কী কান্ড! — মৈত্রেয়ী নাগঃশেষ অংশ

 

এদিকে ট্রেন থেকে এত লোক নেমেছে একসঙ্গে যে, একটা রিকশাও নেই স্ট্যান্ডে। আগেও দেখেছি গরম বেশি পড়লে, যখন দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়, তখনই রিকশাগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। নইলে তাদের প্যা- পো শব্দে কান তোলা হয়ে যাওয়ার জোগাড়! বিরক্ত হয়ে সবে ভাবছি বেড়াল পরিবারটিকে ব্যাগসমেত বটগাছটার তলায় নামিয়ে দেব কিনা, এমন সময় একটা ধূলিধূসর টাটা সুমে আস্তে হতে হতে আমার সামনেই এসে থামল। যে ঠিকানাটার কথা গাড়ির চালক ভদ্রলোকটি জিজ্ঞেস করলেন আমায়, সেটাই সুমির বিয়ের বাড়ি, আর আমাদের বাড়িটাও সেদিকেই। আমি লজ্জা না করে বলেই বসলাম, একটু যদি লিফট পাওয়া যায়, আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব। ভদ্রলোক অমনি উঠে পড়তে বললেন গাড়িতে, আর আমার মাথার ভিতরের গলার স্বরটা খুশি হয়ে বলে উঠল, এই তো কেমন মানুষ হয়ে গেচিস।

গাড়িতে ওঠার পর থেকে ভদ্রলোকই কেবল কথা বলছিলেন, পাশের মোটামতো ভদ্রমহিলার— তার গিন্নি নির্ঘাত— বোধহয় ভয়ানক সর্দি হয়েছিল। তিনি থেকে থেকেই ভীষণ শব্দ করে নাক টানছিলেন। এদিকে কথা খানিক দূর এগোতেই জানা গেল, এরা সুমির কলকাতার মাসি আর মেসো। এদের কথা আমি অনেক শুনেছি। আমি সুমির বন্ধু শুনে ভদ্রলোক তার গিন্নিকে বললেন, ‘শুনছ, সুমির বন্ধু গো! বিয়ে খেতে এসেছে। একটু কথা বলো!

তা শুনে সুমির মাসি আর কী বলব ভাই, বোনের মেয়ের বিয়ে দেখতে গিয়ে নিজের মেয়েকে হারিয়ে বসে আছি’ বলেই ভেউভেউ করে কেঁদে উঠলেন। তাতে মেসোমশাই খুব অস্বস্তিতে পড়ে বললেন, কিছু মনে কোর না, আসলে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যে কুকুর-বেড়াল নিয়ে ওঠা যায় না, তা জানা ছিল না আমাদের। কালকের ট্রেনে উঠে বসেছি আমাদের মিনুকে নিয়ে….’

এই অব্দি বলতেই মাসিমা ডুকরে উঠে বললেন, শখ করে কি এমন করি? মিনুর যে ছানা হবে যে-কোনও দিন… তা গার্ড কোনও কথা শুনলে না, নড়া ধরে নামিয়ে দিল। মিনু আমার এমন লক্ষ্মী বেড়াল, চুপটি করে ব্যাগের মধ্যে বসেছিল। নেমে এসে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি বাগ ফাঁকা, শুধু বালিশটা পড়ে আছে, মিনু নেই!” বলেই আবার কাঁদতে লাগলেন হাউহাউ করে।

এত কান্নাকাটির মধ্যে আমি আর বলার সুযোগ পেলাম না যে, ওঁদের গল্পের শেষটা হয়তো আমি জানি, তার আগেই বিয়েবাড়ি এসে পড়ল। এদিকে অন্যদিক দিয়ে গায়েহলুদের তত্ত্বও এসে পড়েছে। শাঁখের পুঁ, উলু-উলু আর ফোঁৎ ফোঁৎ কান্নার মধ্যে পড়ে কী করা যায় ভাবছি, এমন সময় আমার মাথার ভেতরের বাসিন্দাটি বলে উঠল, ‘বলবি আর কী, করে দেখা! আমি চট করে দেখলাম বেড়াল পরিবার আরাম করে ঘুমোচ্ছে। আমনি বিগশপারটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে কোনও কথা না বলে ব্যাগটা ধরিয়ে দিলাম মাসির হাতে।

ভাবান্তর অনেক দেখেছি। কিন্তু সেদিন সুমির মাসির চোভের জল ভেজা মুখে যেরকম রঙিন হাসি খেলে গেল, আর ভেউভেউটা যেরকম মুহুর্তে মেউ মেউ মিনু রে, তোর যে দেখি ছানা রে’ হয়ে গেল, তেমনটা আর কখনও দেখিনি।

একটু পরে বাড়ি থেকে সেজেগুজে যখন দুপুরের খাবার খেতে হাজির হলাম বিয়েবাড়িতে, মিনুর গল্প তখন সবার মুখে। বললেন, ‘কী করে এমনটা ঘটল বলো তো? সবটাই কি কাকতাল?’

আমি বললাম, না মেসোমশাই, অনেকটাই ফাঁকতাল। রাতের সবুজ চোখ থেকে শুরু করে ব্যাগ ফাঁক করে ইশারার গল্প—সবটাই বললাম। বিয়েতে বেড়ালছানা উপহার দেওয়ার পরিকল্পনার কথাও বাদ দিলাম না। শুনে মেসো বললেন, ‘বেশ তো, শুধু সুমিকে কেন, তুমিও নিও। কলকাতাতেই তো থাকো এখন। তবে কিনা ছানাগুলো একটু বড় হোক আগে, তখন নিও।”

সুমির মাসি অতশত শোনেননি। উনি বলে চলেছিলেন যে, ওনার মিনুর মতো অমন জ্ঞানবুদ্ধিওয়ালা বেড়াল আর দুটো পাওয়া যাবে না। মিনু নাকি আগে থেকেই সব বুঝতে পেরে আমার সঙ্গে চলে এসেছে। ভূমিকম্প হওয়ার আগে অনেক পশুপাখি যেমন বুঝতে পারে।

আমি এরকম অদ্ভুত কথা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে আছি, এমন সময় আমার মাথার ভেতরকার গুরুটি বললেন, ‘তুই আবার এখন বলে বসিস না, তাহলে অত হাউহাউ করে কাঁদছিলেন কেন গাড়িতে?’ আমি অমনি মনে মনে চোখ মটকে

বললাম, অত বোকা নাকি? হস্টেলের ইঁদুরগুলোকে জব্দ করার এমন সুযোগ আমি তক্ক করে নষ্ট করে দেব?’

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!