কিশোর গল্প : জেলে ও মুক্তারানী

সাগরে জাল ফেলতে ফেলতে আর টেনে তুলতে তুলতে জেলের সারাদিন কেটে গেল। সুঠাম, কর্মক্ষম তামাটে রং জেলের মন ভীষণ খারাপ। মন খারাপ না হয়ে উপায় কী? এই যে সে সারাদিন জাল টানল, দিন গড়িয়ে রাত নামল, অথচ সে একটি মাছও পেল না। তাজ্জব ব্যাপার নয় কি? জেলে মন খারাপ করে নদীর তীরে চুপচাপ বসে ভাবতে লাগল।
কী ভাবতে লাগল? এই যে সে সারাদিন সাগরে মাছ ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনও মাছ কেন ধরতে পারল না? এখন সে বাড়ি ফিরবে কী নিয়ে? চাল, ডাল কেনার পয়সা পাবে কোথায়? কোনও মাছ পেলে হয়ত সেই মাছ বিক্রি করে কিছু একটা কিনতে পারত। এখন খালি হাতে সে বাড়ি যাবে কী করে?
জেলে যখন হতাশ মনে এসব ভাবছিল, এমন সময় পানির ওপর ভুস করে ভেসে উঠল বিরাট এক তিমি মাছ। তিমি মাছ জেলেকে উদ্দেশ করে বলল, ‘কী ব্যাপার! মন খারাপ করে কী এত ভাবছ?’
জবাবে জেলে বলল, ‘দেখো দেখি কাণ্ড! সারাদিন জাল টানলাম, অথচ কোনও মাছই পেলাম না। এখন বাড়ি যাব কী নিয়ে? চাল, ডাল কিনব কী দিয়ে? এ জন্যই মন খারাপ। মন ভীষণ খরাপ।’
তিমি মাছ একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘বুঝতে পারছি তোমার সমস্যাটা। এক কাজ করো তুমি। আমার শরীরে একটি হারপুন বিঁধে আছে। আমাকে মারার জন্য এক শিকারি এটি আমার শরীরে গেঁথে দিয়েছে। কিন্তু মারতে পারেনি। হারপুনটি শরীরের সাথে বিঁধে আছে। খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। হারপুনটা তুমি খুলে দাও। আমি তোমাকে অনেক বকশিশ দেব।’
তিমির কথামতো জেলে হারপুনটি খুলে দিল। তিমিও তাকে নিরাশ করল না। বিরাট হা করে সে তীরের কাছাকাছি এসে হঠাৎ উগলে দিল। সেই সাথে ওর পেট থেকে বেরিয়ে এল অনেক বড় মাছ।

 
তারপর তিমি বলল, ‘মাছগুলো নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাও। বাড়ি গিয়ে এগুলোর পেট চিরলেই তোমার ভাগ্য খুলে যাবে। আর প্রতি শুক্রবার একবার এখানে এসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আজ যেভাবে তুমি মাছ পেলে, এমন করে সারা জীবনই পেতে থাকবে। তবে শর্ত হল, এই কথা তুমি কারও কাছে প্রকাশ করতে পারবে না। যদি করো তাহলে তোমার অমঙ্গল হবে।’
তিমির উগলে দেওয়া মাছগুলো নিয়ে জেলে বাড়ি ফিরে এল। বাড়ি পৌঁছার পর এত বড় বড় মাছ দেখে তো জেলে বউয়ের একেবারে আক্কেলগুড়-ম অবস্থা। জেলে বউ খুব পীড়াপীড়ি করল সে যেন ঘটনাটা খুলে বলে। কিন্তু জেলে মুখে কুলুপ এঁটে রইল। কিছুই বলল না বউয়ের কাছে। বলবেই বা কী করে, বলা যে তিমি মাছের বারণ। একটা ভয় আছে না! বললে যদি অমঙ্গল হয়।
তারপর জেলে তার বউকে নিয়ে একে একে মাছগুলোর পেট চিরল। পেট চিরতেই তারা রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গেল। জেলে বউ চিৎকার করে উঠল, ‘ওয়াও! এত এত মুক্তা! আমরা তো ধনী হয়ে গেলাম। আমি যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যি করে বলো তো, স্বপ্ন নয়ত ওসব!’
জেলে তার বউকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘স্বপ্ন নয়। সবই সত্যি। সবই বাস্তব। এ আর এমন কী দেখলে বউ। এভাবে আমরা সারা জীবনই মুক্তা পেতে থাকব। সেই মুক্তা বিক্রি করে আমরা বিরাট ধনী হয়ে যাব। কী সৌভাগ্যই না আমাদের। ভাবতে পারো, বউ?’
ঠিক তখনই মেঝেতে একটি মুক্তা আচমকা ঝলমলিয়ে উঠল। সেই সঙ্গে দেখা গেল মুক্তাটিতে কেমন যেন চোখ আর মুখ ফুটে উঠেছে। মুক্তাটি পিটপিট করে তাকাল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘আমাকে তোমরা বিক্রি করো না যেন। কারণ আমি হলাম সকল মুক্তার রানী। অর্থাৎ মুক্তারানী। আমাকে রেখে বাকিগুলো তোমরা বিক্রি করে দিও। আমি তোমাদের বিপদ-আপদ থেকে বাঁচাব।’
মুক্তারানীর কথা শুনে জেলে খুব যতœ করে তাকে হাতে তুলে নিল। তাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে সুন্দর একটি কৌটায় ভরে রাখল।
পরের শুক্রবার জেলে তিমির কাছ থেকে আরও মাছ পেল। মাছ বাড়ি এনে কেটে আরও মুক্তা পেল। জেলে মুক্তাগুলো পরিষ্কার করে আর ভাবে, মুক্তা থাকে ঝিনুকের ভেতর। মাছের পেটে কী করে এল, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। যাক! ওসব ভেবে কোনও লাভ নেই। মুক্তা পাচ্ছি এই বেশ।
এভাবেই যাচ্ছিল দিন।

 
এদিকে জেলের মুক্তা পাওয়ার খবর কী করে যেন ওই অঞ্চলে জানাজানি হয়ে গেল। তার কিছুদিন পর এক রাতে জেলের বাড়িতে ডাকাত পড়ল।
ডাকাত দল সবকিছু লুট করতে শুরু করল। এমন সময় আচমকা শোনা গেল সমুদ্রের গম্ভীর আওয়াজ। এমন গম্ভীর আওয়াজ শুনে ডাকাত দল থতমত খেয়ে গেল। ভয়ে কাঁপতে লাগল তারা। জেলে আর জেলে বউ বুঝতে পারল কিছু একটা মজার ব্যাপার ঘটতে চলেছে। কেউ একজন তাদের সাহায্য করতে আসছে। তারপরই ঘটল আচানক ঘটনাটি। ছোট্ট ফুটবলের মতো একটি বস্তুকে শূন্যে ভাসতে দেখা গেল। সকলের মাথার ওপর দিয়ে বস্তুটি এলোমেলো কয়েকবার চক্কর খেল। চক্কর খেয়ে গিয়ে প্রথমে ওটি ডাকাত সর্দারের মাথায় আঘাত করল। সাথে সাথে লোকটি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর একে একে সব ডাকাতের মাথায় বস্তুটি আঘাত করল। সকলেরই এক অবস্থা হল। ফলে সে রাতে ডাকাতরা জেলের বাড়িতে আর ডাকাতি করতে পারল না।
পরিস্থিতি যখন শান্ত হল তখন জেলে ও তার বউ আবার সেই গম্ভীর আওয়াজটি শুনতে পেল। ঠিক তখনই তারা দেখতে পেল, ফুটবলের মতো বস্তুটি কেমন যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে। পরে ওটি ছোট হতে হতে একবারে মার্বেলের আকার ধারণ করল। সেই মার্বেলটি আবার নিজে নিজে কৌটার মধ্যে ঢুকে আগের মতোই ঝলমল করে উঠল।
জেলে আর জেলে বউ বুঝল, এটি তাদের সেই মুক্তারানী। যার কারণে আজ তারা এতবড় বিপদ থেকে রক্ষা পেল। মুক্তারানী তার কথা ঠিক ঠিক রেখেছে। পরে মুক্তারানীকে তারা অনেক ধন্যবাদ জানাল।

দুঃখিত!