড়াতে থাকেন আর খুঁজে বেড়াতে থাকেন ছেলেকে।

এক ঘন্টার মত খোঁজার পর যখন ছেলের দেখা মিল না,মার মনে এবার চিন্তা হতে লাগলো.চয়ন,পাখী,নীলেশ সবাই আশেপাশে কুটুসকে খুঁজতে বের হলো। কেউ বলল,যাবে কোথায়,দেখো,কারো ঘরে চুপ করে বসে হয়ত খেলছে!এমনি হয়, দেখা যায় কারো ঘর থেকে খেলেটেলে বেরিয়ে আসছে কুটুস। কিন্তু দীর্ঘ এক ঘন্টার ওপরেও যখন কুটুসের খোঁজ পাওয়া গেল না,মা,বাবা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এ পাড়া, সে পাড়া,গলি ঘুপচি কোথাও তার খোঁজ পাওয়া গেলো না। কুটুস কোথাও নেই,কুটুসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না.হন্যে হয়ে সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে, অনেক সময় হয়ে গেছে সে নেই। মা কাঁদতে লাগলেন,বাবা হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন.আশপাশের সবাই ভালোবাসে কুটুসকে,ওরা সবাই কোথাও না কোথাও খোঁজায় ব্যস্ত হোয়ে গেলো।কুটুস নেই।এখানে নেই। ওখানে নেই। কুটুস কোথাও নেই। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলল । কুটুসের বাবা রমেনের বন্ধু,এখানকার পুলিশ সুপার.তাঁকেও খবর দেওয়া হয়েছে–সে  মত পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে।ও দিকে বিলহারি গ্রামে বিশু ভিখারী যেখানে থাকত খোঁজ নেওয়া হয়েছে.সকাল থেকে ও নাকি ঘরে নেই.ভিখারী বাইরে বাইরে ঘুরতে পারে–এমন কি এক আধ দিন ঘরে নাও আসতে পারে,কাজেই সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘরে না আসার জন্য কুটুসের হারানোর ব্যাপারে ও জড়িত এটা বলা সম্ভব নয়.পুলিশ খুঁজছে — আর যেহেতু পুলিশ সুপার রমেনের বন্ধু–খোঁজা খুঁজির দিক থেকে কোনো ঢিল হবে বলে  মনে হয় না।

কুটুসের বাড়িতে কান্না কাটির রোল পড়ে গেলো.বাবা মা দুজনেই কাঁদছেন.পড়শীরা যাঁরা আসছেন–চঞ্চল অস্থির সবার সঙ্গে এত সহজে মিলে মিশে যাওয়া একটা জলজ্যন্ত ছেলের এমনি হটাত হারিয়ে যাওয়ায় চোখে জল রাখতে পারছেন না.

ট্রেন মুম্বাইয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে,বিশু ভিখারী ধোপদুরস্ত হোয়ে বসে আছে ট্রেনের সিটে, পাশে বসে আছে কুটুস।
–আর কতদুর তোমার মুম্বাই?অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠে কুটুস,আমরা কখন ঘরে ফিরব?
এমনি একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে।
–আমাদের ট্রেন অনেক দেরী করে ফেলল,তাই আজ আর আমরা ঘরে ফিরতে পারব না, কাল মুম্বাই ঘুরে দেখবো,আর সন্ধ্যের মধ্যেই ঘরে ফিরে আসবো,কেমন?বিশু ভিখারী অনেক  বুঝিয়ে যাচ্ছে কুটুসকে.শত শত প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।
বিশুর এখন ভিখারীর বেশ নেই.অন্য সাধারণ লোকের মতই তার বেশভূষা.পা টান টান করে চলার বদলে দিব্বি পা স্বাভাবিক রেখেই চলা ফেরা করছে.আর কুটুসের চেহারা বেশ- বাশ এমন রাখা হয়েছে যে কেউ বলতে পারবে না এক ভিখারী ছেলে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে!

প্রায় রাত দশটার সময় ওরা পৌঁছালো মুম্বাই.তারপর ট্যাক্সিতে এক ঘন্টা ধরে অনেক রাস্তা পার হয়ে সোজা পৌঁছে গেলো বিশু নিজেদের আড্ডায়। কুটুস তখন ঘুমে আচ্ছন্ন,বিশু ওরফে বিশ্বনাথ রাস্তায় ওকে এটা ওটা কিনে খায়িয়েছে.ভোলাবার জন্য তাকে কম অভিনয় করতে হয়নি!তিন মাসের ওপর থাকতে হয়েছে জবলপুরের বিলহারীর মত গ্রামে!কত ছেলে, কত লোকদের সঙ্গে ভাব করতে হয়েছে.অনেক পটিয়ে পাটিয়ে কুটুসকে নিয়ে আসতে পেরেছে। আড্ডা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে যখন,তখন পুরোপুরি কাজ তার শেষ।

 

বিরাট বড় ফুটবল মাঠের মত,চারিদিকে পাকা দেওয়াল দিয়ে জাগাটা ঘেরা। তার মধ্যে এক কোনায় তিন চারটে ঘর,ঘরগুলি দেখলে অনেক পুরনো মনে হয়.বাইরে থেকে একটা ঘরে খুব
কম পাওয়ারের আলো দেখা যাচ্ছিল। বিশ্বনাথ কুটুসকে কোলে নিয়ে আলো জ্বালা ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে গেলো.দরজা ধাক্কা দিয়ে চাপা স্বরে ডাকতে লাগলো,জগুভাই! জগুভাই!

দু তিনবার ডাক দেবার পর ঘরের ভিতর থেকে ‘কৌন?’ বলে খুব গম্ভীর আওয়াজ এলো!
–আমি বিশ্বনাথ,দরবাজা খোলো,সাহাব!বিশ্বনাথ বলে.
এ এলাকা রাত দশটা বাজতে না বাজতেই ঝিমোতে থাকে,চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে,–
দুরে দু চারটে ঘরে–টিম টিম করে আলো জ্বলছে,দেখলেই মনে হয় জায়গাটা মুম্বাই মহানগর থেকে অনেক বাইরে। ঘড়.র.র..করে দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেলো.সামনে দাঁড়িয়ে ভীম নাথ,
দলের সাগরেদ.জগু দলের স্থানীয় ম্যানেজার,এখানকার সমস্ত কাজের দযিত্ব ওর ওপর। তারই হেলপার ভীম।
–অন্দর আ যা,ভীম চাপা স্বরে বলে ওঠে।
কাঁধে ঘুমন্ত কুটুসকে নিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে বিশ্বনাথ।জগু এগিয়ে আসে,বলে,
কিরে জিন্দা হায় না?ছোট্ট কুটুস ওদের কথাবার্তায় ঘুমের মধ্যে একবার চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করে,আবছা অন্ধকারে কাউকে চিনতে না পেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে.
–লেড়কা জিন্দা হায়,দেখ লিয়া না?বলে বিশ্বনাথ। অব মেয় জাউংগা,মেরা পয়সা দে দো  সাহাব!।

জগু টাকা এনে বিশ্বনাথের হাতে দিল। বিশ্বনাথ ছেলে পাচারের পাঁচ হাজার টাকা হাতে নিয়ে কুটুসকে ঘরের খাটিয়াতে শুইয়ে
দিয়ে বাইরের অন্ধকারে অদৃশ্য হোয়ে গেলো।

সকাল থেকে কুটুসের হাত মুখ বাঁধা,মুখে কাপড় ঠুসে দেওয়া,যাতে ও চীত্কার করতে না পারে।বড় বড় ষন্ডা গুন্ডা মার্কা লোক এঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে । দীনু,অংকু,ভীম, আনোয়ার এমনি সব নাম ওদের ।এর মধ্যে আনোয়ারের কাজ সব পঙ্গু ছেলে মেয়েদের
সকাল বেলা নিয়ে গিয়ে ভীড় হওয়া রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করার জন্য বসিয়ে আসা । দিন ভর ওরা ভিক্ষা করে,আবার সন্ধ্যের পর আনোয়ার ওদের ঘরে নিয়ে ফেরে । ওদের পাওয়া টাকা পয়সার নব্বই পার্সেন্ট যাবে মালিকের হাতে। বাকী দশ পার্সেন্টে এখানকার কাজ কর্ম চলে.সবার মাইনে,অন্যান্য সমস্ত খরচ। এখানকার মালিককে একমাত্র জগু বলে লোকটাই চেনে। আর কেউ নয়। বাচ্চাদের হাত পা,জীভ কেটে পঙ্গু তৈরী করার কাজ ভীম,দীনু,অংকু ওদের ওপর দেওয়া আছে।

কুটুস গোঁ গোঁ করে চীত্কার করার চেষ্টা করছিল,ভীম এসে তার মাথায় জোরে থাপ্পড় মারলো.বাঁধন খোলার কত না চেষ্টা করছে কুটুস।  কিন্তু পারবে কেন ?জীবনে এত শক্ত বাঁধন পৃথিবীর কোথাও থাকতে পারে সেটা কি ও কোনো দিন চিন্তা করতে পেরে
ছিলো!দু চোখ বেয়ে তার জলের ধারা বয়ে যেতে লাগলো । কতবার সে চীত্কার করে মা বাবার কাছে যেতে চাইল।কোনো শব্দই মুখ থেকে বেরোতে পারলো না। অংকু ভীমকে প্রশ্ন করে,কেয়া নাম উসকা–ইউ.পি.সে জো ছোকরা কো লায়া গয়া?
ভীম উত্তর দেয়,পরেশ নাম হায় উসকা।উসকা আজ তারিখ হায় না?তিন দিন পর আজ এক অংক জাদা হো যায়েগা–ছাব্বিশ হো যায়েঙ্গে।

পরেশকে অংকু,দীনু ওরা নিয়ে গেল,এক কোনার ঘরে। একটু পরেই ওই ঘর থেকে অস্ফুট কান্নার চাপা চীত্কার শোনা গেল । পরেশের জীভ কেটে দিল ওরা,অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ও অজ্ঞান হোয়ে গেলো,আবার ওর মুখে গুঁজে দিল কাপড়ের গোলা । জ্ঞান ফিরে ও যাতে চীত্কার করতে না পারে। পরেশ আর কোনো দিন কথা বলতে পারবে না।
এক মাস কেটে গেলো.ইতিমধ্যে তিনজন বাচ্চাকে শরীরের কোনো অংগ কেটে পঙ্গু বানানো হয়েছে । কুটুসের সময় আসবে–এমনি জল্লাদের দল ওকে নিয়ে যাবে–হাত পা কেটে ফেলবে–আর একদিন কুটুস বাটি হাতে করুণ ভাবে কেঁদে কেঁদে ভিক্ষা  চাইবে–খানা দে ,রোটি দে বাবু!গরীব কো এক পয়সা দে বাবু!…কুটুসের পঙ্গু চেহারা দেখে–হাত পা কাটা এইটুকু একটা ছেলেকে দেখে অনেকের দয়া হবে,পয়সা, কাপড় চোপর,খানা দেবে।

বসের ফোন এলো জগুর কাছে । একমাত্র জগুই এখানে মোবাইল রাখার যোগ্য।
বস বললো,ও ছোটা লেড়কা বশ মে আয়া?–রোনা ধোনা কম কিয়া?
–নেহী, সাহাব..এক দো দিন মে সব ঠিক হো যায়েগা,জগু বলে।
–বাহার সে এক সাহাব আয়েগা,মেরী চিটঠি লে কর,উস্ কে হাত মে লেড়কা কো দে দেনা,ও বিক গয়া। ও আদমী আগলে মাহ উসকো ফরেন লে যায়েগা ।শুন লিয়া না! বলে
বস ফোন রেখে দেয়.
–জী হাঁ–জগুর মুখ থেকে ভয় মাখা উত্তর বের হয়ে আসে।

মাস ঘুরে গেলো,কুটুসের মা বাবা দুঃখে ভেঙে পড়েছেন.মা তো প্রায় সব সময় ছেলের কথা মনে করে কাঁদতে থাকেন।বাবা রমেন ছেলে হারানোর শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রোজ অফিস যাচ্ছেন,ঘরে ফিরছেন আর চুপচাপ ঘরে বসে থাকছেন। এমনি একদিন অফিস থেকে ডিউটি পড়ল বিলাসপুর।দুদিন থাকতে হবে সেখানে।প্রথমে ভাবলেন যাবেন না তিনি,তারপর কি ভেবে যেন তাঁর মনে হলো,যাই একবার ঘুরে আসি– সারা জবলপুরের অলিগলি সব জাগা তো দেখা হয়ে গেল–কে জানে অন্য কোনো জায়গায় অন্য কোনো পথে হঠাত যদি দেখা হোয়ে যায় কুটুসের সঙ্গে!

বিলাসপুর খুব ভোরে পৌঁছালো ট্রেন.ভোরের আলো সবে মাত্র ফুটছে,রমেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একটু দুরে এক ভিখারীকে লাঠি নিয়ে এক পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে হেঁটে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন.ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে লাগলেন,
আরে,বিশু ভিখারী না!দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন.বিশু ভিখারী পালাবার চেষ্টা করেও পালাতে পারল না.রমেন সমস্ত গায়ের জোর দিয়ে বিশুকে ধরে নিলেন,আর চোর,চোর,বলে চীত্কার করতে লাগলেন.স্টেশনে অনেক লোক জড়ো হোয়ে গেলো,রেলের পুলিশ এসে বিশু ভিখারী ওরফে বিশ্বনাথকে ধরলো,রমেন তার বন্ধু পুলিশ সুপারকে ফোন করলেন.জবলপুর থেকে এলো পুলিশদল,ওরা বিশুকে জবলপুর নিয়ে আসলেন.এরপর চলল নানারকম জেরা।

বিশু নিজের অপরাধ স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে ওদের দলের সব কথা ফাঁস করে দিল। পুলিশদল বিশুকে নিয়ে পৌঁছালো মুম্বাই–সেই ছেলে ধরার আড্ডায়। আড্ডার দরজায় রাত্রি এগারটায় পুলিশ ধাক্কা দিল.
–কৌন?ভিতর থেকে জগুর কথা শোনা গেলো।
–হামি জগু সাহাব,এক বাচ্চা লায়া,পুলিশের শেখানো কথা বলে ওঠলো বিশু,আর দরজা খোলা মাত্র পুলিশের দল ধরলো জগুকে। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল আনোয়ার,ভীম,
দীনু। অঙ্কু দেওয়াল টপকে পালাতে গেলো,কিন্তু তার আগেই পুলিশের গুলি বিদ্ধ হলো তার পিঠে।

তিরিশ জন ছেলেকে পেয়ে গেলো পুলিশ,অন্ধ,হাত পা কাটা–পঙ্গু ছেলেদের সংখ্যা ছিলো সাতাশ.বাকী তিন জনের সঙ্গে কুটুস ছিলো অক্ষত অবস্থায়.আর দুটো দিন গেলে বিক্রি হয়ে যাওয়া কুটুসকে বিদেশী লোকটা নিয়ে যেত–কুটুস পৃথিবীর কোনো কোনে হারিয়ে যেত! কেউ তাকে খুঁজে পেত না। তিনজন অক্ষত ছেলেরা ছিলো হাত পা বাঁধা,মুখে তাদের কাপড় গোঁজা ছিলো.কোনোমত
আধ পেটা খেয়ে পড়েছিল তারা–এক সপ্তাহ থেকে এক মাসের ওপর পর্যন্ত! সবাইকে উদ্ধার করল পুলিশ।

কুটুস ঘরে ফিরল।
–কুটুস,কুটুস,বাবা তুই কোথায় ছিলি!কোথায় গিয়ে ছিলি বাবা!বলে,কুটুসকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ল তার মা। দুষ্টু কুটুস,অশান্ত কুটুস,মার কোল জড়িয়ে থাকলো.সে স্তব্ধ রইল,কোনো জবাব মুখ থেকে বের হলো না তার,এই পঁয়ত্রিশ দিনের বন্দী জীবনে যেন তার পঁয়ত্রিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে।

দুঃখিত!