গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ওয়ালি দাদ একজন করিতকর্মা ছুতোরের নাম | তার হাতের বাটালি ছুটত ঠিক যেমন ইঞ্জিনের মধ্যে ধকধক পিস্টন. ঠিক যেমন চিত্রকরের হাতে তুলি, ঠিক যেমন জল কেটে এগিয়ে যাওয়া রাজহাঁসের একজোড়া পা, ঠিক যেমন… নাহ থাক! ওয়ালি ওস্তাদ তার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে এত সব কথা বলা দু’চক্ষে সইতে পারে না ! আসলে ওয়ালি দাদ রোজ সকালবেলা জঙ্গলে গিয়ে কুড়ুল দিয়ে কাঠ কাটে, তারপর দুপুরবেলা সেই কাঠ বাটালি দিয়ে চেঁছে শক্তপোক্ত তক্তা বানিয়ে ফেলে আর বিকেলবেলা হলেই বাজারে সেই কাঠের তক্তাগুলো বেচে দেয় | ব্যাস এটুকুই তার কাজ | আর এর বদলে প্রতিদিন সে ঠিক তিন রূপিয়া রোজগার করে | তার মধ্যে একটা গোটা রূপিয়া খরচা হয়ে যায় খাবারদাবার কিনতে | জামাকাপড়, এক বান্ডিল বিড়ি, তাছাড়া এটা সেটা আর যা যা তার লাগে সেসব কিনতে আরো এক রূপিয়া | বাদ বাকি এক রূপিয়া রোজ রাতের বেলায় বাড়ি ফিরে এক প্রকান্ড মাটির কুঁজোয় জমিয়ে রাখে ওয়ালি দাদ | বছরের পর বছর, মাসের পর মাস, দিনের পর দিন ওয়ালি এভাবেই তোফা কাটিয়ে দিচ্ছে | গঞ্জের হল্লাগুলো থেকে দূরে জঙ্গলের ধরে তার একটা ছোটমোটো মাটির মকান আছে | রোজ রাতের দিকে সেখানে ওয়ালি দাদ ফুর্তিতে শিস দিয়ে গান গায় – কে না শুনেছে সেই গান!
একদিন, যেদিন সকাল থেকে ঘমাসান বৃষ্টি পড়ছিল আর কনকনে ঠান্ডা হওয়া স্তেপের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় দীঘল ঘাসগুলোকে নুইয়ে দিচ্ছিল, সেদিন ওয়ালি দাদ আর কাঠ কাটতে গেল না | ঘরে বসে খুঁটিনাটি খুটখুট করতে করতে ওয়ালি ওস্তাদের চোখ পড়ল সেই বিশাল কুঁজোটার দিকে যার ভিতর সে হররোজ এক রূপিয়া জমিয়ে রাখে |
‘আরে কুঁজোটা তো বেমালুম ভর্তি হয়ে গেছে, এক্ষুনি এটাকে খালাস না করলেই নয়’, ওস্তাদ ভাবল | ‘নয়তো কালকে রাতে বাজার থেকে ফিরে যখন ১ রূপিয়া অর মধ্যে ঝনাত ছুঁড়ে দেব, রুপিয়াটা নির্ঘাত কুঁজো উপচে বাইরে এসে পড়বে |’ যেমন ভাবা তেমন কাজ | ওয়ালি দাদ তার পরিচিত এক স্বর্ণকারের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো আর তাদের উঠোনে গিয়ে রূপিয়া ভর্তি কুঁজোটাকে উপুড় করে দিয়ে বলল – ‘আঃ শান্তি! এগুলোর বদলে আমাকে বরং এক টুকরো সোনা দাও |’ স্বর্ণকার, যেহেতু সে ছিল একজন ইমানদার ব্যবসায়ী এবং ওস্তাদের বিশেষ দোস্ত, তাই রুপিয়াগুলোকে গুনে গেঁথে হিসেব করে তার বদলে একজোড়া অপূর্ব কারুকার্যময় ঝকঝকে সোনার ভারী কাঁকন সওদা দিল! কিন্তু সোনার কাঁকনটা হাতে পেয়ে ওয়ালি দাদ আরেক আতান্তরে পড়ে গেল | এমন একজোড়া সুন্দর সোনার কাঁকন তার কিইবা কাজে লাগতে পারে! ভাবতে ভাবতে রাত কাবার | পরদিন সকালে কুঠার কাঁধে সে যখন সবে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াতে যাবে, রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মস্ত এক বণিকের | যার সঙ্গে ছিল সাত-সাতটা মালপত্র বোঝাই উটের সারি | তাকে দেখে ওস্তাদের মাথায় চমত্কার এক ফন্দি খেটে গেল |
‘বলত ভাইসাহেব, এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেখতে মেয়ে কে?’ – ওয়ালি দাদ জিজ্ঞেস করে বসল |
‘কে আবার! খাইস্তানের রাজকন্যে – এই তো এখন তার প্রাসাদেই যাচ্ছি আমি, তার জন্য সাত-সাতটা উটের পিঠে বোঝাই সুন্দর সুন্দর রকমারি পোশাক নিয়ে |’
হাতে চাঁদ পেল ওয়ালি ওস্তাদ –
‘আমার একটা উপকার করবে ভাইসাহেব? এই সোনার কাঁকনজোড়া সেই অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যের কাছে পৌঁছে দেবে আমার হয়ে?’
বণিক এমন অবাক আর কক্ষনো হয়নি, সে ওয়ালি দাদের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ওয়ালি ওস্তাদ ততক্ষণে কাকুতি মিনতি করতে শুরু করে দিয়েছে –