গল্পের ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
সবাই মেঝের ওপর গোল হয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছি। ভুলোদার বশংবদ চাকর গোবিন্দ কলা পাতায় গরমগরম খিচুড়ি পরিবেশন করেছে, সঙ্গে ইলিশের গোবদা গোবদা ভাজা পেটি।
আহা! ঝমঝমে বর্ষায় এর চেয়ে উপাদেয় আর কিছু হতে পারে না কি! — উফ্! এই ভানুটা নির্ঘাত মহাভারতের আমলে রাক্ষস ছিল আর ভীমের হাতে মরেছিল, এ জন্মে বদ উকিল হয়েও স্বভাব যায়নি! মনে হচ্ছে হাঁরি কড়াইগুলো অ খেয়ে শেষ করবে আজ! ভানুকে এক গামলা খিচুড়ি তিনটে পেটি দিয়ে শেষ করে এক চোখ বন্ধ করে মনের সুখে কড়মড় করে একটা মুড়ো চিবুচ্ছে দেখে রেণু আর না বলে পারল না। — আহা! ও আর এমন কি খেয়েছে! ভুলদা মাছের ডিমের বড়ায় কামড় দিয়ে বললেন, ফ্রান্সের মাইকেল লোটিটো এক আশ্চর্য মানুষ। ১৯৫৯ সাল থেকে তিনি ধাতু ও কাঁচ খাচ্ছেন। চিকিৎসকরা তাঁর পেটে এক্স-রে করে দেখেছেন তিনি প্রতিদিন ৯০০ গ্রাম ধাতু অনায়াসে খেয়ে হজম করে ফেলতে পারেন।
১৯৬৬ সাল থেকে তিনি যা খেয়েছেন তা হল, ১০টি বাইসাইকেল, সাড়ে চার দিনে একটি ধাতু নির্মিত সুপার মার্কেটের ট্রলি, ৭টা বড় টেলিভিশন সেট, ৬টি ঝাড়লন্ঠন, ভেনজুয়েলার ক্যারাকাসে একটা সেশনা এরোপ্লেন এবং এরকম আরও অনেক কিছু। সে তুলনায় ভানু তো নেহাৎই দুগ্ধপোষ্য শিশু। — বাপ্ রে!! আমাদের চোখ ছানাবড়া।
আষাঢ়ের সন্ধ্যে দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, আড্ডা আর গল্পের মাঝে রেণু আর বলাই-এর দ্বৈতকন্ঠে ‘মধু গন্ধে ভরা, মৃদু স্নিগ্ধ ছায়া —‘ শুনে দিল তর হয়ে গেল। আমরা স্বতঃস্ফুর্ত মনেই হাততালি দিয়ে উঠলাম। — এত সুন্দর গলার গান এইটুকু শুনে কি মন ভরে! ভুলোদা যেন নিজের মনেই বললেন, ১৯৮৯ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত একটানা ২৬২ ঘন্টা গান গেয়েছিলেন প্যাস্টর এস. জেয়াশীলান। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ভারতের রামনাদের এশিয়ান গ্লাসহাউস বিল্ডিং-এ। আর এই হাততালিরও একটা বিশ্বরেকর্ড আছে মনে পড়ে গেল, তামিলনাড়ুর ভি.জয়রামন ১৯৮৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী টানা ৫৮ ঘন্টা ৯ মিনিট হাততালি দিয়েছিলেন। প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬০ বার তালি দিয়েছিলেন।
সারা দিনের জমাটি আড্ডার শেষ পর্বে ভুলোদার প্রিয় মকাইবাড়ি বাগানের দারুণ ফ্লেভারের চা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি আমরা। চায়ে আরাম করে চুমুক দিয়ে কেস থেকে সিগারেট বাছতে বাছতে ভুলোদা বললেন, — দুজন অসাধারণ মানুষের কথা আজ না বললে ভারি অন্যায় হবে বুঝলে!
একজন হলেন পৃথিবীর বিস্ময়কর প্রতিভা মোজার্ট। তিনি তিন বছর বয়সে বীণা বাজান, প্রথম সুর সৃষ্টি করেন পাঁচ বছর বয়সে, প্রথম সোনাটা রচনা করেন সাত বছর বয়সে এবং প্রথম সম্পূর্ণ সিম্ফনী তৈরি করেন আট বছর বয়সে। তিনি প্রতি বছর একটি করে সিম্ফনী তৈরি করেন। মোজার্ট মাত্র পঁচিশ বছর বেঁচে ছিলেন।
এই সামান্য সময়ে তিনি ৬০০-র মত সিম্ফনী, অপেরা, সোনাটা, মাসেস ইত্যাদি সঙ্গীতের বিভিন্ন বিষয় রচনা করে গিয়েছেন। আর একজন হেলেন কেলার। তাঁর নাম তো জানোই তোমরা।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে অন্ধ ও বধির হয়ে যান। ছ’ বছর বয়স থেকে অ্যান সুলিভান নামে এক শিক্ষকের প্রচেষ্টায় তিনি লিখতে ও পড়তে এবং বলতে শেখেন।
পরে তিনি ব্যাদক্লিফ কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৪ সালে অনার্সে সেরা নম্বর নিয়ে স্নাতক হন। তিনি বহু বই লিখেছেন এবং অন্ধ ও বধিরদের উন্নতির জন্য দৃষ্টান্তমূলক কাজ করে গিয়েছেন। আমরা চারজন অর্বাচীন বিস্ময়ে একেবারে হতবাক।
এবার ঘরে ফেরার পালা। দু ঘন্টার টানা বৃষ্টিতে নীচের রাস্তায় জল থৈ থৈ করছে।
বলাই আর আমি যাব উত্তরে, ভানু আর রেণু দক্ষিণে। — এই বর্ষায় গাড়ি-টারি পাওয়ার সম্ভাবনা বোধ হয় নেই, কপালে বহুৎ তকলিফ আজ। অগত্যা ‘থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়, নিমেষে যোজন ফরসা —” বলাই রবি ছেড়ে কাজীদাকে স্মরণ করল। — ওটা কোন ব্যাপারই নয়, ভুলোদা নির্বিকার গলায় বললেন, ১৯০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার যোহান হারলিংগার ভিয়েনা থেকে প্যারিস পর্যন্ত মত ১৪০০ কিলোমিটার পথ পায়ের বদলে হাতে হেঁটে বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। তিনি প্রতিদিন গড়ে ১০ঘন্টা করে মোট ৫৫ দিনে ঐ পথ হেঁটেছিলেন। নীচে নেমে এসে একহাঁটু জল ভেঙে এগোতে এগোতে কোন কষ্ট আর অসুবিধার কথা আর মাথাতেই এলো না।